রবিবার, ৩১ মে, ২০১৫ ০০:০০ টা

পকেট কাটার কারসাজি

পকেট কাটার কারসাজি

ওষুধ ব্যবসায় মুনাফার হার কত? এ নিয়ে বিভিন্ন রকম হিসাব রয়েছে ব্যবসায়ীদের মধ্যে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নতুন ব্যবসায়ীদের সাধারণত গড় লাভ থাকে ১০-১২ শতাংশ, আর পুরনোদের ৩০-৩৫ শতাংশ। অদ্ভুত এই হিসাব ওষুধ ব্যবসায়ীদের নিজেদের। পুরনো ফার্মেসি মালিকদের অনেকেই মুনাফার কারসাজিতে অভিজ্ঞ। সে কারণে সাধারণ মানুষের ‘পকেট কাটার’ নানা কৌশল অবলম্বন করে লাভও করতে পারছেন বেশি। অন্যদিকে, লোকসানের কারণে ওষুধের দোকান বন্ধ হয়ে গেছে এমন নজির খুব কম। বরং দেশে নিয়মিত বাড়ছে ওষুধের দোকান। ওষুধ প্রশাসনের কার্যকর তদারকির অভাবে রাজধানীসহ সারা দেশে লাইসেন্স ছাড়াই গড়ে উঠেছে অসংখ্য ফার্মেসি। ওষুধ বিক্রির পর টাকা দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় অনেকটা অল্প পুঁজিতেও ব্যবসা করতে পারছে ফার্মেসিগুলো। এ কারণে দেশের জনবহুল এলাকাগুলোতে খুব সহজেই গড়ে উঠছে নতুন নতুন ফার্মেসি। নিয়ন্ত্রক সংস্থা ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের লাইসেন্সধারী ওষুধের দোকান এক লাখ ১৫ হাজারের কিছু বেশি। কিন্তু লাইসেন্সবিহীন মিলিয়ে মোট দোকানের সংখ্যা চার লাখেরও বেশি বলে বিভিন্ন সূত্র জানায়। রাজধানীর কয়েকজন ফার্মেসি ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ওষুধ ব্যবসায় লাভ লোকসান নির্ভর করে অভিজ্ঞতার ওপর। নতুন ব্যবসায়ীদের লাভ থাকে ১০-১২ শতাংশ, আর পুরনোদের গড়ে ৩০-৩৫ শতাংশ। পুরনো ব্যবসায়ীদের অধিকাংশই ‘বুদ্ধি’ খাটিয়ে পাল্টে দেন মুনাফার চিত্র। যেমন, ব্যথানাশক ‘রোলাক’ প্রতি পাতা কেনা হয় ৮৮ টাকায়, বিক্রি ১০০ টাকা। আরেকটি কোম্পানির ‘কেটো রোলাক’ প্রতি পাতা ৪ টাকা, এটিও বিক্রি হয় ১০০ টাকায়। ৪ টাকায় যে ওষুধটি বিক্রি করা হচ্ছে, সেই কোম্পানিও লাভ করেই বিক্রি করেছে। কাছাকাছি নামের এ ওষুধটি অনেক ফার্মেসি মালিক ক্রেতাদের অসচেতনতার সুযোগে গছিয়ে দিচ্ছেন। মুনাফা করছেন কয়েকগুণ। কিন্তু অসুস্থতায় আরোগ্যের আশায় সেবন করলেও রোগীর সমস্যা কাটে না। জানা গেছে, ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে কোনো ফার্মেসিতে ‘রোলাক’ কিনতে চাইলে এক সঙ্গে রাখা ‘কেটো রোলাক’ গছিয়ে দেওয়া হয়। খুচরা কিনতে চাইলে কেচি দিয়ে এমনভাবে কাটা হয় যাতে শুধু ‘রোলাক’ লেখাটি চোখে পড়ে। এক্ষেত্রে শিক্ষিত মানুষের পক্ষেও কারসাজি ধরা সম্ভব নয়। ফার্মেসি কর্মীদের কারসাজিতে ২ টাকার ওষুধ কিনতে হচ্ছে ৫০ টাকায়। কিন্তু এর কার্যকারিতা পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যথা উপশমের আরও একটি ওষুধ রকেট। খুচরা বাজারে ১০টির প্রতি পাতার দাম ১০০ টাকা। প্রায় একই রকম দেখতে অন্য একটি ওষুধ ডমপ। এটির প্রতি পাতার দাম মাত্র ১০ টাকা। এক সঙ্গে বেশি কিনলে আরও অনেক কমে পাওয়া যায়। দুটি ওষুধের মোড়ক দেখে পার্থক্য করা কঠিন। কিন্তু একটির বদলে অন্যটি ক্রেতাকে গছিয়ে দিলে মুনাফা পাওয়া যায় চার-পাঁচগুণ। এটা