শনিবার, ২৭ জুন, ২০১৫ ০০:০০ টা
ঈদ বাণিজ্য

ফুটপাথের পর এখন রাস্তা বিক্রি

রাজধানীর ২০০ পয়েন্টে ৭০ হাজার অবৈধ দোকানপাট, কোটি কোটি টাকা আদায়

ফুটপাথের পর এখন রাস্তা বিক্রি

রমজানের আগেই নগরীর ফুটপাথ ও রাস্তার একাংশ কেনাবেচা শেষ হয়ে গেছে, এখন চলছে মাঝ রাস্তায়ও দোকানের পজেশন বিক্রি। কোথাও একচিলতে জায়গা ফাঁকা থাকতে দেওয়া হচ্ছে না। যারা যেভাবে পারছে, সেভাবেই দখল করে জমিয়ে তুলছে ঈদ বাজার। গুরুত্বপূর্ণ মোড় ও পয়েন্টে কোনটা রাস্তা, কোনটা বাজার- তা খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। ঈদকে সামনে রেখে কোথাও কোথাও রাস্তার মাঝখানে আইল্যান্ডের ওপরও বসানো হয়েছে দোকান।
জবর দখল ও অলিখিত ইজারার ভিত্তিতে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে এসব দোকানপাট। হকার্স নেতা, পুলিশ ও সিটি করপোরেশন কর্মীদের মতে, এবারই সবচেয়ে বেশি রাস্তা ও ফুটপাথ দখলের নজির সৃষ্টি হয়েছে। তাদের হিসাব অনুযায়ী, রাজধানীর অন্তত ২০০ পয়েন্টে নতুনভাবে প্রায় ৭০ হাজার খুদে দোকান বসেছে। তবে এই খুদে দোকানি ও হকাররা নিজেদের ‘বৈধ’ বলেই দাবি করেন। তারা জানান, নগদ টাকা দিয়ে তারা এক মাসের জন্য দোকানের পজেশন কিনেছেন। প্রতিদিন গুনতে হয় নির্দিষ্ট অঙ্কের ভাড়া। এরপরও মাস্তান ও পুলিশের চাঁদার দাবি পূরণসহ নানা ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয়। এক মাস মেয়াদে পজেশন ও ভাড়া বাবদ তোলা কোটি কোটি টাকা সংঘবদ্ধচক্র হাতিয়ে নেয়। পেছনে থাকে রাজনৈতিক আশীর্বাদপুষ্ট প্রভাবশালী মহল। প্রতিবছর রমজানে রাস্তা-ফুটপাথ থেকে এভাবে কয়েকশ’ কোটি টাকা আদায় করা হয়। নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে গত তিন দিন সরেজমিন খোঁজ নিয়ে পজেশন বিক্রি, ভাড়াসহ চাঁদা আদায়ের নানা তথ্য জানা যায়। গুলিস্তানে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ এলাকায় রমজান শুরুর ৩-৪ দিন আগেই অলিখিত ইজারা প্রক্রিয়া চালু করে প্রভাবশালী মাস্তানচক্র। রাজনৈতিক প্রভাবে অধিক ক্ষমতাধর মাস্তানরা প্রতিটি রাস্তা, গলি ও মার্কেটের ফাঁকা প্যাসেজ ইজারা দেয় আলাদাভাবে। ইজারা প্রক্রিয়ায় প্রথম দিকেই অংশ নেয় বিভিন্ন মার্কেটের দোকানদাররা। তারা নিজ নিজ দোকান সংলগ্ন ফুটপাথটুকু ইজারায় নিয়ে তা খুদে ব্যবসায়ী বা হকারদের কাছে বিক্রি করে দেয়। পরবর্তীতে হকাররা তাদের নেওয়া ফুটপাথের পজেশন বরাবর সড়কের একাংশ বিক্রি করে আরেক হকারের কাছে। এভাবে তিন দফা পজেশন বিক্রি হওয়ায় এখন বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে রাস্তা বলতে আর কিছু অবশিষ্ট নেই।
ফুটপাতে পাঁচ ফুট বাই পাঁচ ফুট আয়তনের একেকটি দোকান পজেশন বিক্রি হয়েছে আট হাজার থেকে বিশ হাজার টাকায়। অন্যদিকে ফুটপাথ সংলগ্ন একই পরিমাণ সড়ক বিক্রি হয়েছে পাঁচ থেকে দশ হাজার টাকায়।
