বুধবার, ১৫ জুলাই, ২০১৫ ০০:০০ টা

এমপির গম-বাণিজ্য

দেওয়ানগঞ্জ-বকশীগঞ্জে টিআর কাবিখা কাবিটা ভিজিএফ ও কর্মসৃজন প্রকল্পে হরিলুট

সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ এমপির নির্বাচনী এলাকা জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ ও বকশীগঞ্জ উপজেলায় টিআর, কাবিখা, কাবিটা, ভিজিএফ, কর্মসৃজন প্রকল্প নিয়ে চলছে হরিলুট কারবার। প্রকল্পের টাকা, গম আর সোলার প্যানেলের টাকা অধিকাংশই গেছে এমপি সমর্থক আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের পকেটে। গমের টাকায় চলছে দুই উপজেলায় সরকারি দলের ইফতার মাহফিল।
শুধু টিআর, ভিজিএফ, কাবিখা, কর্মসৃজন প্রকল্প নয়; সরকারি গম সংগ্রহ নিয়েও একই অবস্থা। কৃষক থেকে সরাসরি গম সংগ্রহের নিয়ম থাকলেও এমপি তার সমর্থক দলীয় নেতা-নেতা-কর্মীদের নামে দিয়েছেন গম সরবরাহের বরাদ্দ। দুই দফায় এ দুটি উপজেলায় অকৃষকদের কাছ থেকে গম সংগ্রহ করে কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নিয়েছেন এমপি ও তার সমর্থকরা। চলতি মৌসুমে সরকার বকশীগঞ্জ উপজেলায় প্রথম দফায় ৫৯০ টন, দেওয়ানগঞ্জে ৪২১ টন; দ্বিতীয় দফায় বকশীগঞ্জে ৩৯৩ টন ও দেওয়ানগঞ্জে ২৮১ টন গম সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। এ গম সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে কেনার কথা। কিন্তু সরকারি সংগ্রহ মূল্যের চেয়ে বাজারদর অনেক কম হওয়ায় স্থানীয় এমপি আবুল কালাম আজাদ নিজে তালিকা করে তার সমর্থক নেতাদের নাম পাঠান খাদ্য নিয়ন্ত্রকসহ সংশ্লিষ্ট দফতরে। তালিকায় কে কী পরিমাণ গম সরবরাহ করবেন তাও নির্ধারণ করে দেন এমপি। তালিকায় উপজেলা প্রশাসন, ইউএনও, উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, এমপির সমর্থক বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা, তার খালাতো ভাই, এপিএস, এমনকি তার বাবুর্চির নামও রয়েছে। তালিকায় নাম রয়েছে এমন একজন আওয়ামী লীগ নেতা তার নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ‘আমার নামে গম সাপ্লাই হলেও লাভের ৭০ ভাগ নিয়ে যাচ্ছেন এমপি।’ এলাকার কৃষকদের অভিযোগ, গত ছয় বছরে তারা সরকারি গুদামে এক ছটাক গমও বেচতে পারেননি। তাদের গম বেচতে হয়েছে কম দামে। বাজারে বর্তমানে প্রতি টন গম বিক্রি হচ্ছে ১৮ হাজার থেকে ১৮ হাজার ৫০০ টাকায়। আর জুন পর্যন্ত সরকার সংগ্রহ করেছে প্রতি টন ২৮ হাজার টাকা দরে। সে হিসেবে বকশীগঞ্জ ও দেওয়ানগঞ্জ উপজেলায় ১ হাজার ৬৮৫ টন গম সরবরাহ দিয়ে এমপি ও তার সমর্থকরা পকেটে পুরেছেন দেড় কোটি টাকারও বেশি। এ ব্যাপারে বকশীগঞ্জ উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. খলিলুর রহমানের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘কৃষক থেকে গম সংগ্রহের নিয়ম থাকলেও এমপির দেওয়া তালিকার বাইরে যাওয়ার আমাদের কোনো সুযোগ নেই।’
