শনিবার, ২৮ মার্চ, ২০১৫ ০০:০০ টা

অপরাধ সাম্রাজ্য কালাপানি পাহাড়

অপরাধ সাম্রাজ্য কালাপানি পাহাড়

অপহরণ, ধর্ষণ, গুম-খুন আর মাদক বাণিজ্যের অভয়ারণ্য নেত্রকোনার কালাপানি পাহাড়। নেত্রকোনার সীমান্তবর্তী উপজেলা কলমাকান্দার লেঙ্গুড়া ইউনিয়নের এ পাহাড়ি এলাকা যেন সব অপরাধের স্বর্গরাজ্য। সেখানে হয় না এমন কোনো অপরাধ নেই বলে জানিয়েছেন খোদ পুলিশ কর্মকর্তারাই। আর কালাপানি পাহাড়ি এলাকায় সংঘটিত সব অপকর্মের হোতা সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মহরম আলীর ছেলে মাসুদ রানা। যিনি সীমান্তের অপরাধ জগতের গডফাদার হিসেবেই ব্যাপক পরিচিত। তার বাহিনীর কাছে পুরো এলাকার মানুষ জিম্মি। সর্বশেষ ২০ মার্চ এই মাসুদ রানার আস্তানা কালাপানি পাহাড়ের দুর্গম এলাকা থেকে শিকল দিয়ে বাঁধা অবস্থায় ঢাকায় অপহৃত এক ব্যবসায়ীকে উদ্ধার করা হয়। বাহিনী-প্রধান রানা এখন পুলিশের কব্জায়। জানা গেছে, জেলা গোয়েন্দা ও কলমাকান্দা থানা পুলিশের যৌথ অভিযানে ধরা পড়েন মাসুদ রানা। তার দেওয়া তথ্যমতেই পুলিশ উদ্ধার করে ব্যবসায়ী গাজী মজিবুর রহমান মজনুকে। এর আগে ১১ মার্চ রাজধানীর পল্লবী থেকে ওই ব্যবসায়ী অপহৃত হন। র‌্যাব-৪-এর সহায়তায় মোবাইল ট্র্যাকিং করে মাসুদ রানাকে গ্রেফতার করা হয়। কলমাকান্দা থানায় জিজ্ঞাসাবাদের ১০ দিন পর অপহৃত ব্যবসায়ী মজনুকে উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতারের পর দিন শনিবার মাসুদ রানাকে রাজধানীর পল্লবী থানায় হস্তান্তর করে কলমাকান্দা থানা পুলিশ।
পল্লবী থানার এসআই মো. রাসেল বলেন, অপহরণকারী মাসুদ রানাকে ঢাকায় এনে রবিবার আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়। আদালত রিমান্ড নামঞ্জুর করে তাকে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ দেন। আগামী রবিবার অপহরণকারী মাসুদ রানাকে আবার জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে রিমান্ড চাওয়া হবে। পাশাপাশি ভিকটিমকে আদালত তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছে বলেও তিনি জানান।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, উদ্ধার হওয়া মজনুকে আটকে রেখে নির্যাতন চালিয়ে তার পরিবারের কাছে ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। তার মুখে বোতল ঢুকিয়ে গামছা দিয়ে চোখ বেঁধে ভারতীয় সীমান্তের ভিতরে জনৈক সাধুর কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পায়ে শিকল লাগিয়ে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়। এরপর ক্ষণে ক্ষণে তার পরিবারের কাছে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে মুক্তিপণ দাবি করা হয়। এক পর্যায়ে মজনুর পরিবারের সদস্যরা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর পরামর্শে ৫ হাজার টাকা পাঠিয়ে টোপ দেন সন্ত্রাসী মাসুদ রানাকে। তাকে পরিবারের পক্ষ থেকে বার বার বলা হয় বাকি টাকা জোগাড় হলেই বিকাশ করে পাঠানো হবে। এরপর বার বার মোবাইল ট্র্যাকিং করে অবস্থান নির্ণয় করা হয় মাসুদ রানার।
