মঙ্গলবার, ১৬ জুন, ২০১৫ ০০:০০ টা

‘ডিজিটাল রোগে’ আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা

গেইম ফেসবুক চ্যাটসহ বিভিন্ন পর্নো সাইটেও তাদের বিচরণ

ডিজিটাল মাধ্যমে আসক্ত হয়ে পড়ছে শিশুরা। অবাধে বিচরণ করছে সাইবার জগতে। দিনভর টিভি সেটের সামনে আসন গেড়ে বসে থাকছে তারা। গেইম, ফেসবুক, চ্যাট থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্নো সাইটেও ঢুকে পড়ছে শিশুরা। এতে করে একদিকে যেমন শিশুর মানসিক বিকৃতি ঘটছে, অন্যদিকে বাড়ছে পারিবারিক ও সামাজিক দূরত্ব। ব্যাহত হচ্ছে শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ। এ প্রসঙ্গে ঢাকা শিশু হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ হানিফ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, তিন বছরের শিশুকে কোনোভাবেই ইলেকট্রনিক ডিভাইস দেওয়া উচিত নয়। এতে করে শিশুর পারিবারিক বন্ধন এমনকি নিজের মায়ের সঙ্গেও দূরত্ব বাড়ছে। নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় ভুগছে শিশুরা। ইন্টারনেট কিংবা টেলিভিশনে দ্রুতগতির চিত্র- খেলা, বিজ্ঞাপন বা কার্টুন অজান্তেই শিশুর মানসিক অস্থিরতা তৈরি করছে, চোখের ক্ষতি করছে। এ ক্ষেত্রে করণীয় কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শিশু কী দেখতে পারবে, আর কী পারবে না সে বিষয়ে একটি প্রপার গাইডলাইন বা পলিসি তৈরি অপরিহার্য।’ জানা গেছে, প্রাত্যহিক কাজের বাইরে শিশুরা দিনভর পড়ে থাকে ইলেকট্রনিক খেলনা, মোবাইল, টেলিভিশন, ভিডিও গেমস, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ট্যাব কিংবা যে কোনো ডিজিটাল মাধ্যম নিয়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পর্যাপ্ত খেলার মাঠ না থাকায়, বিশেষ করে শহরে খোলামেলা পরিবেশের অভাবে শিশুরা ঘরকুনো হয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, শুধু খেলার মাঠ না থাকার কারণে নয়, বাবা-মায়ের অসচেতনতার কারণে শিশুদের ডিজিটাল মাধ্যমে আসক্তি বাড়ছে। এ প্রসঙ্গে হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী এলিনা খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, স্বাভাবিকভাবেই শিশুদের মধ্যে সবসময় নতুন একটি জিনিসের প্রতি তীব্র কৌতূহল থাকে। আর সেটিই একসময় আসক্তি পর্যায়ে চলে যায়। কেবল খেলার মাঠ কিংবা শিশুদের বিনোদন ব্যবস্থার ওপর দোষ না দিয়ে এ ক্ষেত্রে বাবা-মাকে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। তার মতে, শিশুদের এসব ডিভাইস ব্যবহারে রেস্ট্রিকশন (বিধি-নিষেধ) বেঁধে দেওয়া উচিত। শিশু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২ থেকে ৪ বছর বয়সী যেসব শিশু টেলিভিশন দেখে বেশি সময় কাটায়, ১০ বছরের মধ্যে তাদের কোমরের মাপ বেড়ে যেতে পারে। অর্থাৎ তারা অস্বাভাবিক মুটিয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া অতিরিক্ত টিভি দেখার ফলে শিশুরা ‘অ্যাটেনশন ডেফিসিট ডিসঅর্ডার বা অমনোযোগিতার সমস্যায় বেশি ভোগে। এ ছাড়া শিশুর হৃদরোগ, চক্ষু রোগ, উচ্চ রক্তচাপ কিংবা ডায়াবেটিসের মতো দুরারোগ্য রোগ হতে পারে যা তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য অভিশাপ স্বরূপ।  