শিরোনাম
রবিবার, ২৪ মে, ২০১৫ ০০:০০ টা
চাঞ্চল্যকর সেসব খুন (১৭)

‘খুনির হাত’ খুলে দিয়েছিল সালেহা হত্যা রহস্য

‘খুনির হাত’ খুলে দিয়েছিল সালেহা হত্যা রহস্য

দুবারের ময়নাতদন্তেই মৃত্যুর কারণ আত্মহত্যা বলে প্রতিবেদন দেওয়া হলো, তৃতীয়বারে ভিন্ন কথা। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, নিহতের গলা ও শরীরে যেসব স্থানে ধারালো ব্লেডের আঘাত রয়েছে তা নিজের হাতে করা সম্ভব নয়। শরীরে সূক্ষ্মভাবে যে পোচ দেওয়া হয়েছে তা কিছুটা বাঁকাভাবে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। খুনি যেই হোক বাম হাত ব্যবহার করেছে। এই প্রতিবেদনের পর পুলিশি তদন্তে নতুন মোড় নেয়। পুলিশ বাম হাতের বিষয়টি মাথায় রেখে তদন্ত করে। আবিষ্কার করে খুনি তাদের সামনেই রয়েছে। কারণ হতভাগ্য ওই মহিলার স্বামী একজন বাঁ-হাতি।
১৯৭৮ সালে দেশ কাঁপানো চাঞ্চল্যকর সালেহা খুনের ঘটনা এটি। রাজধানীর মালিবাগে সালেহাকে নৃশংসভাবে খুন করেন তার চিকিৎসক স্বামী ইকবাল। খুনের দায় থেকে ডা. ইকবাল নিজেকে রক্ষার চেষ্টা করেছেন বার বার। পারেননি। সালেহা খুনের পর সারা দেশের মানুষ প্রতিবাদ করেছে। ফাঁসির দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমেছে। পত্রপত্রিকাগুলোতে এ নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। পরে ফাঁসি হয় ডা. ইকবালের। আদালতে বলা হয়, গৃহপরিচারিকার সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কের পরিণতিতে ডা. ইকবাল খুন করেন তার স্ত্রীকে। আদালতে আরও অভিযোগ করা হয়, যৌতুক আদায়ের জন্য ডা. ইকবাল নির্যাতন করতেন সালেহাকে। বিচারে ডা. ইকবালের মৃত্যুদণ্ড হয়। ১৯৮৭ সালে সেই দণ্ড কার্যকর করা হয়। এই মৃত্যুদণ্ড তখন খুব আলোচিত হয়েছিল। কারণ স্বাধীন বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত সমাজের কোনো ব্যক্তির ফাঁসি হওয়ার ঘটনা ছিল ওটাই প্রথম। যৌতুকের নির্মমতার ইতিহাসে সালেহা ও তার স্বামী ডা. ইকবালের নাম মনে পড়লে আজও মানুষের অনুভূতি ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। সালেহার মৃত্যুর পর সামাজিক সোচ্চারের কারণে ১৯৮০ সালে যৌতুকবিরোধী আইন প্রণীত হয়। তৎকালীন সময়ে সালেহা হত্যাকাণ্ড ও বিচার প্রক্রিয়া খুব কাছ থেকে দেখেছেন এবং এসব নিয়ে পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রতিবেদন লিখেছেন, এমন সাংবাদিকদের মধ্যে বশির আহমেদ অন্যতম। তিনি বলেন, ওই সময়ে সালেহা হত্যাকাণ্ডটি ছিল টক অব দ্য কান্ট্রি। অত্যন্ত চাঞ্চল্যকর ঘটনা। পত্রিকায় তাদের অনুসন্ধানীমূলক প্রতিবেদন না হলে হয়তো সালেহা খুনের ঘটনাটি প্রকাশ পেত না। অপমৃত্যু হিসেবেই থাকত। পত্রিকায় প্রতিবেদন হওয়ার কারণেই দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্ত হয়। যাতে খুনের ঘটনাটি প্রকাশ পায়। তিনি আরও বলেন, ইকবালের পরিবার তাদের ওপর এমন ক্ষুব্ধ হয়েছিল যে, ফাঁসির রায় কার্যকরের পর ইকবালের বাসায় গেলে সাংবাদিকদের দা নিয়ে ধাওয়া করেছিল ইকবালের স্বজনরা। