রবিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১৫ ০০:০০ টা

থানার নাম পাগলা, পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়

থানার নাম পাগলা, পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়

থানা গঠন করা হয়েছে মাত্র তিন বছর। এর মধ্যে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়। যার সংখ্যা হবে সহস্রাধিক। বর্তমানে কর্মরত অফিসার ইনচার্জের (ওসি) বিরুদ্ধে অভিযোগের যেন শেষ নেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও ওসির নানা অপকর্মের ব্যাপারে অনেকে মন্তব্য করছেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ দিলে ভুক্তভোগীদের হয়রানি ও নির্যাতন করেন ওসি। এত কিছুর পরও ওসি বহাল রয়েছেন প্রায় এক বছর তিন মাস ধরে। গাজীপুর জেলা লাগোয়া ময়মনসিংহের পাগলা থানা এটি। ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার দক্ষিণ এলাকায় অবস্থান। এখনো অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়নি এই থানার। তবে নতুন ভবন প্রায় শেষ পর্যায়ে। ভাড়া বাড়িতে চলছে এই থানার কার্যক্রম। আর এখানেই চলে সাধারণ মানুষকে ধরে এনে নির্যাতন। পাগলা থানা এলাকা ঘুরে, অনুসন্ধান ও ব্যাপক খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওসি বদরুল আলম খানের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে হয়রানির গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। এলাকার প্রায় সব মানুষই কৃষি নির্ভর। অনেকে দিন আনে দিন খায়। এসব সাধারণ মানুষকে সন্দেহজনক হিসেবে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে নির্যাতন ও ভয়ভীতি দেখিয়ে মোটা অঙ্কের বাণিজ্যের অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা। পাগলা থানার ওসি বদরুল আলম খান পাগলা থানায় যোগদানের পর থেকেই পুলিশের অনিয়ম দুর্নীতি বেড়েছে। যা পুলিশের চেইন অব কমান্ড ভেঙেছে। ওসি এলাকাবাসীর কাছে এখন এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। সাধারণ মানুষকে হয়রানি করায় ওসির প্রতি গ্রামের মানুষের মধ্যে ক্ষোভের দানা বেঁধেছে। গাজীপুর জেলা লাগোয়া ময়মনসিংহ জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল পাগলা থানা। দেশে দীর্ঘদিন ধরে ২০-দলীয় জোটের আন্দোলন সংগ্রাম চললেও এই অঞ্চলে এর কোনো প্রভাব নেই। চলমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও সহিংসতা সম্পর্কে এলাকার সাধারণ মানুষ ওয়াকিবহাল নন। এলাকাটিতে সরকারি ও বিরোধী দলের আন্দোলনের কোনো কর্মসূচি থাকে না। সবাই খেত-খামারে দৈনন্দিন কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। এরপরও রক্ষা নেই তাদের। থানার ওসির নিছক ঘুষ বাণিজ্যের শিকার হয়ে তারা এখন হালের বলদ, গোলার ধান বিক্রয়, জমি বন্ধক এমনকি ফসলি জমি বিক্রি করে সর্বস্ব হারাচ্ছেন। এলাকার কতিপয় টাউট-বাটপারদের নিয়ে ওসি একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। ওই সিন্ডিকেটের সদস্যদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী গভীর রাতে বাড়িতে হানা দিয়ে ঘুম থেকে উঠিয়ে সাধারণ মানুষকে থানায় নিয়ে চলে নির্যাতন। মিথ্যা মামলায় জড়ানো ও পিটানোর ভয় দেখিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করা হচ্ছে। থানায় ধরে এনে মুক্তিপণের বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। এরপরও রেহাই পাচ্ছেন না অনেকে। এসব ঘটনা ফাঁস হয়ে গেলে যাতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বুঝানো যায় সেজন্য টাকা আদায় করার পরও অনেককে ৫৪ ধারায় সন্দেহজনক হিসেবে গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হচ্ছে। ধারা ৫৪ দণ্ডবিধিতে সম্প্রতি যাদেরকে আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে তারা হলেন- গত ১৫ ফেব্রুয়ারি থানার ৪২৮ নম্বর জিডিমূলে স্থানীয় পাইথল গ্রামের আলাউদ্দিনের ছেলে সেলিম মিয়া (৩২), ১৯ ফেব্রুয়ারি ৫১৪ নম্বর জিডিমূলে টাঙ্গাব গ্রামের মৃত আমজাদ আলীর ছেলে জামাল উদ্দিন (৪২), ৩ জানুয়ারি ৭২ নম্বর জিডিমূলে দ্বীপ, পাগলা গ্রামের নূর মুহাম্মদের ছেলে মজিবুর রহমান (৪৫), ৪ জানুয়ারি ১০৭ নম্বর জিডিতে লংগাইর গ্রামের রইচ উদ্দিনের দুই ছেলে সুজন (২৭) ও আরিফ (২৪), ৬ জানুয়ারি ১৪২ নম্বর জিডিমূলে বিরই গ্রামের মৃত আসন আলীর ছেলে হেলাল উদ্দিন (৫৪), ৮ জানুয়ারি ২১৭ নম্বর জিডিমূলে কান্দিপাড়া গ্রামের মৃত মনসুর আলীর ছেলে আলম হোসেন (৩৬), ১৩ জানুয়ারি ৩৩৫ নম্বর জিডিমূলে পাইথল গ্রামের আবদুল মোতালেব বাবুর্চির ছেলে সাইফুল ইসলাম লাইছু (৩৫), ১৫ জানুয়ারি ৩৯৪ নম্বর জিডিমূলে মোরশেদ আলী মণ্ডলের ছেলে ওমর ফারুক (৪২), ২৫ জানুয়ারি ৫০৩ নম্বর জিডিমূলে পাগলা গ্রামের মৃত আবুল হোসেনের ছেলে মোরশেদ মিয়া (৪৫), গোলাবাড়ির হযরত আলীর ছেলে এমরান (২২), খারুয়া বড়াইল গ্রামের আমিনুল ইসলামের ছেলে ফাহাদ (২০), রফিকুল ইসলামের ছেলে আরিফুল ইসলাম (২২), ২১ জানুয়ারি ৬৮২ নম্বর জিডিমূলে ডুবাইল গ্রামের মৃত রমজান আলীর ছেলে বজলুল করিম বজলু (৪০), ২৮ জানুয়ারি ৫৯৮ নম্বর জিডিমূলে বিরই টানপাড়ার মৃত নজর আলীর ছেলে তাফাজ্জল হোসেন (৩২), ১৮ জানুয়ারি ডুবাইল গ্রামের শহীদের ছেলে জাহাঙ্গীর (২৫), ১১০ নম্বর জিডিমূলে মাখল গ্রামের ইব্রাহিমের ছেলে সুজন মিয়া (২৫), ১৪ ডিসেম্বর ৩৮৩ নম্বর জিডিমূলে কান্দিপাড়ার মোফাজ্জল কারীর ছেলে কামরুল ইসলাম (৪২), ১১ ডিসেম্বর ২৯৫ নম্বর জিডিমূলে মুখী দরগা গ্রামের জুয়েল মিয়া (৩২), ৮ ডিসেম্বর ২০৯ নম্বর জিডিমূলে ঘাগড়া গ্রামের মৃত মজিদ ফকিরের ছেলে কাজল মিয়া (৪৫), গত বছরের ২০ নভেম্বর ৬৬৮ নম্বর জিডিমূলে দুগাছিয়া গ্রামের আফাজ উদ্দিনের ছেলে মামুন (২০), ৩ নভেম্বর ৯২ নম্বর জিডিমূলে কন্যামণ্ডল গ্রামের নুরুল ইসলাম সরকার মুক্তার ছেলে তোফাজ্জল হোসেন (৩৫), ৯ অক্টোবর ২১৩ নম্বর জিডিমূলে ওয়াদুদ মিয়া (২২), ৮ অক্টোবর ২০২ নম্বর জিডিমূলে বিরই টানপাড়ার সিরাজুল ইসলামের ছেলে রাসেল (৩৫), ২৯ অক্টোবর ৭৯৪ নম্বর জিডিমূলে সিরাজুল ইসলাম কামালের ছেলে হুমায়ুন (২২), ২৭ অক্টোবর ৭৩৫ নম্বর জিডিমূলে পাঁচুলী গ্রামের মোরশেদ মিয়ার ছেলে এমদাদুল হক (১৮), ১৫ অক্টোবর বিরই দত্তের বাজারের মৃত হাসেন আলীর ছেলে রিপন মিয়া (৪০)-সহ আরও অনেকে। ৫৪ ধারা চালান দেওয়া ময়মনসিংহ আদালত থেকে সদ্য জামিন পাওয়া ওই এলাকার স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আল আমিন বলেন, পাগলা থানার ওসি নিয়মিত মামলার আসামি গ্রেফতার করলেও তিনি মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে কৌশলে ৫৪ ধারায় আদালতে প্রেরণ করে। মশাখালী ইউনিয়নের মুখী গ্রামের যুবলীগ নেতা বাদশা মিয়া বলেন, তার ভাইয়ের ৩০ হাজার টাকা ওসি বদরুল আলম খান আত্মসাৎ করেছেন। এই টাকা চাইতে গেলে নানা ধরনের হুমকি দেন তিনি। নিগুয়ারি ইউনিয়নের কুরচাই গ্রামের মাছের ফিসারির মালিক সেলিমকে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করছে