নেত্রকোনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল মোমেনের নির্দেশে ডিবি পুলিশের ফোর্স যায় কলমাকান্দায়। সেখান থেকে থানার ওসি মো. বশির আহমেদ গোয়েন্দা পুলিশ এসবির সহায়তায় দিনভর শ্বাসরুদ্ধকর অভিযান চালিয়ে স্থানীয় লেঙ্গুরা বাজার থেকে মাসুদ রানাকে গ্রেফতার করেন। তার কাছ থেকে অপহৃতের সিম কার্ড ভর্তি তিনটি মোবাইল ফোন সেট ছাড়াও আরও তিনটি সিম কার্ড উদ্ধার করা হয়। নেত্রকোনা ডিবির ওসি এ কে এম কাউসার ও কলমাকান্দা থানার ওসি মো. বশির আহমেদ বলেন, মাসুদ রানার সঙ্গে ভারতীয় অপহরণ ও পাচার কারী দলের বিশাল নেটওয়ার্ক রয়েছে। তিনি এর আগে ৩ মার্চ পুলিশে চাকরি দেওয়ার নাম করে নেত্রকোনা সরকারি কলেজের এক ছাত্রীকে প্রলোভন দেখিয়ে সীমান্তে নিয়ে আটকে রেখে ধর্ষণ এবং ৩ লাখ ১০ হাজার টাকা মুক্তিপণ আদায় করেন। এ ব্যাপারে ৫ মার্চ কলমাকান্দা থানায় মামলা হয়। এ ছাড়াও তার বিরুদ্ধে মাদকের পাইকারি ব্যবসাসহ সীমান্ত এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েমের অভিযোগ রয়েছে। কলমাকান্দা থানার এসআই নজরুল ইসলাম বলেন, এলাকায় প্রকাশ্যে তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খোলার সাহস পায় না। কালাপানি পাহাড় এলাকায় আদিবাসী এক নারীর সহায়তায় ভারতে প্রতিনিয়ত তার যোগাযোগ রয়েছে। মাসুদ রানা প্রতারক চক্রের অন্যতম ডন হিসেবে পরিচিত। এদিকে স্থানীয়রা সূত্র জানিয়েছেন, কলমাকান্দা উপজেলার লেঙ্গুড়াসহ আশপাশের নাজিরপুর ও খারনৈ এলাকার মানুষ অপরাধ সম্রাট মাসুদ রানার দাপটে ভীত। তার ভয়ে এলাকাবাসী মুখ খুলতে পারে না। এমনকি পুলিশও তার আশপাশ পর্যন্ত যেতে ভয় পেত। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে কালাপানি পাহাড়ের আশপাশের বিশাল এলাকা জুড়ে দীর্ঘদিন নিয়ন্ত্রণ করে আসা মাসুদ রানার রয়েছে নিজস্ব বিশাল সন্ত্রাসী বাহিনী। ১৬ ফেব্রুয়ারি মাসুদ রানার বাড়ির পাশ থেকে জুয়েল রানা (১৯) নামে এক ব্যবসায়ীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ব্যাপারে জুয়েল রানার বাবা আবুল কালাম আজাদ বাদী হয়ে ভয়ে অজ্ঞাত আসামি করে থানায় মামলা দায়ের করেন। এ ছাড়াও গত বছর ক্লাস ওয়ানের এক ছাত্র অপহরণ করে হত্যা করে পাহাড়ে ফেলে রাখে মাসুদ রানার বাহিনী। কলমাকান্দা থানার ওসি মো. বশির আহমেদ বলেন, মাসুদ রানা একজন কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ী। ধোঁকা দিয়ে মানুষ অপহরণ করে বিভিন্ন সময় টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেন। নানান জায়গায় পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পরিচয় দেন। এমনকি কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর মেয়েজামাই পরিচয় দিয়ে মানুষকে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন। তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা করছে পুলিশ।

সর্বশেষ খবর