আক্ষেপ করে ধানমন্ডির ফারহানা নাজনীন বলেন, তার ছয় বছরের ছেলে স্থায়ীভাবে ডিজিটাল জগতের বাসিন্দা হতে চলেছে। তিনি বলেন, ‘গেইম কিংবা টেলিভিশন ছাড়া ভাত খায় না। এমনকি খাওয়ার মধ্যে ওই জগতে এতটাই মগ্ন থাকে যে, খাওয়া শেষে জিজ্ঞাসা করলে বলতে পারে না কী দিয়ে খেয়েছে। হাতের কাছে মোবাইল পেলেই গেইম, মোবাইল কেড়ে নিলে টেলিভিশন আর রিমোর্ট কেড়ে নিলে কান্নাকাটি, ভাত খাওয়া বন্ধ।’ একই সমস্যা নিয়ে মহাবিপদে আছেন রাজধানীর মিরপুরে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া যারিন তাসনিমের বাবা মেহেদী আহসান। তিনি বলেন, স্কুল থেকে ফিরে গভীর রাত পর্যন্ত তার মেয়ে কেবল সারাক্ষণ কার্টুন দেখার প্রবণতা। উত্তরার আরেক অভিভাবক বলেন, তার অষ্টম শ্রেণিতে পড়–য়া ছেলে আফরাদের অধিকাংশ সময় কাটে ঘরের দরজা বন্ধ করে, ইন্টারনেটে গেইম খেলে। এমনকি নিজের পরিবারের সঙ্গেও প্রয়োজনের বেশি কথা বলতে চায় না সে। এদিকে ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশপাশে অবস্থিত মোবাইল, ইন্টারনেট ও ভিডিওর দোকানগুলো ঘুরে দেখা গেছে সেখানে স্কুলগামী শিশু কিশোরের আনাগোনাই বেশি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দোকানগুলোতে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীর সংখ্যাই বেশি যাদের বয়স ১২ থেকে ১৪, সর্বোচ্চ ১৬ বছর। ছাত্ররা সেখানে বন্ধু-বান্ধব নিয়ে সাইবার ক্যাফেতে অ্যাডাল্ট সাইট ব্রাউজ করছে। সস্তায় পর্নোগ্রাফি দিয়ে ভরছে মোবাইল, পেন-ড্রাইভ, মেমোরি কার্ড কিংবা অন্য যে কোনো ডিজিটাল ডিভাইজ। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মোহিত কামাল বলেন, ‘ইদানীং ছবি কিংবা কার্টুনে ঠাসা থাকে মারপিট, দুর্ধর্ষ হিংস্রতা। এভাবে সহিংসতা দেখে সমাজে বেপরোয়া হিংস্র ও সন্ত্রাসী শিশু তৈরি হতে পারে। এরা অন্য শিশুদের নিপীড়ন বা নির্যাতন করতে পারে। নির্যাতিত শিশুরাও বড় হয়ে নিপীড়নকারী বনে যেতে পারে।’ তিনি মনে করেন, ‘বাবা-মার উচিত বুঝে-শুনে শিশুকে টিভি দেখতে দেওয়া, টিভি দেখা নিয়ন্ত্রণ করা। কেন নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে সেটি শিশুর বোধের ভিতর জাগিয়ে তোলা।’ জানা গেছে, ডিজিটাল আসক্তি শিশুদের মধ্যে সামাজিক এবং সাইবার অপরাধের প্রবণতাও দ্বিগুণ বাড়িয়ে তুলছে। প্রাপ্ত বয়সের আগেই শিশুদের মধ্যে যৌনচিন্তা এবং ডিজিটাল প্রতারণার প্রবৃত্তি ঘুরপাক খাচ্ছে। হাইস্কুলে নবাগতরা ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেইক আইডি (মিথ্যা পরিচয়) দিয়ে বড়দের সঙ্গে বন্ধুত্ব করছে। অনেকটা অকালপক্বের মতো আচরণ করছে তারা। সাম্প্রতিককালে গড়ে ৬ বছর বয়সী প্রায় ৯ হাজার শিশুর ওপর দীর্ঘ জরিপ চালিয়ে অস্ট্রেলিয়ার এক দল গবেষক তাদের গবেষণায় দেখিয়েছেন, দিনে যারা দুই ঘণ্টার কম সময় টিভি দেখে, তাদের তুলনায় যারা দিনে চার ঘণ্টারও বেশি সময় বিভিন্ন চ্যানেলে ঘুরে বেড়ায় তাদের অকালমৃত্যুর ঝুঁকি শতকরা ৪৬ ভাগ বেশি। অপর এক গবেষণায় যুক্তরাষ্ট্রের একজন মনোগবেষক জেফরি জনসন বাবা-মায়ের উদ্দেশে বলেছেন, শিশুদের দৈনিক এক ঘণ্টার বেশি টিভি দেখতে দেওয়া উচিত নয়।

সর্বশেষ খবর