বৃহস্পতিবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা

লাগেজ হয়রানিতে শাহজালাল

বিজনেস ক্লাস যাত্রীদেরও রেহাই নেই

লাগেজ হয়রানিতে শাহজালাল

হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরে বিদেশফেরত যাত্রীদের হাজার হাজার লাগেজ পড়ে আছে। অথচ যাত্রীরা তাদের লাগেজ খুঁজে খুঁজে হয়রান। দিনের পর দিন বিমানবন্দরে ধরনা দিয়েও হারানো লাগেজ না পেয়ে অনেকে আশাই ছেড়ে দিয়েছেন। একদিকে বিমানবন্দরে লাগেজ সংকুলান হচ্ছে না। গোডাউন ছাড়িয়ে বহির্গমনের সর্বত্র লাগেজের স্তূপ। অন্যদিকে প্রতিদিন লাগেজের সন্ধানে যাত্রীরা করছেন আহাজারি। সাধারণ যাত্রী শুধু নয়, বিজনেস ক্লাসের যাত্রীরাও রয়েছেন এই তালিকায়। ইমিগ্রেশন থেকে শুরু করে লাগেজপ্রাপ্তিতে তারাও চরম হয়রানির শিকার হচ্ছেন। লাগেজ পেতে তাদের অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আর যারা পাচ্ছেন না, তাদের সঠিক তথ্য কেউ দিতে পারছেন না। এমনি এক পরিস্থিতিতে দেশের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর শাহজালালে যাত্রীসেবা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের মন্ত্রিসভা থেকে শুরু করে বিমানবন্দর সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার বিভাগীয় বৈঠকেও যাত্রী হয়রানি নিয়ে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে, সিদ্ধান্ত হয় হয়রানি বন্ধের। কিন্তু কাজ হচ্ছে না কিছুতেই। বরং দিন দিন এই হয়রানির মাত্রা বেড়েই চলেছে। বিদেশ গমন এবং ফেরত- সব ধরনের যাত্রীই হয়রানির শিকার হচ্ছেন। গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের এই দায়িত্ব পালন করছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস।

বিমানবন্দরের সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, বিদেশ থেকে উড়োজাহাজে লাগেজ দিয়ে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তা খুঁজে না পাওয়ার ভুক্তভোগীর সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে। লাগেজ কবে পাবে, এ প্রশ্নের উত্তরও সংশ্লিষ্ট কেউ দিতে পারেন না। বিমানবন্দরে সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে যাত্রী হয়রানি আর বিমানের চরম অবহেলার নানা ঘটনা। বিমানবন্দরে কর্মরত লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ডের কর্মীরা জানান, প্রতিদিন শত শত যাত্রী লাগেজ হারানোর অভিযোগ করছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যাত্রী আসার পরদিন লাগেজ আসে। এভাবে গত এক মাসে প্রায় এক হাজারেরও বেশি লাগেজ জমা হয়ে গেছে। লাগেজ হারানোর তুলনায় পাওয়ার সংখ্যা অনেক কম। অবশ্য প্রতিদিনই লাগেজপ্রাপ্তির পরিমাণ বাড়ছে।

লাগেজ পেতে হয়রানি : যশোরের বাসিন্দা গোলাম মোস্তফা তিন বছর পর রিয়াদ থেকে ঢাকায় আসেন। বিমানবন্দরে নেমে কনভেনর বেল্টে দীর্ঘ অপেক্ষার পর সবার শেষে দেখতে পান তার দুটি লাগেজ আসেনি। লাগেজে ছিল প্রিয়জনের কিছু দামি কসমেটিক, বাচ্চার চকোলেট আর কিছু ইলেকট্রনিক আইটেম। কেন লাগেজ আসেনি তা জানার জন্য বার বার বিমান কর্মীদের কাছে জানতে চান। বিমানের দায়িত্বরত কোনো কর্মচারী তাকে লাগেজ হারানোর কারণ জানাতে পারেননি। শুধু তার হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ডের একটি রসিদ। বলা হয় কদিন পর রসিদসহ যোগাযোগ করতে। দীর্ঘদিন পর প্রবাস থেকে দেশে ফেরার আনন্দ মুহূর্তেই বিষাদে পরিণত হয়। অনন্যোপায় হয়ে তিনি খালি হাতে বাড়ি গিয়ে চরম লজ্জায় পড়েন। মোস্তফা বাড়ির ছোট-বড় কাউকেই বিশ্বাস করাতে পারেননি যে লাগেজ বিমানবন্দর থেকে হারানো গেছে। বিমান কর্মীদের নির্দেশমতো তিনি ৬ হাজার টাকায় একটি মাইক্রোবাস ভাড়া করে তিন দিন পর লাগেজ নিতে ঢাকায় আসেন। দুর্ভাগ্য তার। এদিনও মেলেনি লাগেজ। মোস্তফার মতো শত শত যাত্রী দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন প্রতিদিনই। সাধারণ যাত্রীদের মতো বিজনেস ক্লাসের যাত্রীদেরও এমন ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে নিয়মিত। গত সপ্তাহে দেশের একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী একটি ফ্লাইটে বিজনেস ক্লাসের যাত্রী হয়ে দুবাই থেকে দেশে ফেরেন। শাহজালাল বিমানবন্দরে অবতরণের পর তিনি ইমিগ্রেশনে যান। ইমিগ্রেশনে গিয়ে তিনি দীর্ঘ লাইনের মধ্যে পড়েন। এখানে তিনি দীর্ঘ সময় আটকে থাকেন। প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করে তিনি তার লাগেজের জন্য পৌঁছান কনভেনর বেল্টের কাছে। তার ব্যাগ খুঁজে পেতে গলদঘর্ম হতে হয় তাকে। প্রায় দুই ঘণ্টা পর শত শত লাগেজের মাঝে তিনি খুঁজে পান নিজেরটি। আক্ষেপ করে ওই ব্যবসায়ী জানান, বিজনেস ক্লাসের যাত্রী হয়েও বিমানবন্দরে তারা কোনো আলাদা সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন না। বহির্গমনের ইমিগ্রেশনে বিজনেস ক্লাস যাত্রীদের জন্য আলাদা লাইন থাকলেও ফিরে আসার সময় তা পাওয়া যায় না। সাধারণ যাত্রীদের সঙ্গেই লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করতে হচ্ছে। তাহলে বিজনেস ক্লাসের যাত্রী হয়ে ভ্রমণের কোনো মানেই হয় না বলে জানান ওই ব্যবসায়ী। ইকোনমি ক্লাস বা বিজনেস ক্লাস হোক, বিদেশফেরত যাত্রীরা এমনিভাবেই শাহজালাল বিমানবন্দরে পায়ে পায়ে চরম হয়রানির শিকার হন। বিদেশফেরত যাত্রীরাই শুধু নন, একই কায়দায় চরম হয়রানির শিকার হচ্ছেন বিদেশগামী যাত্রীরাও। অভিযোগ উঠেছে, যারা যাত্রীদের সেবা দেওয়ার দায়িত্ব নিয়ে বিমানবন্দরে নিয়োজিত আছেন, তাদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশই হয়রানি করছেন যাত্রীদের। দায়িত্ব পালন আর সেবার নামে হাতিয়ে নিচ্ছেন টাকাকড়িসহ মূল্যবান জিনিসপত্র। অবস্থা এমনই এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, রক্ষকরাই এখন ভক্ষকরূপ নিয়েছে। ইমিগ্রেশন নিয়ে যত অভিযোগ : শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন বিভাগের বিরুদ্ধে যাত্রীদের রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। আর এর পেছনে অদক্ষতাকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রতিদিনই এ বিভাগ থেকে ছাড়পত্র নিতে যাত্রীদের লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে দীর্ঘ সময়। ইমিগ্রেশন বিভাগের দাবি, কাউন্টার-স্বল্পতার কারণেই এ সমস্যা। তবে সিভিল অ্যাভিয়েশন এ দাবি নাকচ করে দিয়ে বলছে, পর্যাপ্ত কাউন্টার থাকলেও জনবলের অভাবে যাত্রীদের ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। বিভিন্ন এয়ারলাইনস কোম্পানিও দক্ষ জনবলের অভাবকেই দায়ী করছে। সূত্র জানায়, শাহজালাল বিমানবন্দরে অল্প সময়ের ব্যবধানে একাধিক উড়োজাহাজের শিডিউল পড়লেই ইমিগ্রেশন কাউন্টারগুলোর সামনে জট লেগে যায়। নিয়ম অনুযায়ী, ফ্লাইট ছাড়ার দুই ঘণ্টা আগে লাইনে দাঁড়িয়েও ছাড়পত্র মেলে না যাত্রীদের। ফলে উড়োজাহাজগুলো সময়মতো উড্ডয়ন করতে পারে না। এতে উড়োজাহাজগুলো অন্য বিমানবন্দরে নির্ধারিত সময়ে পৌঁছাতে না পারায় তৈরি হচ্ছে এয়ার ট্রাফিক। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের এটিএস অ্যান্ড অ্যারোডম বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনের জন্য পর্যাপ্ত কাউন্টার রয়েছে। প্রতিটি কাউন্টারে চারজন লোক রয়েছে। তাদের জন্য আলাদা কম্পিউটারসহ সব ধরনের ব্যবস্থা রাখা আছে। তবে ইমিগ্রেশন বিভাগের লোকবল কম থাকায় সব কাউন্টার ব্যবহার হয় না। এ সমস্যা দূর করতে লোকবল বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। তবে সিভিল অ্যাভিয়েশনের এ ব্যাপারে কিছু করার নেই।

 

 

সর্বশেষ খবর