মঙ্গলবার, ১৬ জুন, ২০১৫ ০০:০০ টা

বছর শেষে অর্থ ভাগাভাগি

উপজেলা পরিষদকে ১৯৫ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ, ব্যয় করতে হবে ১৫ দিনের মধ্যে লুটপাটের আশঙ্কা

২০১৪-১৫ অর্থবছরের একেবারে শেষ প্রান্তে এসে বিশেষ উন্নয়নের নামে সারা দেশের উপজেলা পরিষদগুলোর বিপরীতে ১৯৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। রবিবার (১৪ জুন) বিকালে এ সংক্রান্ত সরকারি আদেশ জারি করা হয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগের উপজেলা শাখা-২ থেকে। ওই আদেশে ৩০ জুনের মধ্যেই বরাদ্দকৃত এ অর্থ ব্যয় করার শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। তবে বরাদ্দৃকত এ অর্থের সঠিক ব্যবহার নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে। অনেকেই বলছেন, উপজেলা পরিষদকে বরাদ্দ দেওয়া এ টাকার বড় অংশই লুটপাট হয়ে যাবে। অনেকটা টিআর-কাবিখা প্রকল্পের মতোই দলীয় নেতা-কর্মীদের পকেটে যাবে পুরো অর্থ। আর এতে সরকারের উন্নয়ন উদ্দেশ্য পুরোপুরি ব্যর্থ হবে।
এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এটা একটা তুঘলকি কর্মকাণ্ড। কারণ আমাদের দেশে প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার যে গতি এবং বাস্তবায়নকারীদের যে ধরনের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা তার মাপকাঠিতে এত অল্প সময়ের মধ্যে তা সুষ্ঠুভাবে, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সঙ্গে বাস্তবায়নের সম্ভাবনা অবাস্তব। এক্ষেত্রে ঝুঁকিটা হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম বিশেষ করে সরকারি খাতে প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের যে মাপকাঠি রয়েছে এগুলো লঙ্ঘনের সম্ভাবনাই বেশি। ফলে এর সঙ্গে যারা জড়িত হবেন তাদের অন্তত একাংশের ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত স্বার্থ হাসিলের ঝুঁকি সৃষ্টি হবে। তিনি বলেন, সরকারের  উচিত হবে অর্থবছরের শেষ দিকে এসে ও বর্ষা মৌসুমে এ ধরনের বিশেষ থোক বরাদ্দ পরিহার করা। যদি দিতেই হবে তাহলে সুনির্দিষ্ট খাত ও প্রকল্প বাস্তবায়নের মাপকাঠি নিশ্চিত করে অগ্রসর হওয়া উচিত।  
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশের অনগ্রসর উপজেলা পরিষদ বিশেষ করে যেসব উপজেলায় দারিদ্র্য চরম পর্যায়ে, এখনো বিদ্যুৎবিহীন, শিক্ষাদীক্ষায় পিছিয়ে রয়েছে, স্যানিটেশন, পয়ঃনিষ্কাশন, খাবার পানির সংকট রয়েছে এমন উপজেলাগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে সরকার ২০১৪-১৫ অর্র্থবছরের বিশেষ থোক বরাদ্দ থেকে ১৯৫ কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দ দিয়েছে। এর মধ্যে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রীর বিশেষ খাত থেকে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে ৫৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা। সূত্র জানায়, এ বরাদ্দ থেকে সারা দেশের অনগ্রসর ৫৫টি উপজেলা পরিষদকে দেওয়া হচ্ছে ৪৮ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। সব উপজেলায় সাধারণ বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে ১২৩ কোটি ২৭ লাখ টাকা, অপ্রত্যাশিত খাতে ৫০টি উপজেলাকে দেওয়া হচ্ছে ৯ কোটি ৭৫ লাখ টাকা এবং চলমান প্রকল্পের খাতে ১৫টি উপজেলাকে দেওয়া হয়েছে ৯ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।
জানা গেছে, চলমান প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সারা দেশের সাতটি জেলার ১৫টি উপজেলাকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৯ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে নওগাঁর আত্রাই ও রাণীনগর, পাবনার সাঁথিয়া, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ, কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী, মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলা পরিষদ পেয়েছে ৫০ লাখ টাকা করে। পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলা পেয়েছে ৩৫ লাখ টাকা। কিশোরগঞ্জের সদর, হোসেনপুর, ইটনা, মিঠাইমন ও অষ্টগ্রাম উপজেলা পরিষদের অনুকূলে বরাদ্দ গেছে এক কোটি টাকা করে। গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলা পেয়েছে ৬০ লাখ টাকা এবং সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলাকে দেওয়া হয়েছে ৪০ লাখ টাকা।
একইভাবে অনগ্রসর উপজেলার জন্য বরাদ্দ দেওয়া ৪৮ কোটি ৭৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে ১২টি জেলার ৫৫টি উপজেলাকে। এগুলো হচ্ছে- কোটালীপাড়া, টুঙ্গিপাড়া, গোপালগঞ্জ সদর, মুকছেদপুর, হরিরামপুর, সিঙ্গাইর, কালিয়াকৈর, কাপাসিয়া, নড়িয়া, জাজিরা, গোসারঘাট, হাইমচর, মতলব উত্তর, কোম্পানীগঞ্জ, হাতিয়া, চকরিয়া, সাতকানিয়া, কুমিল্লা সদর দক্ষিণ, আদর্শ সদর, নাঙ্গলকোট, সখিপুর, ধনবাড়ী সদর, মধুপুর, গোপালপুর, ভুয়াপুর, পাঠগ্রাম, লালমনিরহাট সদর, কালিগঞ্জ, কালিয়া, পাইকগাছা, কয়রা, মোল্লাহাট, শরণখোলা, বানারীপাড়া, মুলাদী, গৌরনদী, আগৈলঝাড়া, বাকেরগঞ্জ, হিজলা, বরিশাল সদর, মেহেন্দীগঞ্জ, রাঙ্গাবালী, গলাচিপা, দশমিনা, দুমকি, কলাপাড়া, ভাণ্ডারিয়া, শেরপুর সদর, বেলকুচি, তাড়াশ, উল্লাপাড়া, কাজীপুর, নাটোর সদর ও নওগাঁ সদর। এ উপজেলাগুলোকে দেওয়া হয়েছে সর্বনিু ৩০ লাখ টাকা থেকে তিন কোটি টাকা পর্যন্ত। এর মধ্যে তিন কোটি টাকা পেয়েছে কোটালীপাড়া উপজেলা। দুই কোটি টাকা করে পেয়েছে ছয়টি উপজেলা। এক কোটি টাকা করে পেয়েছে ১৯টি উপজেলা পরিষদ। সূত্র জানায়, উপজেলা পরিষদের আওতায় বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য ২০১৪-১৫ অর্থবছরে উন্নয়ন বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। কিন্তু সারা বছর অতিবাহিত হলেও আগে এ টাকা না দিয়ে অর্থবছরের একেবারে শেষ প্রান্তে এসে জুন মাসে মোটা অংকের এ টাকা বরাদ্দ দেওয়ায় এর উদ্দেশ্য নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন উঠেছে। স্বল্প সময়ের মধ্যে এ পরিমাণ টাকার সঠিক ব্যবহার হবে না বলেই মনে করছেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ এবং সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যানরা। একজন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান বলেন, সরকার মহৎ উদ্দেশ্য নিয়েই এ টাকা উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ দিয়েছে। কিন্তু এ টাকার পুরোটাই নয়-ছয় হবে। কারণ ৩০ জুনের মধ্যেই এ টাকা ব্যয় করতে হবে এবং আগামী ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রকৌশলী, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের যৌথ স্বাক্ষরযুক্ত বাস্তবায়িত ও সমাপ্ত প্রকল্পের প্রতিবেদন স্থানীয় সরকার বিভাগে পাঠাতে হবে। যা কোনোভাবেই মাত্র ১৬ দিনের মধ্যে বাস্তবায়িত করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, অধিকাংশ উপজেলাই এই ৩০ জুনের মধ্যে টাকা উত্তোলন করতে গিয়ে নানা রকম অনিয়মের আশ্রয় নেবে। তিনি জানান, কিন্তু ২০০৮ সালের পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস (পিপিআর) অনুযায়ী কোনোভাবেই বরাদ্দকৃত এ অর্থ ব্যয় করা সম্ভব নয়। আর এ কাজের কোনো মনিটরিংও হবে না। ফলে এ অর্থের সঠিক ব্যবহার হবে না।

