বুধবার, ২৭ মে, ২০১৫ ০০:০০ টা
চাঞ্চল্যকর সেসব খুন (২০)

তিব্বতকে হত্যা করেই খুনি আশ্রয় নিল থানায়

তিব্বতকে হত্যা করেই খুনি আশ্রয় নিল থানায়

ঘড়িতে তখন রাত ২টা। টিউব লাইটের ক্ষীণ আলো রাস্তায় অদ্ভুত এক আলো-আঁধারির পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। যান চলাচল খুব একটা নেই। বিক্ষিপ্তভাবে রিকশার টুংটাং বেলের শব্দ। হঠাৎ রাস্তার এক পাশে চিৎকার-চেঁচামেচি। বেশকিছু যুবক জটলা করে আছেন। তাদের হাতে রামদা, চাপাতি, হকিস্টিক, রড। জটলার মাঝে থেকে খালি হাতে তাদের সঙ্গে লড়াই করছিলেন এক যুবক। জুডো-কারাটে পারদর্শী ওই যুবক দু-তিন জনকে কাবুও করে ফেলেছিলেন। কিন্তু বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি। রামদা আর হকিস্টিকের এলোপাতাড়ি আঘাতে একসময় রাস্তার ওপর লুটিয়ে পড়েন যুবকটি। কখন যে তার হৃদস্পন্দন থেমে গেছে, কেউ বলতেও পারে না।
পুরান ঢাকার প্রবল ক্ষমতাধর ও তুমুল জনপ্রিয় ছাত্রনেতা তিব্বত খুনের ঘটনা এটি। ৩২ বছর আগে ঠিক এভাবেই প্রতিপক্ষ গ্রুপের সশস্ত্র ব্যক্তিদের হাতে নির্মম খুনের শিকার হয়েছিলেন জগন্নাথের এই তিব্বত। পুরান ঢাকার ইংলিশ রোডের পতিতালয়ের গেটে ৪০ জনের সশস্ত্র গ্রুপের সঙ্গে একাই লড়ে ছিলেন। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও প্রাণ রক্ষায় কোনো আকুতি-মিনতি করেননি তিব্বত। ১৯৮৩ সালের নভেম্বরে সংঘটিত তিব্বত হত্যা ছিল তখন দেশের একটি আলোচিত ঘটনা। সরকার সমর্থিত ‘নতুন বাংলা ছাত্র সমাজ’-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও ক্ষমতাধর একজন ছাত্রনেতা এভাবে নির্মম খুনের শিকার হওয়ার পর পুরান ঢাকা উত্তাল হয়ে ওঠে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। বড় ধরনের প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কায় ছিল খুনি চক্র। তাই হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েই খুনি চক্রের হোতা আতাউর রহমান বাদল দৌড়ে কোতোয়ালি থানায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কারণ ওই থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছিলেন বাদলের ভগ্নিপতি। তিব্বত পুরান ঢাকায় এতটাই জনপ্রিয় ছিলেন যে তার উপরে কথা বলার মতো তখন কারও সাহস ছিল না। পুরান ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল£ ছিল তার নিয়ন্ত্রণে। একই বছর তিব্বতকে গ্রেফতারের পর সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা পুলিশ পদক পেয়েছিলেন। তিব্বত খুনের পর অনেকেই তখন বিশ্বাস করতে চাচ্ছিলেন না যে পুরান ঢাকায় তিব্বতকে কেউ খুন করতে পারেন। এ কারণে খুনের পরিকল্পনায় তিব্বতের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, সহযোগী ছাড়াও ইংলিশ রোডের পতিতালয়ের অনেককেই যুক্ত করা হয়েছিল। এ ছাড়াও তিব্বত খুনের সঙ্গে পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করে পুরান ঢাকার একটি ব্যবসায়ী মহল। রাজনীতির মাঠ নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রতিযোগিতা তো ছিলই। আর এসব কারণে সর্বাÍক পরিকল্পিত খুনের ঘটনা হিসেবে এটি হয়ে ওঠে আলোচিত। জনপ্রিয় এই ছাত্রনেতা হত্যার বিচার হয়েছিল। বিচারে অন্যতম খুনি আতাউর রহমান বাদলের মৃত্যুদণ্ড হয়। কিন্তু এরশাদ সরকার বাদলকে সাধারণ ক্ষমার আদেশ দেয়। জেলখানা থেকে বেরিয়ে যান বাদল। তিব্বতের পরিবার এ নিয়ে হতাশ। তারা বলেছেন, জাতীয় ছাত্রসমাজের কেন্দ্রীয় সদস্য ছিলেন তিব্বত। আর এই তিব্বতের খুনের আসামিকে এরশাদ সরকারই ক্ষমা করে দিল। উল্লেখ্য, তিব্বতের ছোট ভাই আলমগীর শিকদার লোটন জাতীয় পার্টির যুগ্ম মহাসচিব।