রাজধানীর ফার্মেসিগুলোর চিত্র। মফস্বলের ওষুধের দোকানগুলোর অবস্থা আরও ভয়াবহ। সেখানে নকল, ভেজাল ও নিুমানের ওষুধের ছড়াছড়ি। তদারকির কোনো ব্যবস্থাই নেই। ওষুধ বিক্রি এক সময় ‘অভিজাত ব্যবসা’ হিসেবে স্বীকৃত পেলেও এখন তা নেই। ভোক্তাদের প্রয়োজন আর চাহিদা বুঝে ফার্মেসি মালিকদের অনেকে প্রায় নিয়মিতই ওষুধের অযৌক্তিক দাম আদায় করছেন। বিশেষ করে মৌসুমি অসুখ-বিসুখে যেসব ওষুধের চাহিদা বেশি সেগুলোর দাম দোকানে দোকানে তারতম্য হয়। হৃদরোগ, ক্যান্সারসহ জটিল শারীরিক সমস্যায় ব্যবহৃত বিদেশি উচ্চমূল্যের ওষুধের দাম রাখা হয় যথেচ্ছ হারে। কোনো কোনো ওষুধের দাম আমদানি মূল্যের তিন-চারগুণ। শুষ্ক মৌসুমে অ্যাজমার প্রকোপ বেড়ে গেলে ইনহেলারের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বেশি দাম রাখা হয়। এদিকে কোম্পানিগুলোর মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতার কারণে ওষুধ বিপণন এখন ‘মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ’ নির্ভর হয়ে পড়েছে। মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভরা দোকানিকে বিভিন্নভাবে প্রলুব্ধ করে নিজেদের ওষুধ বাজারজাত করতে তৎপর থাকে। ফলে বাকিতে ওষুধ রেখে বিক্রি করে টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকছে। এ জন্য কম পুঁজিতেও ওষুধের ব্যবসা জমিয়ে তোলা যায়। এসব কারণে সারা দেশে ফার্মেসির সংখ্যা বাড়ছে। গত এপ্রিলে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের প্রকাশিত ২০১৪ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, সারা দেশে মোট ড্রাগ লাইসেন্সপ্রাপ্ত ফার্মেসি এক লাখ ১৫ হাজার ৪৩৯টি, এর মধ্যে ঢাকা জেলায় ১১ হাজার ছয়টি।
 গত বছর নবায়ন করা হয়েছে ২৭ হাজার ৮৭৫ ড্রাগ লাইসেন্স, এর মধ্যে ঢাকা জেলায় দুই হাজার ৭৪টি। এই সময়ে নতুন ড্রাগ লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে ১১ হাজার ৮২৯টি। ঢাকায়ই এক হাজার ৮৮০টি।
জানা যায়, জনবল সংকটের কারণে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর কার্যকর মনিটরিং করতে পারে না। তবে তাদের দাবি, গত বছর সারা দেশে ৪৯ হাজার ৮১৪টি ওষুধের দোকান পরিদর্শন করা হয়েছে। সূত্রমতে, দেশে ড্রাগ লাইসেন্স ছাড়া প্রায় চারগুণ দোকানের বিষয়টি ওষুধ বিপণন খাতে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। লাইসেন্স পেতে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনেকেই লাইসেন্স নিতে আগ্রহী নয়। তা ছাড়া লাইসেন্স ফি ২৫০০ টাকা হলেও ১০-১২ হাজার টাকার কমে তা পাওয়ার সুযোগ নেই। ওষুধ প্রশাসনের ড্রাগ সুপার থেকে শুরু করে ঘাটে ঘাটে দিতে হয় টাকা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, ‘অবৈধ ওষুধের দোকানগুলো নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। শুধু ঢাকা শহরেই অনেক দোকান রয়েছে, যেগুলোর লাইসেন্স নেই। ওষুধ প্রশাসন শুধু ঢাকাতেই জরিপ চালালে কী পরিমাণ অবৈধ ফার্মেসি রয়েছে, সেটা চিহ্নিত হবে।’

সর্বশেষ খবর