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ধনী ব্যবসায়ী পরিবারের সাত ভাইয়ের এক বোন ছিলেন সালেহা। সালেহার ধনাঢ্য বাবা মেয়ের শিক্ষার্জনের বিষয়টিকে খুব একটা পাত্তা দেননি। তিনি বিত্তবান ছিলেন। ভেবেছিলেন বিত্তের জোরেই মেয়েকে ভালো একটা পাত্রের হাতে তুলে দেবেন। আর সে লক্ষ্যেই মেয়েকে সুখী করার সঠিক উপায় হিসেবে শিক্ষিত জামাই খুঁজতে শুরু করলেন। পেয়েও গেলেন। মেয়ের সুখের গ্যারান্টির জন্য সালেহার বাবা নিজের টাকায় ইকবালকে ডাক্তারি পাস করান। সূত্র মতে, বিয়ের সময় প্রচুর যৌতুকের সঙ্গে ইকবালকে হলুদ রঙের একটি ডাটসান ১৩০ প্রাইভেটকার দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তার পরের ঘটনা বড়ই মর্মান্তিক। ডা. ইকবালের দৃষ্টি ছিল পরনারীতে। অনৈতিক কাজের বিরোধিতা করেছিলেন সালেহা। প্রতিবাদ করেছিলেন স্বামীর দুশ্চরিত্রের বিরুদ্ধে। একদিন কাজের মেয়ের সঙ্গে এক লজ্জাকর পরিস্থিতিতে ধরা পড়ে যান সালেহার কাছে। প্রতিবাদ করতেই ডা. ইকবাল দরজার ডাসা দিয়ে সালেহার মাথায় আঘাত করে। মারা যান সালেহা। এরপর ধারালো ব্লেড দিয়ে তাকে জবাই করে ইকবাল প্রচার চালায় সালেহা আত্মহত্যা করেছে। লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়। সেখানে লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। ডা. ইকবাল ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক। ময়নাতদন্তকারী ডাক্তার তার বন্ধু। আগে থেকে সবকিছু তারা ঠিক করে রেখেছিল। তাই সালেহার ময়নাতদন্ত করা ছিল শুধু আনুষ্ঠানিকতা। ডাক্তাররা বললেন, সালেহা আত্মহত্যাই করেছে। এটি কোনো হত্যাকাণ্ড নয়। লাশের দাফন হয়। কিন্তু সাংবাদিকদের কাছে ঘটনাটি অত্যন্ত সন্দেহজনক মনে হতে থাকে। সন্দেহ হয় বিদেশে অবস্থানরত সালেহার এক ভাইয়ের। পত্রিকায় অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ হতে থাকে। সালেহার পরিবার আবারও ময়নাতদন্তের অনুরোধ জানান। দ্বিতীয় দফায় ময়নাতদন্ত হয়। সেখানে আবারও মৃত্যুর কারণ আত্মহত্যা বলা হয়। তৃতীয়বার আবারও ময়নাতদন্তের আবেদন জানানো হলে তা গ্রহণ হয় না। কিন্তু অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার পরিবারের সঙ্গে তখন সালেহার পরিবারের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। যে কারণে আবারও ময়নাতদন্ত করার আবেদনটি গ্রহণ করার ব্যবস্থা হয়। কবর থেকে লাশ উত্তোলন করে এবার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মর্গে ময়নাতদন্ত হয়। তিন সদস্যের একটি বোর্ড ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করে। এবার বেরিয়ে আসে আসল রহস্য। প্রতিবেদনে বলা হয়, এটি হত্যা। মাথায় আঘাত করেই সালেহাকে হত্যার পর গলায় পোঁচ দেওয়া হয়েছে।

 

সর্বশেষ খবর