ওসি। দত্তেরবাজারের কন্যামণ্ডল গ্রামের গৃহবধূ জোছনা আক্তার জানান, তার স্বামীকে বিনা কারণে পুলিশ ধরে নেয়। পরে ওসিকে ২০ হাজার টাকা ঘুষ দিলেও থানা থেকে চুরি মামলা দিয়ে আদালতে প্রেরণ করেন ওসি। নয়াবাড়ি এলাকার কসাই মোস্তফা। তাকে ওসি ধরে থানায় নিয়ে ৩০ হাজার টাকা ঘুষ নিয়ে ছেড়ে দেয়। নিগুয়ারি এলাকার মানুষ পুলিশের অত্যাচারে বাড়িতে থাকতেই পারে না। বেলদিয়া গ্রামের আবদুল বাতেন বলেন, তিনি দুটি অভিযোগ করলেও ওসিকে ঘুষ না দেওয়ায় মামলা হচ্ছে না থানায়। হয়রানির শিকার হচ্ছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ও সমর্থকরাও। এদিকে সম্প্রতি উপজেলা দুর্নীতি দমন প্রতিরোধ কমিটির সভায় ওসির বিরুদ্ধে নিরীহদের হয়রানির বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে।
ভুক্তভোগী জোছনা বেগম জানান, আমার স্বামী আনসারুল হক পাগলা বাজারের একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। গত দুই মাস আগে আমার স্বামীকে থানার পুলিশ এসে ধরে নেয়। পরে বলে যে টাকা দিলে ছেড়ে দেবে। আমরা ২০ হাজার টাকা দিয়েছিলাম। কিন্তু আমার স্বামীকে চুরির মামলা দিয়ে কোর্টে চালান করে। পাগলা থানা যুবলীগ নেতা সাইফুল ইসলাম জানান, ১৫ দিন আগে ফিলিপস, রিয়াদ ও শিখা নামের আমার আত্মীয়কে থানায় ধরে নিয়ে যায়। পরে তাদেরকে ছেড়ে দিতে ৫০ হাজার টাকা দাবি করেন। রফাদফা করে ৪০ হাজার টাকা দিয়ে ওই তিনজনকে ছেড়ে আনি। গফরগাঁও এলাকার অটো টেম্পো সমিতির ভুক্তভোগী আবুল কালাম বাদশা বলেন, পাগলা থানার সোহেল নামের এক এএসআই এসে আমার নিকট টেম্পোস্ট্যান্ডের চাঁদা দাবি করেন। পরে থানার ওসির সঙ্গে রফাদফা করে মাসে ৩ হাজার টাকা সাব্যস্ত করি। কিন্তু পরবর্তীতে এএসআই সোহেল ৩ হাজার টাকা নিলেও অতিরিক্ত আরও ২ হাজার টাকা দাবি করেন। একপর্যায়ে ওই এএসআইর সঙ্গে বাকবিতণ্ডা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ওসি বদরুল আমাকে থানায় ডেকে নিয়ে নানা ভাষায় গালাগাল করে এবং হুমকি-দমকি দিয়ে বলে তোকে বাঁশ দেব। পরে দুই দিন পর আমার মালিকানাধীন স’মিলে এসে আমাকে থানায় নিয়ে যায়। থানায় নিয়ে অশ্লীল ভাষায় বকাঝকা দেয় এবং টর্চার করতে চেষ্টা করলে আমি এমপির দোহাই দিয়ে বেঁচে যাই। কিন্তু পরবর্তীতে আমার ছোটভাই রুবেলকে মিথ্যা একটি ঘটনা দেখিয়ে আটক করে টাকা দাবি করে। ২০ হাজার টাকা দিলেও ওসি টাকা নিয়েছেন ঠিকই। আমার ভাইকে না ছেড়ে কোর্টে চালান দেয়। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেত সফিউল বাশার মনি জানান, ওসির অপকর্ম এখন সবার জানা। যাকে খুশি তাকে আটক করে আনছেন। আবার মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ছেড়েও দিচ্ছেন। অতিরিক্ত জেলা পুলিশ সুপার (দক্ষিণ) আবু আহম্মদ আল মামুন বলেন, ওসির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের কথা পাগলা থানা এলাকার কিছু মানুষের মুখে শুনলেও কোনো লিখিত অভিযোগ পাইনি। তিনি বলেন, ডিপার্টমেন্টের পক্ষে তদন্ত করে বিষয়টি দেখা হবে। তবে ভুক্তভোগীরা লিখিত অভিযোগ দিলে সহজ হতো। ঢাকা রেঞ্জ পুলিশের ডিআইজি মো. নুরুজ্জামান পিপিএম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পাগলা থানার ওসির (বদরুল আলম খান) বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গফরগাঁওয়ের পাগলা থানার ওসি বদরুল আলম খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ মিথ্যা। আমার বিরুদ্ধে এলাকার কিছু লোকজন শত্রুতা করছেন।

সর্বশেষ খবর