তিব্বতের পুরো নাম শিকদার আনোয়ার সাদাত। বাবা ডা. সাদাত আলী শিকদার ১৯৭০ ও ‘৭৩ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিটে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে দ্বিতীয় ছিলেন তিব্বত। অত্যন্ত সচ্ছল পরিবারের ছেলে তিব্বত ’৭৭ সালে কলেজিয়েট স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হন। জগন্নাথ কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে থাকা অবস্থায় পুলিশ একবার তিব্বতকে পায়ে গুলি করে গ্রেফতার করে। একটি মামলায় দীর্ঘ তিন মাস তিব্বত মেডিকেলে ছিলেন চিকিৎসার জন্য। তারপর জামিনে বেরিয়ে আসেন এবং এক পর্যায়ে মামলা খারিজ হয়ে যায়। জানা গেছে, জগন্নাথ কলেজের অবস্থান পুরান ঢাকার ‘হৃদয়ে’ হওয়ায় সে সময় এই কলেজের রাজনীতি পুরান ঢাকার রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করত। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে জগন্নাথ কলেজে ছাত্র ভর্তির ক্ষেত্রে নীতিমালা ছিল না। সেখানে ‘ছাত্র ভর্তি’ বিভিন্ন কোটাওয়ারিতে রাজনৈতিক দলের ভিতর বিতরণ করা হয়। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের আগে জগন্নাথ কলেজে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ও জাসদ ছাত্রলীগ খুব শক্তিশালী ছিল। ‘৭৯ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর তিব্বত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ভর্তি হন। এক বছর ক্লাস করলেও জগন্নাথ কলেজের ছাত্র রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে পারছিলেন না। এ কারণে তিনি ফিরে যান জগন্নাথে। ভর্তি হন পাসকোর্সে। এবার জগন্নাথ কলেজে শুরু হয় তার দ্বিতীয় পর্যায়ের পলিটিক্যাল ক্যারিয়ার। ‘৮২ সালের জাতীয় রাজনীতির পট পরিবর্তনের পর তিব্বতের রাজনীতিও পরিবর্তিত হয়। নতুন বাংলা ছাত্র সমাজের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন তিব্বত।
জানা গেছে, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে জগন্নাথ কলেজের তৎকালীন ভিপি সগীরের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যায়। তিনি সরে দাঁড়ান। লাইম লাইটে আসেন তিব্বত। অন্যদিকে লাইম লাইটে আসেন জিএস হালিম। দুজন মুখোমুখি এসে দাঁড়ান। তিব্বত হত্যাকাণ্ডটি যে পুরোপুুরি রাজনৈতিক তা সেই সময়ে পুলিশ স্বীকার করেনি। খুনি চক্রকে সহায়তা করতেই পুলিশের এ অবস্থান ছিল বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। সূত্র জানায়, হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েই তিব্বত খুনের প্রধান আসামি বাদল সোজা কোতোয়ালি থানায় গিয়ে আশ্রয় নেন। তখনকার ওই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বাদলের ভগ্নিপতি ছিলেন। তিব্বত খুনের পর পুরান ঢাকার একটি ব্যবসায়ী মহল কোতোয়ালি থানাকে ৬ লাখ টাকা দিয়ে খুশি করে। তিব্বত খুনের ঘটনাটি যে পরিকল্পিত ছিল তা সেই সময়ে গোয়েন্দা পুলিশের তদন্তেও বেরিয়ে আসে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ৮ নভেম্বর কয়েকজন বন্ধু মিলে তিব্বতকে নিয়ে যান সদরঘাটে। সেখানে তিব্বতকে তারা মদপান করান। তাকে নিয়ে যান ইংলিশ রোড ১২ নম্বর কুমারটুলির পতিতালয়ে। সেখানে তিব্বতের বন্ধুরা সন্ধ্যা ও কোহিনুর নামে দুই পতিতার সঙ্গে ঝামেলা করেন। পরে তারা পতিতালয় থেকে বেরিয়ে গেটের কাছে আসেন। গেটের বাইরে আগে থেকেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলেন বাদলের নেতৃত্বে ৪০ জন যুবক। রাত ২টার দিকে পতিতালয়ের গেটে আসেন তিব্বত। তখনই তার ওপর হামলা শুরু হয়। তিব্বত ছিলেন জুডো-কারাটের ব্ল্যাকবেল্ট হোল্ডার। তিনি এ সময় প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়াই করতে থাকেন। তার সহযোগীদের এ সময় দেখা মেলেনি। তারা প্রত্যেকেই তখন কেটে পড়েছিলেন। ১০ মিনিট ধরে লড়াইয়ের পর রক্তাক্ত তিব্বত রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন। সেখানেই তার মৃত্যু ঘটে। সূত্র জানায়, সদরঘাট থেকে শুরু করে পতিতালয় পর্যন্ত বিষয়গুলো তিব্বত হত্যার পরিকল্পনার অংশ। তার কাছের লোকজনকে হত্যাকাণ্ডে যুক্ত করা না গেলে তাকে হত্যা করা খুব কঠিন হতো।

সর্বশেষ খবর