মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা

মাছে ফরমালিন, গরুর বদলে মহিষ, রেস্তোরাঁয় মরা মুরগি

মাছে ফরমালিন, গরুর বদলে মহিষ, রেস্তোরাঁয় মরা মুরগি

রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের বাজারগুলোতে বিক্রি হওয়া মাছ, মাংস ও মুরগিতে ভেজাল দেওয়া হচ্ছে। মাছের বাজারে দেদারসে বিক্রি হচ্ছে ফরমালিনযুক্ত মাছ। বিক্রেতারা গরু ও খাসির নামে নির্বিকারে মহিষ ও ভেড়ার মাংস বিক্রি করছেন। আর মরা মুরগির মাংস চলে যাচ্ছে বিভিন্ন হোটেল-রেস্তোরাঁয়। মুনাফার লোভে ক্রেতাদের ভেজাল সব আমিষ খাদ্য গছিয়ে দিচ্ছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। কিন্তু সাধারণ ক্রেতা তা বিন্দুমাত্র টের পাচ্ছেন না। অথচ নিরাপদ মাংস পাওয়ার জন্য পাস করা হয়েছে মাননিয়ন্ত্রণ বিল।
গত কয়েক বছর দীর্ঘ সময় ধরে মাছ সংরক্ষণের জন্য বিক্রেতারা কাঁচা মাছে মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর পদার্থ ফরমালিন ব্যবহার করছেন। এ ক্ষেত্রে বিক্রেতাদের দাবি, বিদেশ থেকে আমদানিকৃত মাছগুলোতেই ফরমালিনের ব্যবহার হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০০৫ ও ২০০৬ সালেও রাজধানীর বাজারে বড় মাছগুলোর পাশাপাশি ছোটগুলোতেও পরীক্ষায় ফরমালিনের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছিল। ফলে এটি পরীক্ষিত যে, বিদেশ থেকে আমদানিকৃত বড় মাছের পাশাপাশি ছোট দেশি মাছেও ফরমালিন ব্যবহৃত হচ্ছে। ফরমালিনের অপব্যবহার রোধে সে সময় ম্যাজিস্ট্রেট রোকন-উদ্-দৌলার মোবাইল কোর্ট ঢাকার বিভিন্ন বাজারে ফরমালিনযুক্ত মাছ ব্যাপক হারে ধরে অভিযুক্তদের শাস্তির ব্যবস্থা করেন। অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ফাঁকি দিতে বর্তমানে মাছের পাশাপাশি বরফেও ব্যবহৃত হচ্ছে ফরমালিন। অন্যদিকে নিরাপদ মাংসপ্রাপ্তি নিশ্চিত আইনের প্রয়োগ না থাকায় রাজধানীসহ সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে মানহীন গরুর মাংস বিক্রি করা হচ্ছে। বিক্রেতারা এ জন্য গরু বলে মহিষের মাংস এবং খাসি বলে ভেড়ার মাংস বিক্রি করছেন। এ ছাড়া অ্যানথ্রাক্স ও অসুস্থ পশুর জবাই করা মাংস খেয়েও অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। হাড়সর্বস্ব গরু মোটা করতে নির্বিচারে মোটা ও তাজাকরণের জন্য প্রয়োগ হচ্ছে নিষিদ্ধ স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ, যা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। বাংলাদেশে মানসম্পন্ন মাংস পাওয়ার জন্য সরকার ২০১১ সালে জাতীয় সংসদে মাংসের মাননিয়ন্ত্রণ বিল পাস করে। কিন্তু সেই বিধিমালা এখনো বাস্তবায়ন করা হয়নি। এ আইন লঙ্ঘনকারীদের সর্বোচ্চ এক বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা ন্যূনতম পাঁচ হাজার এবং অনূর্ধ্ব ২৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান আছে।
