রবিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১৫ ০০:০০ টা

অস্ত্র ও মাদকের খোলা হাট

* সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে আসছে গ্রেনেড, একে-৪৭ রাইফেল, গোলা-বারুদ
* হাতবোমা, চকলেট বোমা আনা হচ্ছে মুড়ি মুড়কির মতো

দেশের ১৮টি জেলার ৩০টি সীমান্ত পয়েন্ট এখন অস্ত্র ও মাদক বেচাকেনার খোলা বাজারে পরিণত হয়েছে। এই খোলাবাজারে ইয়াবা, ফেনসিডিলের যেমন খোলামেলা কেনাবেচা চলে, তেমনি অস্ত্রশস্ত্রও অবাধে ক্রয়-বিক্রয় হয়। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যবসায়ীরা সীমান্ত পয়েন্টের এই খোলাবাজারগুলোতে নিয়মিত ভিড় করে। রাজনৈতিক অস্থিরতায় ঢিলেঢালা নিরাপত্তা ব্যবস্থার সুযোগে সীমান্ত পয়েন্টগুলো দিয়ে অবাধে আসে অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ। বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট গলিয়ে ঢুকে পড়ে বিপুল পরিমাণ গ্রেনেড, একে-৪৭ রাইফেল, গোলা-বারুদ আর আগ্নেয়াস্ত্রের চালান।
হাতবোমা, চকলেট বোমা, টুটু বোর, রিভলবারের চালান আনা হচ্ছে মুড়ি-মুড়কির মতো। চারদিকেই আগ্নেয়াস্ত্রের ছড়াছড়ি থাকায় ছোট আকারের অনেক বিরোধেও অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মাঝে-মধ্যেই অভিযান চালান, ধরপাকড় করেন। অস্ত্র-মাদকের ছোট ছোট চালানও আটক হয়। কিন্তু বন্ধ হয় না হাট-বাজার। চলতি বছরের শুরুর দিকে একটি গোয়েন্দা সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দেশজুড়ে অস্ত্রশস্ত্র সহজলভ্য হয়ে পড়েছে এবং বেশ কিছু পয়েন্টে অস্ত্র কেনাবেচা চলছে প্রায় প্রকাশ্যেই। অন্য এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের বিভিন্ন সীমান্তের অন্তত ২৬টি পয়েন্ট দিয়ে আরজিএস গ্রেনেড, একে-৪৭ রাইফেল, নাইন এমএম-এর মতো মারাত্মক ধরনের অস্ত্রশস্ত্রও অবাধে ঢুকে পড়ছে। এসব পয়েন্টে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), সীমান্ত থানাগুলোর পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা নজরদারি নিশ্চিত করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেও বিশেষ নির্দেশনা জারি করা হয়। কিন্তু তারপরও কয়েকটি সীমান্ত পয়েন্ট এখনো অস্ত্র আমদানি ও বেচাকেনার বিপজ্জনক স্থান হয়ে উঠেছে। শুধু অস্ত্রশস্ত্রই নয়, পাশাপাশি মাদকের চোরাচালানও বেড়ে গেছে দেশে। দেশের ২৩টি সীমান্ত জেলা দিয়ে মাদক ঢুকলেও কুমিল্লা ও কক্সবাজারের উখিয়া সীমান্ত এলাকা রীতিমতো এখন মাদক সাম্রাজ্যে পরিণত হয়েছে। এ দুই জেলার পাঁচ উপজেলার বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে দেশে ঢুকছে বিপুল পরিমাণ মাদক। মাদক চোরাচালানে প্রতিনিয়তই ব্যবহার করা হচ্ছে অভিনব কৌশল। চোরাচালান দমনে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, পুলিশ-র‌্যাবসহ বিভিন্ন সংস্থা কাজ করলেও চোরাচালানিদের থামানো যাচ্ছে না। মাদক চোরাচালান দমনে কুমিল্লা সীমান্তে ১০ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়ন ডগ স্কোয়াড কাজে লাগাচ্ছে। কিন্তু