স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বিশেষ থোক বরাদ্দ থেকে দেওয়া এ বরাদ্দের আদেশে যেসব শর্ত উল্লেখ করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে প্রচলিত সরকারি বিধান ও উপজেলা পরিষদ উন্নয়ন তহবিল ব্যবহার নির্দেশিকা অনুসরণ করে উপজেলা পর্যায়ে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ বাস্তবায়নে মঞ্জুরিকৃত এ বরাদ্দের অর্থ ব্যয় করা যাবে। কিন্তু উপজেলা পরিষদ উন্নয়ন তহবিল ব্যবহার নির্দেশিকা অনুযায়ী উপজেলা পরিষদ কোনো রকম টেন্ডার বা দরপত্র ছাড়া ১৬টি প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে পারে। যা ইতিমধ্যে দেশের সব উপজেলা পরিষদ করেছে। এখন যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে সেটির অর্থ ব্যয় করতে হলে উপজেলা পরিষদকে পিপিআর অনুযায়ী অবশ্যই প্রকল্প গ্রহণ করে টেন্ডারের মাধ্যমে উন্নয়ন কাজে যেতে হবে। কিন্তু সে সময় তাদের হাতে নেই। কারণ ৩০ জুনের মধ্যেই অর্থ উত্তোলন ও ব্যয় করতে হবে।
একটি সূত্র জানায়, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে প্রাক-বাজেট আলোচনায় চেয়ারম্যানরা উপজেলা পরিষদের জন্য কমপক্ষে পাঁচ কোটি টাকা বিশেষ উন্নয়ন বরাদ্দ রাখার দাবি জানিয়েছিলেন। সেই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এসে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এ বিশেষ বরাদ্দের ছাড়পত্র পাওয়া গেছে। কিন্তু অর্থবছরের শেষ মাসে এসে এ বরাদ্দ দেওয়ায় নানা প্রশ্ন উঠেছে।

সর্বশেষ খবর