রাজধানীর মুরগির আড়তগুলো থেকে এখন দেদারসে মরা মুরগি চলে যাচ্ছে নগরীর হোটেল-রেস্তোরাঁয়। তেজগাঁও রেলস্টেশন-সংলগ্ন মুরগির আড়তে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের খামার থেকে প্রতিদিন গড়ে সর্বনিু দেড় লক্ষাধিক পর্যন্ত মুরগি প্রবেশ করে। প্রতি রাতে এ আড়তের তিনটি প্রবেশপথ দিয়ে যখন মুরগি বহনকারী একেকটি ট্রাক প্রবেশ করে, তখন ওতপেতে থাকা একটি চক্র জোর করে ট্রাক থেকে মরা মুরগিগুলো পোষা কুকুর বা চাষের মাগুর মাছকে খাওয়ানোর কথা বলে বিনামূল্যে সংগ্রহ করে। র‌্যাব সূত্রে জানা যায়, একটি সন্ত্রাসী মহল চক্রটিকে এ কাজে সহযোগিতা করছে। এ আড়তে প্রতিদিন এক থেকে দুই লাখ টাকার মরা মুরগি বিক্রি হয় এবং দেড় লক্ষাধিক মুরগির মধ্যে প্রতিদিন প্রায় দুই হাজার ঢাকায় আসতে আসতেই মারা যায়। মরা মুরগি সংগ্রহের চক্রটি এগুলো তেজগাঁও আড়তের ভিতরে নিয়ে গিয়ে রাত ১২টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত কেটেকুটে বিক্রির জন্য পরিষ্কার করে। সাধারণত চক্রটি প্রতিটি মরা মুরগি ৪০ টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন হোটেল ব্যবসায়ীদের কাছে এবং এ ব্যবসায়ীরা তা ১০০ থেকে ২০০ টাকায় ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করেন। একই অবস্থা রাজধানীর কাপ্তানবাজার মুরগির আড়তের। এ আড়তে অবৈধ ব্যবসায় জড়িত চক্রটি বহুদিন ধরেই মরা মুরগি সংগ্রহ করে আসছে। এখানকার মরা মুরগির ব্যবসায় জড়িতদের কারও কারও আবার লাইন্সেসও রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে ঢাকা সিটি করপোরেশনের (ডিসিসি) তৎপরতার কারণে চক্রটি মরা মুরগি বিক্রির কাজ বন্ধ রেখেছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। সাধারণত ঢাকায় বিভিন্ন স্থান থেকে আসা মুরগিগুলো ব্যবসায়ীরা মোট চারটি স্তরে নিয়ে আসেন। প্রতিটি খাঁচায় থাকে ৭০ থেকে ৮০টি মুরগি। খাঁচার মধ্যে অতিরিক্ত চাপে মুরগিগুলোর অনেকগুলোই গরম, ঝাঁকি কিংবা অসুস্থ হয়ে মারা পড়ে। র‌্যাবের ম্যাজিস্ট্রেট আনোয়ার পাশা বলেন, সাধারণত এক ধরনের অসাধু মাদকসেবী চক্র এ ব্যবসায় জড়িত। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রাজধানীর হোটেল, রেস্তোরাঁ ও ফাস্টফুডের দোকানে মরা মুরগির চাহিদা থাকে। হোটেলে মরা মুরগির পচা গন্ধ দূর করতে লেবু দিয়ে তা রান্না করা হয় বলে জানান আনোয়ার পাশা। সাধারণত রাজধানীর বিভিন্ন হোটেল-রেস্তোরাঁ, বিরিয়ানি ও তেহারি এবং ফুটপাতের দোকানগুলোতে মরা মুরগির মাংস বিক্রি করা হয়। আর এ খাবার খেয়ে ক্রেতা হচ্ছেন প্রতারিত। হিসাব মতে, রাজধানীতে সব আড়ত থেকে প্রতিদিন কমপক্ষে পাঁচ থেকে ছয় হাজার মরা মুরগি ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়ার কথা। কিন্তু ডাস্টবিনগুলোতে শুধু মুরগির পালকই দেখা যায়। মাংস দেখা যায় না। ভাবনার বিষয় মরা মুরগির মাংস যায় কোথায়!

সর্বশেষ খবর