হকার্স সংগঠনের এক প্রবীণ নেতা জানান, ঢাকার বিভিন্ন স্থানে এবার কমবেশি ৭০ হাজার ‘ফুটপাথ দোকান’ গড়ে উঠেছে। প্রতিদিন আদায় করা চাঁদার পরিমাণ সাড়ে তিন কোটি টাকার কম নয়। ফার্মগেটের খুদে হকাররা জানান, প্রতিদিন ‘পুলিশের বিট’ বাবদ ৫০ টাকা, ‘হকারদের কল্যাণকারী নানা সংগঠনের চাঁদা’ বাবদ ৩০ টাকা এবং স্থানীয় ক্লাব-সমিতির নামে ‘মাস্তানি ভাতা’ বাবদ আরও ২০ টাকা করে চাঁদা দিতে হয়। চাঁদা তোলার জন্য প্রতি লাইনে একজন করে দোকানদার ‘লাইনম্যান’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ দায়িত্বটুকু পালন করায় ‘লাইনম্যান দোকানি’ থাকেন চাঁদামুক্ত। কয়েকটি লাইন মিলে একটি জোন গড়ে তোলা হয়। জোনের দায়িত্বে থাকেন মূল পজেশন বিক্রেতার নিজস্ব কর্মী। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা রাজনৈতিক দলের পরিচয় বহন করে থাকেন। গুলিস্তান এলাকা মোট ১৫টি জোনে ভাগ করা। চাঁদা আদায়ের দায়িত্বে আছেন কালু, মিজান, পুইরা হারুন, একটি রাজনৈতিক সংগঠনের শ্রমিক নেতা আনোয়ার, মজনুসহ কয়েকজন। ফার্মগেট এলাকা ভাগ করা হয়েছে তিনটি জোনে। একইভাবে মতিঝিল-দিলকুশায় ছয়টি জোন, মালিবাগ মোড়ে দুটি জোন, নিউমার্কেট-সায়েন্স ল্যাবরেটরির মোড় পর্যন্ত পাঁচটি জোন, পল্টন-বায়তুল  মোকাররম এলাকায় চারটি জোন, মৌচাক-মালিবাগ, মিরপুর-১ এবং মিরপুর-১০ নম্বর চত্বর এলাকায় দুটি করে জোন রয়েছে। এ ছাড়াও সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল, গাবতলী বাস টার্মিনাল, ফুলবাড়িয়া টার্মিনাল চত্বর ও কারওয়ান বাজারের আশপাশ এলাকা এখন ফুটপাথের ঈদ বাজারে রমরমা হয়ে উঠেছে। ফার্মগেট টেম্পোস্ট্যান্ডের আশপাশে পজেশন নিয়ে বসা হকারদের কাছ থেকে চাঁদা তোলা হচ্ছে একটি রাজনৈতিক দলের যুব সংগঠনের ব্যানারে। তৌহিদ, কাজল, মোফাজ্জল, তারাসহ আরও কয়েকজন চাঁদাবাজি করে থাকেন। কারওয়ান বাজারের মূল রাস্তাটি অলিখিত ইজারা দিয়ে চাঁদা তুলছে শ্রমিক ও যুব সংগঠনের তিন নেতা। ঈদকে সামনে রেখে ফুটপাথ ও রাস্তা দখলের সবচেয়ে বেহাল পরিস্থিতি এখন রাজধানীর প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র মতিঝিলে। প্রতিদিন সেখানে ফুটপাথ কেন্দ্রিক ১০ লাখ টাকার চাঁদাবাজি ঘটছে। যান চলাচলের ব্যস্ততম রাস্তায় এককালীন ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে পজেশন বরাদ্দ, প্রতিদিন ৩০০ টাকা হারে চাঁদা আদায়সহ নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে একচ্ছত্র সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে আজাদ বাহিনী। শ্রমিক লীগের নাম ভাঙিয়ে অর্ধ শতাধিক অস্ত্রবাজ সন্ত্রাসীর সমন্বয়ে দেদার চলছে চাঁদাবাজি। মতিঝিল, দিলকুশা, আর কে মিশন রোড, আরামবাগ-ফকিরাপুল মোড় পর্যন্ত বিশাল এলাকাজুড়ে রয়েছে চাঁদাবাজ চক্রের নিয়ন্ত্রণ। ওই এলাকা থেকে মোটরসাইকেল ও সিএনজি অটোরিকশা চুরিরও মূল হোতা তারা। সম্প্রতি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন মেয়র সাঈদ খোকন নিজেই কয়েকটি ফুটপাথ দখলমুক্ত করার অভিযান চালিয়েছেন। তিনি এ সময় বলেন, ‘নগরীকে যানজট মুক্ত করতে হলে প্রথমে ফুটপাথ অবৈধ দখলমুক্ত করতে হবে।’ ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হক বলেছেন, ‘ফুটপাথ দখলের বাণিজ্যে জড়িয়ে কোটি নগরবাসীকে দুর্ভোগের মুখে ফেলার সুযোগ কাউকে দেওয়া হবে না। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে শিগগিরই উচ্ছেদ অভিযান চালানো হবে।’

সর্বশেষ খবর