মঙ্গলবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা
রেল লাইনে লাশ

হত্যা না দুর্ঘটনা সুরাহা হয় না

তিন বছরে রাজধানীতে ৮৬৫ জনের মৃত্যু, রহস্যের কিনারা নেই

হত্যা না দুর্ঘটনা সুরাহা হয় না

গত অক্টোবরে বিমানবন্দর স্টেশন পেরিয়ে টঙ্গীর কাছে রেল লাইনের পাশ থেকে অজ্ঞাত এক যুবকের লাশ উদ্ধার করে রেলওয়ে থানা পুলিশ। প্রথমে দুর্ঘটনা হিসেবে এ ঘটনাটি থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে পুলিশ। কিন্তু নিহতের স্বজনরা যুবকটিকে শনাক্ত করলে তদন্তের মোড় ঘুরে যায়। পুলিশ তদন্তের পর জানতে পারে এটি দুর্ঘটনা নয়, হত্যাকাণ্ড। 

যশোরের বাসিন্দা আবু বকর ঢাকা কমলাপুর থেকে চিত্রা ট্রেনের ছাদে চড়েছিলেন। ছাদেই তিনি ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন। টাকা ও মালামাল ছিনিয়ে নিয়ে তাকে ট্রেন থেকে ফেলে দেওয়া হয়। ঘটনাস্থলেই আবু বকরের মৃত্যু ঘটে। এ ব্যাপারে পরে হত্যা মামলা দায়ের হয় থানায়।
এর আগে গাজীপুরের চন্দ্রা এলাকায় রেল লাইনের পাশ থেকে এক যুবকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ২৫ বছর বয়সী ওই অজ্ঞাত যুবকের লাশ উদ্ধারের পর প্রথমে অপমৃত্যু উল্লেখ করে একটি জিডি করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে স্থানীয়রা যখন জানায়, সেখানে এ ধরনের কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি, তখন পুলিশ মামলাটিকে হত্যা মামলা হিসেবে গ্রহণ করে। রেলওয়ে থানা পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনার পর প্রায় বছর গড়িয়ে গেলেও তারা এখন পর্যন্ত ওই যুবকের পরিচয় উদ্ধার করতে পারেননি। রাজধানী ও তার আশপাশ এলাকায় এমনিভাবে রেল লাইনের ওপর বা পাশ থেকে প্রায় প্রতিদিনই লাশ উদ্ধার হচ্ছে। রেলওয়ের স্থাপনায় লাশ উদ্ধারের ঘটনা নিয়ে সাধারণত গা করে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ-সংক্রান্ত মামলা ও তদন্তের দায়িত্ব রেল পুলিশের (জিআরপি)। আর রেল পুলিশ জটিলতা এড়ায় অপমৃত্যু মামলা দায়ের করে। রেলওয়ে থানা পুলিশ সূত্র জানায়, গত তিন বছরে ঢাকা অঞ্চলে ৮৬৫ জনের লাশ উদ্ধারের ঘটনা ঘটে। প্রতিটি ঘটনায়ই অপমৃত্যু মামলা দায়ের করা হয়।  

