শুক্রবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা
পড়াশোনার পরিবেশ বিঘ্ন হচ্ছে

ক্যাম্পাসে দাঙ্গা-হাঙ্গামা সংঘর্ষের যত কারণ

ক্যাম্পাসে দাঙ্গা-হাঙ্গামা সংঘর্ষের যত কারণ

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাসে অস্থিরতা লেগেই আছে। প্রায় প্রতি মাসেই ছাত্র সংগঠনগুলোর কোন্দলে হতাহতের ঘটনা ঘটছে। উচ্চশিক্ষার ডিগ্রি নিতে এসে লাশ পড়ছে অনেক নিরীহ ছাত্রের। সর্বশেষ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের গোলাগুলিতে নিহত হয়েছেন তাপস নামের এক শিক্ষার্থী। মাত্র কয়েক দিন আগে সিলেটে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে সহিংসতার কারণে বিঘ্ন হচ্ছে পড়াশোনার পরিবেশ। ক্যাম্পাস বন্ধ থাকছে মাসের পর মাস। সেশনজটের ঘানি টানতে হচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই দাঙ্গা-হাঙ্গামা, সংঘর্ষের বেশকয়েকটি কারণ। এর মধ্যে ক্যাম্পাসে প্রভাব বিস্তার, কমিটি নিয়ে বিরোধ, ভর্তিবাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, শিক্ষকদের দলাদলি, প্রশাসনে গ্রুপিং উল্লেখযোগ্য। তা ছাড়া এসব ঘটনায় ব্যবস্থা না নেওয়ায় সংঘাত-রক্তপাত বন্ধ হচ্ছে না। বিভিন্ন মতাদর্শের ছাত্রসংগঠন থাকলেও যে দল ক্ষমতায় থাকে সেই ছাত্র সংগঠনই নিজেদের মধ্যে সহিংসতায় লিপ্ত থাকে। নিজ দলের কর্মীর হাতে নিজেরাই মার খাচ্ছে, মারা যাচ্ছে। শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘ক্যাম্পাসগুলো ছাত্রসংগঠন অস্থির করে তুলছে। বর্তমানে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। যারা তাদের নিয়ন্ত্রণ করবেন তারা এ কথা স্বীকারই করেন না। ছাত্রলীগের কথা শুনলে প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয় না। এর ফলে আরও অপ্রতিরোধ্য ছাত্রলীগ! তারা বঙ্গবন্ধুর কথা বলে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ছিটেফোঁটাও তাদের মধ্যে নেই।’
প্রভাব বিস্তার : ক্যাম্পাসে প্রভাব বিস্তার করতে ছাত্রসংগঠনগুলো জড়িয়ে পড়ে সংঘর্ষে। তবে বিরোধী মতের সংগঠনের থেকে বেশি সংঘাত হয় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের নিজেদের কোন্দলেই। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গত রবিবার ছাত্রলীগের অন্তঃকোন্দলের বলি হয় তাপস নামে এক শিক্ষার্থী। কয়েকদিন আগে সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে মারা যায় আরেক কর্মী। এ ছাড়া একই মতাদর্শের দল করলেও স্থানীয় রাজনীতির রোষানলে পড়ে বাইরের জেলা থেকে আসা ছাত্র নেতারা হামলার শিকার হন। ছাত্র নেতাদের রয়েছে আলাদা আলাদা গ্রুপ। প্রভাব বিস্তার করতে তারা হরহামেশাই সংঘর্ষে জড়ান।
বাণিজ্য, টেন্ডার-চাঁদাবাজি : টেন্ডারবাণিজ্য, নিয়োগবাণিজ্য, ভর্তিবাণিজ্য, পরিবহন অফিসে চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধে জড়িত নেতা-কর্মীরা। গ্রুপিংয়ের কারণে এসব বাণিজ্যে সংগঠনের ভিতরেই তৈরি হয় অন্তঃকোন্দল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেন, ‘স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ে ছাত্রসংগঠনগুলোর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ছিল। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে সংগঠনগুলোর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। ক্ষমতায় এলেই তারা ‘কী পেলাম’ ইস্যুতে বেপরোয়া কার্যক্রমে জড়ায়। অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের কর্মী হিসেবে পরিচিত করতেও অনিয়ম, সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।’
অস্ত্র-মাদক ব্যবসা : অনেক ছাত্রনেতা অস্ত্র ও মাদক ব্যবসায় জড়িত। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, রাজধানীর বড় কলেজগুলোর ছাত্র নেতাদের বিরুদ্ধেও রয়েছে এমন অভিযোগ। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ইয়াবাসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী গ্রেফতার হয়েছে। অস্ত্র-মাদক ব্যবসার ভাগবাটোয়ারা নিয়েও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে।
