বৃহস্পতিবার, ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ ০০:০০ টা

বিপর্যস্ত চিকিৎসা সেবা

হরতাল-অবরোধে রোগীশূন্য ক্যান্সার হাসপাতাল

এক সময় যেখানে রোগীর চাপে হাসপাতালে দাঁড়ানোর জায়গা ছিল না। সেখানে এখন রোগীশূন্য অবস্থায় বেকার সময় পার করছেন চিকিৎসক, নার্স, ওয়ার্ডবয়সহ কর্মকর্তা-কর্মচারী। হরতাল-অবরোধের কারণেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। হাসপাতালের মূল ফটকে দেখা হয় ক্যান্সার আক্রান্ত আকলিমা খাতুনের সঙ্গে। তিনি জানান, তিন মাস আগে আমার হাঁটুর একটি ক্ষত থেকে ক্যান্সার দেখা দেয়। প্রথম দিকে স্থানীয় একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ সেবন করি। কিন্তু দিন যতই যাচ্ছে অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। উপায়ান্তর না পেয়ে বৃহস্পতিবার সকালে রওনা হই ঢাকার মহাখালীর উদ্দেশে। মানিকগঞ্জের ঘিওর থেকে আসতে পথে পথে নানা সমস্যায় পড়তে হয়েছে। ঘিওর থেকে আসতে দেড় হাজার টাকা খরচ হয়েছে।
বিএনপির টানা অবরোধে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা। সড়ক-মহাসড়কে গাড়িতে আগুন, বিভিন্ন স্থানে চোরাগোপ্তা হামলা, পেট্রলবোমা ও ককটেল হামলা, মিছিল, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার কারণে অনিশ্চয়তায় পড়েছেন ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীরাও। অবরোধকারীদের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সও।
দেশের বিভিন্ন এলাকার ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীরা চিকিৎসার জন্য যানবাহনের অভাবে আসতে পারছেন না রাজধানীর মহাখালীতে অবস্থিত দেশের একমাত্র জাতীয় ক্যান্সার হাসপাতালে। এতে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিনযাপন করছেন রোগীরা। যা-ও দু-একজন আসছেন তাদের গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা। জীবন হারানোর ঝুঁকি তো থাকছেই। চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরতেও দুর্ভোগে পড়ছেন রোগীরা। এসব কারণে বিশেষায়িত হাসপাতাল জাতীয় ক্যান্সার হাসপাতাল ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে রোগীর সংখ্যা কমে অর্ধেকে নেমেছে। অপরদিকে জাতীয় ক্যান্সার হাসপাতালের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে আয়ও কমে অর্ধেকে নেমেছে। ফেব্রুয়ারিকে ক্যান্সার প্রতিরোধ মাস হিসেবে পালন করা হয়। অথচ এই মাসে প্রতিরোধ তো দূরের কথা উল্টো ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে দিন দিন মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছেন রোগীরা। রোগীদের ছাড়পত্র দেওয়া যাচ্ছে না হরতালের জন্য। রোগীরাও ইচ্ছে করে ছাড়পত্র নিচ্ছেন না। এমনকি হাসপাতাল থেকে একটু দূরে মহাখালী, ধানমণ্ডি, গুলশানসহ আশপাশ এলাকায় গিয়ে মেমোগ্রাফি, সিটিস্ক্যানের মতো অত্যন্ত জরুরি পরীক্ষা করাতে পারছেন না। এমনকি রোগীদের ব্ল্যাডের কিছু পরীক্ষা আছে যা এই হাসপাতালে হয় না। তা-ও করতে পারছেন না। গত বৃহস্পতিবার মহাখালীর জাতীয় ক্যান্সার হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, অন্যান্য সাধারণ দিনের মতো রোগীর কোনো ভিড়  নেই। যাত্রাবাড়ী থেকে আগত মহসীন নামের এক ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী জানান, হরতাল-অবরোধে রাস্তাঘাট ফাঁকা পেয়ে খুব সহজেই হাসপাতালে আসতে পেরেছি। আবার এখানে এসেও টিকিট নিতে লাইনে দাঁড়াতে হয়নি। নরসিংদীর রায়পুরা থেকে আসা জেসমিন নামের এক ষাটোর্ধ্ব রোগী ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ভাই রাস্তাঘাটে কোনো গাড়ি নেই। ঢাকায় আসতে যে কী বিপত্তি পোহাতে হয়। তার কোনো অন্ত নেই। রায়পুরা থেকে আসতে ৪-৫ বার গাড়ি পাল্টাতে হয়েছে। ময়মনসিংহের ফুলপুর থেকে আগত নাজিমউদ্দিন জানান, ভাই সেই ফুলপুর থেকে আসতে পথে পথে ভোগান্তি পেতে হয়েছে। আসার পথে মনে এক আতঙ্ক বিরাজ করেছে। যে কখন যেন কোন দিক দিয়ে বোমা মারে। এভাবে আতঙ্ক নিয়ে রাস্তাঘাটে চলাচল করা খুব মুশকিল। তবে অন্যান্য সময় ভর্তির জন্য যেখানে একজন রোগীকে ১০ থেকে ২০-২৫ দিন ঘুরতে হতো, সেখানে এখন আসামাত্রই ভর্তি হওয়া যায়। হরতাল-অবরোধে রোগীর সংখ্যা কমে যাওয়ায় হাসপাতালের আয়ও কমে গেছে। যেখানে প্রতি মাসে রেডিওথেরাপিসহ বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে আয় হতো ৬০-৭০ লাখ টাকা। সেখানে গত জানুয়ারি মাসে আয় হয়েছে মাত্র ৩০ লাখ টাকা। চিফ মেডিকেল অফিসার ডা. খোরশেদ আলম জানান, হরতাল-অবরোধ ছাড়া অন্যান্য সাধারণ দিনে রোগীদের যে হারে চাপ থাকে। এখন তা নেই। ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীরা হরতাল-অবরোধের কারণে সময়মতো চিকিৎসা নিতে না পারায় মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়ছেন। সময়মতো ফিজিওথেরাপি বা অন্যান্য জরুরি চিকিৎসা না নিলে এসব রোগীর মৃত্যুর ঝুঁকি আছে। হরতাল-অবরোধকারীদের উচিত রোগীবাহী গাড়িতে হামলা, ভাঙচুর, বোমা হামলাসহ এ জাতীয় মারাত্মক ঘটনা থেকে বিরত থাকা। জাতীয় ক্যান্সার হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোয়ারফ হোসেন বলেন, এখানে চিকিৎসা কার্যক্রম অন্যান্য দিনের মতোই চলছে। ক্যান্সার রোগীর দরকার জরুরি চিকিৎসা। তাই তারা শত বাধা পেরিয়েও চিকিৎসা নিতে আসছেন। তবে হরতাল অবরোধের কারণে রাস্তায় সমস্যায় পড়তে হচ্ছে তাদের।

সর্বশেষ খবর