এর মধ্যে ৫টি ঘটনায় তদন্তের পর হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। বাকি ঘটনাগুলোর মৃত্যুর সঠিক কারণ কখনোই উদ্ঘাটন হয়নি। সর্বশেষ গত ২৪ ঘণ্টায় রাজধানীতে চারজন ও গাজীপুরে একজনের ট্রেনে কাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। রেলওয়ে থানা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, রেল লাইনের ওপর থেকে উদ্ধার করা লাশের পরিচয় বের করা কঠিন। এরা কী হত্যাকাণ্ডের শিকার, নাকি আত্মহত্যা বা নিছক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন- তা সুরাহা করা যায় না। তবে বেশির ভাগ ঘটনাকে দুর্ঘটনা বা আত্মহত্যা বলেই চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ট্রেনে কাটা পড়ে নিহত লাশের ময়নাতদন্তে হত্যার আলামত পাওয়া খুব কঠিন। কারণ লাশের অবস্থা এমন হয়ে যায়, সেখান থেকে খুনের আলামত সংক্রান্ত কোনো কিছু উদ্ধার করা যায় না। এ সুযোগে দুর্বৃত্তরা কাউকে অচেতন করে রেল লাইনে ফেলে রেখে হত্যা করতে পারে। আর পুলিশ ভিসেরা পরীক্ষার আবেদন না করায় নিহতদের ভিসেরা সংরক্ষণ করে অচেতনের বিষয়টিও পরীক্ষা করা হয় না। মৃত্যুর কারণ নিয়ে সন্দেহ হলে অনেক চিকিৎসক আবার হত্যা, আত্মহত্যা কিংবা দুর্ঘটনাজনিত- এসব কিছুই উল্লেখ করেন না। মৃত্যুর কারণ হিসেবে তারা শুধু রক্তক্ষরণ, আঘাতে হাত-পা ভেঙে যাওয়াসহ বিভিন্ন বিষয় ময়নাতদন্ত রিপোর্টে উল্লেখ করেন। জানা গেছে, গত বছর ১৯ জুন রাজধানীর মগবাজার এলাকায় রেল লাইনের পাশ থেকে নবীউল্লাহ নবী নামে এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ‘আত্মহত্যা’ উল্লেখ করে পুলিশ একটি জিডি করে। নবী ছিলেন একজন  শেয়ারবাজারে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী। মৃত্যুর নয় দিন আগে তিনি অপহৃত হন। মৃত্যুর আগে মালিবাগ রেলক্রসিংয়ে ছয় ব্যক্তির সঙ্গে তার বাকবিতণ্ডা হয়। ওই মামলার আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ ও প্রত্যক্ষদর্শী না পাওয়ায় এসব ঘটনার রহস্য উন্মোচন করতে পারে না পুলিশ। অনেক ক্ষেত্রে পরিচয়ও পাওয়া যায় না বলে রেল লাইন থেকে উদ্ধার হওয়া লাশ কেউ হত্যা করে ফেলে রেখে গেছে, নাকি দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে- বিষয়টি পরিষ্কার হয় না। অর্থাৎ ক্লু জানা নেই বলে দুর্ঘটনা না হত্যা- ধারণা করা যায় না। এ কারণেই থানায় অপমৃত্যু মামলা করা হচ্ছে। ঢাকা রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল মজিদ বলেন, অপরাধীরা কাউকে হত্যার পর পুরো ঘটনাটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য রেল লাইনকে ব্যবহার করতে পারে। ঢাকা রেলওয়ে থানা সূত্রে জানা গেছে, ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে যারা মারা যান, অনেক ক্ষেত্রেই তাদের ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়। তবে রেলওয়ে এলাকা থেকে উদ্ধার হওয়া মৃতদেহগুলো কেউ হত্যা করেছে কিনা- তা তাৎক্ষণিকভাবে বোঝা যায় না। কেউ হত্যা করে যদি রেল লাইনে ফেলে রেখে যায়, তা দেখে অনেক সময় দুর্ঘটনাই মনে হতে পারে। যদি ধারণা করা যায় তাহলে সেক্ষেত্রে ভিসেরা পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। চলতি বছরে ঢাকা রেলওয়ে থানায় দুটি হত্যা মামলা হয়েছে ভিসেরা রিপোর্ট পাওয়ার পর। তবে মৃতদেহের পরিচয় না পাওয়া এবং কোনো ধরনের আলামত না পাওয়ায় সেগুলোর কোনো সুরাহা করা যায়নি। ঢাকা রেলওয়ে থানার এক কর্মকর্তা বলেন, অনেক ঘটনায় অভিযোগের পর তদন্তে দেখা গেছে ঘটনাটি দুর্ঘটনা। অন্য কোনো ঘটনায় কেউ মামলা করেনি। রেল লাইনে উদ্ধার লাশগুলো পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। নিহতের পরিবারও দুর্ঘটনা বলেই ধারণা করে এবং অনেক সময় মেনে নেয়। ঢাকা রেলওয়ে থানার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘জয়দেবপুরে শালবনের মধ্যে অনেক নির্জন স্থান রয়েছে, যেখানে আধা ঘণ্টায়ও কোনো মানুষের চলাচল নেই। সেসব স্থানে অনেক সময় মানুষ হত্যা করে রেল লাইনে লাশ ফেলে রাখা হয়। শুধু জয়দেবপুরই নয়, বাংলাদেশে এমন অনেক স্থানই রয়েছে। অপরাধীরা এ সুযোগটাই নেয়।

সর্বশেষ খবর