প্রশিক্ষিত ডগ স্কোয়াডকে ব্যর্থ করতে চোরাচালানিরা অন্যরকম কৌশল প্রয়োগ করছে। তারা ফেনসিডিল রাখা বস্তায় বা পাত্রের চারপাশে বিশেষ পদার্থ ছিটিয়ে রাখে। এতে প্রশিক্ষিত কুকুর ওই বস্তার আশপাশে যাওয়া থেকে বিরত থাকে। কক্সবাজারের টেকনাফ, উখিয়া ও রামুর বিভিন্ন পয়েন্ট গলিয়ে ইয়াবা আসছে বানের জলের মতো। নানা রকম কায়দা-কৌশলে সেসব ইয়াবা পৌঁছে যাচ্ছে রাজধানীসহ দেশের সব জেলা-উপজেলায়। কক্সবাজারের টেকনাফ, উখিয়া, রামু, কুমিল্লার সদর, সদর দক্ষিণ ও চৌদ্দগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও শিবগঞ্জ, রাজশাহীর গোদাগাড়ী, পবা, চারঘাট, বাঘা, নাটোরের লালপুর, কুষ্টিয়ার দৌলতপুর, দিনাজপুরের হিলি, দেশমা, সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ, ভোমরা, সিলেটের জকিগঞ্জ ও জাফলং সীমান্ত পয়েন্ট সবচেয়ে বেশি অস্ত্র-মাদক পাচার হয়। এসব স্থানে বিজিবি ডিউটি পোস্ট ও টহল দলের সংখ্যা বাড়িয়েও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায় না। অতিসম্প্রতি একটি গোয়েন্দা সংস্থার দেওয়া প্রতিবেদনেও শেরপুর-জামালপুর জেলার দুর্গম পাহাড়ি সীমান্তের নয়টি পয়েন্টকে অস্ত্রশস্ত্র-গোলাবারুদ পাচারের স্পর্শকাতর স্থান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সীমান্ত পয়েন্টে অবস্থানকারী সন্ত্রাসীচক্র তাদের অস্ত্রশস্ত্র লেনদেন, বেচাকেনা ও পাচার কাজে রাজনীতির মাঠের পরিচিত কয়েকজনকে ব্যবহার করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনটিতে গারো পাহাড়ি সীমান্তের পয়েন্টগুলো ছাড়াও কক্সবাজারের উখিয়া, মহেশখালী, চকোরিয়া এবং চট্টগ্রামের পতেঙ্গা ও আনোয়ারা থানার গহিরা সমুদ্রঘেঁষা স্থানকে অস্ত্রশস্ত্র খালাসের বড় পয়েন্ট বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। অন্যদিকে সিলেটের জকিগঞ্জ, মৌলভীবাজারের কুলাউড়া, বড়লেখা ও কমলগঞ্জ সীমান্তের ১৬টি স্থান হচ্ছে অস্ত্র ও মাদক আনা-নেওয়ার সহজলভ্য পয়েন্ট।
ছড়িয়ে পড়ছে অত্যাধুনিক অস্ত্র : ঢাকাসহ দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে নতুন-ঝকঝকে চকচকে আগ্নেয়াস্ত্র। সংঘবদ্ধ একাধিক চক্র বিভিন্ন দেশ থেকে অবৈধ পথে প্যাকেটজাত অস্ত্রের চালান আনছে এবং তা ছড়িয়ে দিচ্ছে হাতে হাতে। মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন অভিযানে সম্পৃক্ত থাকা র‌্যাব, পুলিশ, গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত দুই বছরে উদ্ধারকৃত আগ্নেয়াস্ত্রগুলোর বেশির ভাগই ছিল নতুন-চকচকে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক উপ-কমিশনার বলেছেন, ‘আগে বিভিন্ন অভিযানে ভাঙাচোরা, পুরনো এবং দেশে তৈরি পাইপগান বেশি পাওয়া যেত। কিন্তু ইদানীং সন্ত্রাসীদের হাতে উঠে এসেছে অপেক্ষাকৃত ছোট আকৃতির এবং অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন আগ্নেয়াস্ত্র।’ সংশ্লিষ্ট একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা ও মাঠ পর্যায়ে চোরাচালান কাজে নিয়োজিত বিভিন্ন সূত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করে এসব বিপজ্জনক অস্ত্র লেনদেনের স্পটগুলো চিহ্নিত করা গেছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, হবিগঞ্জের সাতছড়ি, শেরপুরের গজনী, দিনাজপুরের হিলিসহ হাকিমপুর-ফুলবাড়ী, ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের প্রত্যন্ত পাহাড়ি সীমান্ত, সাতক্ষীরার কলারোয়া ও সুন্দরবন নদী সীমান্ত, মৌলভীবাজারের শরীফপুর সীমান্ত পয়েন্ট, রাজশাহীর বেড়পাড়া, টাঙ্গন, নওদাপাড়া, ইউসুফপুর সীমান্ত পয়েন্টে এখন আগ্নেয়াস্ত্রের অবাধ আনা-নেওয়া ও বিকিকিনি চলছে। নওদাপাড়া-কাটাখালী অঞ্চলে চিহ্নিত চোরাকারবারী বাবুর নেতৃত্বাধীন ফাইভ স্টার গ্রুপের দুর্বৃত্তরা মাদক চোরাচালানের পরিবর্তে এখন অবৈধভাবে আগ্নেয়াস্ত্র আমদানি ও কেনাবেচায় বেশি ব্যস্ত। সেখানে মাত্র ২০/২২ হাজার টাকায় ভারতীয় তৈরি পিস্তল, হালকা রিভলবার জাতীয় অস্ত্রশস্ত্র কেনাবেচা চলে বলেও একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে।
পাচারে নিত্যনতুন কৌশল : সারা দেশে র‌্যাব, পুলিশ, বিজিবিসহ মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তাদের অব্যাহত অভিযান সত্ত্বেও মাদকের আগ্রাসী থাবা বন্ধ হচ্ছে না। সরকারি কঠোর ব্যবস্থাপনার মধ্যে মাদক ব্যবসায়ীরা আরও বেশি বেপরোয়া এবং সচল থাকছে তাদের সরবরাহ ব্যবস্থাও। মাদক আমদানি, সরবরাহ ও বিপণন ব্যবস্থা নির্বিঘ্ন রাখতে একের পর এক কৌশল পাল্টাচ্ছে তারা। এসব নিত্যনতুন কৌশলে পাচার হয়ে আসা মাদকদ্রব্য ধরতে হিমশিম খাচ্ছে প্রশাসন। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, মাদকদ্রব্যের মধ্যে ইয়াবা ট্যাবলেট আসে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম রুট হয়ে। অন্যদিকে সাতক্ষীরা, যশোর, ঝিনাইদহ, মেহেরপুর, রাজশাহী, নওগাঁও, কুড়িগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা ও ফেনীর সীমান্ত পয়েন্টগুলো দিয়ে আসে ফেনসিডিলের চালান। ব্যবসায়ীরা যশোর, সাতক্ষীরা, বি-বাড়িয়া, সিলেট, ফেনীর ফুলগাজী, পরশুরাম, ছাগলনাইয়া, মুন্সীরহাট, বিলোনিয়া, কালীরহাট, পাঠাননগর, রানীরহাট, কুমিলা, সুয়াগাজী, চৌদ্দগ্রামসহ আরও কয়েকটি এলাকার সীমান্ত এলাকা দিয়ে অহরহ ফেনসিডিল, হেরোইন, আফিমসহ নানা রকমের মাদকের চালান নিয়ে আসছে। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অনুসন্ধান সূত্রে জানা যায়, মিয়ানমারের মংডু থেকে বিভিন্ন ফিশিং বোটের মাধ্যমে টেকনাফের স্থলবন্দর, শাহপরীর দ্বীপ, মাঝিরপাড়া, জালিয়াপাড়া, ট্রানজিট ঘাট, সাবরাংয়ের লেজিপাড়া ও বার্মাপাড়া পয়েন্ট দিয়ে প্রতিদিনই দেশে লাখ লাখ পিস ইয়াবা আসছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ঢাকা মহানগরীর উপ-পরিচালক রবিউল ইসলাম জানান, মাদকদ্রব্য উদ্ধার ও মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে অহরহ। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই তারা আইনের ফাঁক-ফোকর গলিয়ে জামিনে বেরিয়ে আবারও মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে।

সর্বশেষ খবর