শিক্ষকদের দলাদলি : ক্যাম্পাসে অস্থিরতার জন্য অনেক ক্ষেত্রেই দায়ী কলুষিত শিক্ষক রাজনীতি। শিক্ষকদের দলাদলির প্রভাব পড়েছে ছাত্র রাজনীতিতেও। প্রভাব বিস্তার করতে ছাত্র নেতাদের বিভিন্ন সময় ব্যবহার করেন শিক্ষক নামধারী রাজনীতিকরা। বিরোধীদলীয় শিক্ষকদের হেনস্তা করতে ছাত্র সংগঠনকে সংঘর্ষে লেলিয়ে দেন তারা। কুষ্টিয়ায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে গত বছর শিক্ষকদের দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে হামলা চালায় ছাত্রলীগ। দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়েই দলীয় বিবেচনায় শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের অভিযোগ রয়েছে। তারা নিয়োগ পেয়ে ভূমিকা পালন করেন দলীয় ক্যাডারের।
প্রশাসনে গ্রুপিং : কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইস চ্যান্সেলর ও প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর আলাদা গ্রুপ গড়ে তুলে প্রশাসনিক কাজকর্ম চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ভিসি গ্রুপ ও প্রো-ভিসি গ্রুপের বিরোধে প্রায়ই প্রশাসনিক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। ফায়দা লুটতে তারা ছাত্র নেতাদেরও ব্যবহার করেন। কখনো অন্য প্রশাসককে ব্যর্থ প্রমাণ করতে অস্থির করে তোলেন ক্যাম্পাস।
নেতাদের এজেন্ডা : অনেক রাজনীতিক নিজ নির্বাচনী এলাকা ও এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে ছাত্র সংগঠনকে ব্যবহার করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন ইস্যুতে ছাত্র সংগঠনগুলোকে সংঘর্ষে লেলিয়ে দেন। মন্ত্রী-এমপি ও প্রভাবশালী অনেক নেতার বিরুদ্ধে রয়েছে এমন অভিযোগ।
ব্যবস্থা নেওয়া হয় না : ছাত্র সংগঠনগুলো বিভিন্ন সময় দাঙ্গা-হামলা, সংঘর্ষে জড়িয়ে ক্যাম্পাস অস্থির করলেও তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয় না বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। দায়সারা তদন্ত কমিটি করলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এর প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় না। অনেক সময় খুনখারাপির সাজাও শুধু সংগঠন বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী এ ব্যাপারে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ লেখাপড়ার পরিবেশ বিঘ্ন করা, ক্যাম্পাস অস্থির করাসহ বিভিন্ন কার্যক্রমের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কর্তৃপক্ষের উচিত, কার্যকরী যে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখা।’
নিয়ন্ত্রণ নেই ছাত্রলীগের : পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রলীগের তোপে বিরোধী ছাত্র সংগঠনগুলো এখন কোণঠাসা। কিন্তু নিজেদের খুনোখুনিতে বিপর্যস্ত ছাত্রলীগও। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগকে মানছে না বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ। কোনো বিতর্কিত কর্মকাণ্ড প্রচার হলেই লোকদেখানো তদন্ত অথবা সাময়িক বহিষ্কার করা হলেও কিছুদিন পর অপরাধীরা আবার স্বপদে ফিরে যান। আবারও জড়ান বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে, সংঘর্ষে। অভিযোগ রয়েছে, অনেক জায়গায় টাকার বিনিময়ে দেওয়া হয়েছে কমিটি। সে কারণেই কেন্দ্র থেকে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি এইচ এম বদিউজ্জামান সোহাগ বলেন, ‘টাকার বিনিময়ে কমিটি দেওয়ার অভিযোগ সত্য নয়। যেসব কমিটি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নির্দেশ মানছে না, সেগুলো স্থগিত করে দেওয়া হচ্ছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ কর্মী মৃত্যুর ঘটনায় জড়িতদের অধিকাংশদের নামে হাটহাজারী থানায় মামলা আছে। পুলিশ তাদের কেন গ্রেফতার করেনি, তা বিস্ময়ের কথা! তা ছাড়া সেখানে ছাত্রলীগের কমিটি দীর্ঘদিন ধরেই স্থগিত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দোষীদের ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নিলে ক্যাম্পাসে সংঘাত কমে আসবে।’
ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান বলেন, ‘ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসগুলোতে একনায়কতান্ত্রিক কায়দায় বিরোধী ছাত্র সংগঠনের ওপর হামলা করছে। অনৈতিকভাবে অর্থ উপার্জন করতে গিয়ে নিয়োগবাণিজ্য, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিতে জড়াচ্ছে। নিজেদের গ্রুপের কোন্দলে নিজেরাই মারা যাচ্ছে। ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। বিএনপির আমলে এমন কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটলেও এখনকার মতো ব্যাপক ছিল না।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর