মঙ্গলবার, ৭ জুলাই, ২০১৫ ০০:০০ টা

আবর্জনার ভাগাড় ঢাকা সিটি

আবর্জনার ভাগাড় ঢাকা সিটি

ময়লা আবর্জনায় দিনভর সয়লাব হয়ে থাকে রাজধানীর প্রধান প্রধান সড়ক। গতকাল দুপুরে নতুনবাজার প্রগতি সরণি থেকে তোলা ছবি -রোহেত রাজীব

রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান-বারিধারার কূটনৈতিক পল্লী ঘেঁষেই বিরাট ময়লা-আবর্জনার ভাগাড় গড়ে তোলা হয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সহায়তায় স্থানীয় ময়লার ইজারাদার প্রগতি সরণির ব্যস্ততম রাস্তাজুড়ে বানিয়েছেন ভাগাড়টি। ক্রমেই তা স্থায়ী রূপ পেতে বসেছে। শুরুতে মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য বিভিন্ন মহল্লার ময়লা-আবর্জনা রাস্তার একপাশে রাখা হলেও সিটি করপোরেশনের গাড়ি এসে তা দ্রুত অপসারণ করত। কিন্তু ইদানীং সার্বক্ষণিক সেখানে জমে থাকছে ময়লার পাহাড়। আবর্জনা এখন বেশির ভাগ অংশ জুড়ে বিস্তৃত হওয়ায় ফাঁকা থাকা একচিলতে রাস্তা দিয়ে হাজারো যানবাহন চলাচল করে ধীর গতিতে। ফলে রাত-দিন সেখানটায় ভয়াবহ যানজট লেগেই থাকছে। নিত্য ভোগান্তি পোহানো যাত্রীরা উৎকট গন্ধযুক্ত ডাস্টবিনের স্থানটুকুকে ‘প্যারিসের সেন্ট কারখানা’ বলে টিটকারি করে থাকে। অঘোষিত এ ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ের কয়েক গজ দূরেই রয়েছে সারি সারি দূতাবাস। বিভিন্ন দেশের কর্মকর্তারা নিজ নিজ দূতাবাসে বসেই ময়লা-আবর্জনার উৎকট দুর্গন্ধ পান। কেউ কেউ নাকে মুখে রুমাল চেপে অফিস করতে বাধ্য হচ্ছেন। দূতাবাসগুলোর পক্ষ থেকেও বারবার ময়লা-আবর্জনা, দুর্গন্ধময় দূষিত পরিবেশ থেকে রেহাই পাওয়ার আবেদন জানানো হয়েছে। কিন্তু ডিসিসি ও তার দাপুটে ঠিকাদারের কাছে সেসব আবেদন-নিবেদন কোনো পাত্তাই পাচ্ছে না। ফলে দূতাবাসে কর্মরত বিদেশিদের কাছে ময়লা-আবর্জনার দুর্গন্ধময় বাংলাদেশের বিদঘুটে লজ্জাকর ভাবমূর্তি গড়ে উঠতে শুরু করেছে। শুধু বারিধারা-নতুনবাজার এলাকাতেই নয়, গোটা রাজধানীই যেন উৎকট গন্ধময় ময়লা-আবর্জনার বৃহৎ ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। তিলোত্তমা এ মেগাসিটির রাস্তাঘাট, অলিগলি, আবাসিক, বাণিজ্যিক কি শিল্প এলাকা-সর্বত্রই ধুলা, ধোঁয়া, ময়লা-আবর্জনার বিদঘুটে ছড়াছড়ি। ড্রেন-নর্দমার নোংরা তরল ময়লা অনায়াসে ঢুকে পড়ছে বাড়িঘরে। বাসিন্দারা বছরের পর বছর ধরে চরম দুর্গন্ধ সয়ে, দমবন্ধ পরিবেশে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছেন।
রাস্তা আর মহল্লায় অভিন্ন দৃশ্যপট : বিশালকায় এ কনটেইনার ডাস্টবিনগুলোর কারণে রামপুরা-বাড্ডা-কুড়িল, মহাখালী মোড়, ফকিরাপুল, যাত্রাবাড়ী, কলেজ গেট থেকে গাবতলী, মিরপুর ১ থেকে ১০ নম্বর, কাজীপাড়া-শেওড়াপাড়া, গুলশানের প্রধান প্রধান রাস্তায় ভয়াবহ যানজটের সৃষ্টি করছে। এসব কনটেইনার ডাস্টবিন যেমন রাস্তার প্রায় অর্ধেকটা দখল করে আঁকাবাঁকা অবস্থায় ফেলে রাখা হয়, তেমনি এগুলোর উপচে পড়া ময়লা-আবর্জনা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ায় রাস্তা আরও সংকুচিত হয়ে যায়। কয়েক বছর ধরেই মধ্যবাড্ডায় বিশ্বরোডের ওপর পাশাপাশি ছয়টি কনটেইনার ডাস্টবিন এলোপাতাড়িভাবে ফেলে রাখা আছে। পথচারী-যাত্রীরা এ স্থানকে ‘অভিশাপ’ নামে আখ্যা দিয়ে থাকেন। রাজধানীর গ্রিন রোডবাসী প্রতিদিন ঘর থেকে বেরিয়েই গলির মুখে আবর্জনার পাহাড় দেখতে পান। এতে পথচারীদের চলতে যেমন সমস্যা হয়, তেমনি দুর্গন্ধে আশপাশে থাকাটা কঠিন হয়ে পড়ে। মিরপুর ১৩ নম্বর সেকশনের বি-ব্লকের বাসিন্দা আনোয়ারুল হক বলেন, ‘বর্ষা কি শীত, সব সময় এখানে পানি জমে থাকে। ঘরের ভিতর বসেই নোংরা পানির সরোবর দেখি।’ মালিবাগ এলাকার বাসিন্দা লুৎফর রহমান, সামসুজ্জামান, আলহাজ শহিদুল ইসলামসহ কয়েকজন বলেন, একটি দেশের রাজধানীর আবর্জনা ব্যবস্থাপনা বলতে কিছু নেই তা ভাবতেও অবাক লাগে। মহল্লায় মহল্লায় এত বড় বড় যে অ্যাপার্টমেন্ট নির্মিত হয়েছে, কোনো ভবনের সঙ্গেই ডাস্টবিন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়নি। টিপু সুলতান রোডের বাসিন্দা নূর আলী বলেন, ‘ময়লার জঞ্জাল সহ্যসীমা ছাড়ালে এলাকাবাসী চাঁদা তুলে সে টাকায় ডাস্টবিন পরিষ্কার করিয়ে নিতে বাধ্য হয়।’ টিপু সুলতান রোডের মতো মুগদাপাড়া, মানিকনগর, বাসাবো মাঠের কোনায়, যাত্রাবাড়ী মোড়, শংকর বাসস্ট্যান্ড, মনেশ্বর রোডের বটতলা মোড়, গুলবাগ, কলাবাগান লেকসার্কাস রোড, কাঁঠালবাগান রোড, তেজকুনিপাড়ায় বসানো ডাস্টবিনগুলো কবে যে পরিষ্কার হয় আর কবে যে পরিষ্কার হয় না, তা বুঝতে পারেন না আশপাশের বাসিন্দারা। কারণ প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তেই তারা ডাস্টবিন উপচে ময়লা-আবর্জনা ছড়ানো-ছিটানো অবস্থায় দেখতে পান। খোলা ময়লা-বর্জ্য নিয়ে কাক-কুকুরের টানাহেঁচড়ায় চারপাশেই সৃষ্টি হয় বিদঘুটে নোংরা অবস্থার। গোলাপবাগ, গোপীবাগ, নারিন্দা, শহীদ ফারুক রোড, করাতিটোলা, মিরপুর মাজার রোড, কাফরুলের পূর্ব কাজীপাড়া, ফার্মগেট-সংলগ্ন তেজতুরীবাজার এলাকার বেশ কয়েকটি রাস্তায় আবর্জনার স্তূপ জমে জমে ছোটখাটো টিলায় রূপ নিয়েছে। ময়লার ঢিবির কারণে সেসব রাস্তা-লেনে রিকশা-গাড়ির চলাচল পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেছে। এর পরও উপায়হীন মানুষজন মলমূত্র, কাদাপানিতে একাকার থাকা ময়লা বর্জ্যে পা ডুবিয়েই পথ চলতে বাধ্য হচ্ছেন।
টয়লেট থেকে কাঁচাবাজার : ডিসিসি নির্মিত প্রায় ৭০টি পাবলিক টয়লেটের সবগুলোই ব্যবহারের অনুপযোগী। পথচলতি মানুষ বিপজ্জনক এ টয়লেট ব্যবহারের পরিবর্তে ফুটপাতকেই টয়লেট বানিয়ে ফেলেছেন। ফলে মলমূত্রের কারণে ফুটপাত দিয়ে হেঁটে চলাই দুরূহ হয়ে উঠেছে। রাজধানীর কাঁচাবাজারগুলোর একেকটি যেন ময়লা-আবর্জনার আধার। কাপ্তানবাজারের নোংরা ময়লা অব্যবস্থাপনা গুলিস্তান পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে। পুরো রাস্তায় ফেলে রাখা হয়েছে জবাই করা মুরগির নাড়ি-ভুঁড়ি, পালক, গরু-ছাগলের মলমূত্র। সেখানকার বেশির ভাগ ব্যবসা কেন্দ্রে শত শত মুরগি জবাই করে নাড়ি-ভুঁড়িসহ সব ময়লা-উচ্ছিষ্ট সরাসরি রাস্তায় নিক্ষেপ করা হচ্ছে। যাত্রাবাড়ীর মাছের আড়তের আশপাশ দিয়ে দ্রুতগতির গাড়িতে চলাচলেরও জো নেই।
প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তার বক্তব্য : ডিসিসির (উত্তর) প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা বিপিন কুমার সাহা বলেন, ‘অন্তত ২০ হাজার জনবল হলে এ মেগাসিটির পরিচ্ছন্ন কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা সম্ভব। অথচ ডিসিসির আছে মাত্র সাড়ে সাত হাজার পরিচ্ছন্নতা কর্মী। ময়লা বহনের জন্য অন্তত ৮০০ গাড়ি দরকার। এর বিপরীতে আছে মাত্র ২৫০টি গাড়ি। এর মধ্যেও গড়ে ৩০-৩৫টি যান্ত্রিক ত্রুটিজনিত কারণে বিকল থাকে। তবু আমরা সাধ্যানুযায়ী সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’

সর্বশেষ খবর