গম সরবরাহের ‘কৃষক’ তালিকায় ইউএনও ও উপজেলা প্রশাসনের নাম থাকলেও বকশীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নার্গিস পারভীন ফোনে বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই।’ তাহলে ইউএনও ও উপজেলা প্রশাসনের নামে গম সাপ্লাই কে করল? এ প্রশ্নের সদুত্তর মেলেনি তার কাছ থেকে। জানা গেছে, দ্বিতীয় দফায় গম সরবরাহের লাভের টাকার অংশ দিয়ে আয়োজন হয়েছে এ দুই উপজেলায় এমপির সম্মানে ইফতার মাহফিল। ১২ জুলাই দেওয়ানগঞ্জ ও ১৩ জুলাই বকশীগঞ্জে এমপির পক্ষে ইফতারের আয়োজন করা হয়। এলাকার সাধারণ মানুষের মুখে মুখে অভিযোগ, গমের টাকায় হচ্ছে ইফতার আয়োজন।
শুধু গম সরবরাহ নয়, এ দুই উপজেলায় টিআর, কাবিখা, কাবিটা, ভিজিএফ ও কর্মসৃজন প্রকল্প নিয়ে চলছে হরিলুট কারবার। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার (কাবিটা/গম) নির্বাচনী এলাকাভিত্তিক কর্মসূচির আওতায় দ্বিতীয় পর্যায়ে বকশীগঞ্জ উপজেলায় বরাদ্দ দেওয়া হয় ১৫ লাখ টাকা, একই প্রকল্পে গম বরাদ্দ দেওয়া হয় ৭০ টন আর দেওয়ানগঞ্জে এমপি দ্বিতীয় পর্যায়ে বিশেষ প্রকল্পের নামে আটটি প্রকল্পে বরাদ্দ দেন ৭৬ টন গম। দেওয়ানগঞ্জে কাবিখা নগদ অর্থ দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৫ লাখ ৮০ হাজার ও কাবিটা নগদ অর্থ তৃতীয় পর্যায়ে ৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেন। এসব প্রকল্পের কোথাও ১০ ভাগ কাজও হয়নি। প্রকল্পগুলোয় দুস্থ পরিবার ও প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে সোলার প্যানেল স্থাপনের নামে আত্মসাৎ করা হয়েছে সিংহভাগ টাকা। স্থাপিত প্যানেলগুলো খুবই নিুমানের। একেকটি প্যানেলের জন্য ব্যয় দেখানো হয়েছে ২২ থেকে ২৩ হাজার টাকা। কিন্তু বসানো হচ্ছে ৬-৭ হাজার টাকা দামের নিুমানের প্যানেল। এ ছাড়া বকশীগঞ্জ উপজেলার কাবিখা সাধারণ দ্বিতীয় পর্যায়ে ১২টি প্রকল্পে ১২৮ টন গম বরাদ্দ দেওয়া হয়। এসব প্রকল্পে ২০ ভাগ কাজও হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসীর অনেকেই।
একই অর্থবছরে নির্বাচনী এলাকাভিত্তিক গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ টিআর প্রকল্পে দ্বিতীয় পর্যায়ে বকশীগঞ্জ উপজেলায় ৫৮টি প্রকল্পের অনুকূেেল এমপি আবুল কালাম আজাদ বরাদ্দ দেন ২৯ লাখ টাকা। দেওয়ানগঞ্জ উপজেলায় ৮২টি প্রকল্প দেখিয়ে টিআর/টাকা বরাদ্দ দেন ৩১ লাখ। দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যানের টিআর নগদ টাকা দ্বিতীয় পর্যায়ে ৫৭টি সাধারণ প্রকল্পে বরাদ্দ দেন ৩০ লাখ ৫০ হাজার ৫৩৩ টাকা।
দেওয়ানগঞ্জে এমপি টিআর তৃতীয় পর্যায়ের ৬৪টি প্রকল্পের জন্য ১৪ লাখ ৮৬ হাজার ১৩৬ টাকা বরাদ্দ দেন। এসব বরাদ্দের টাকা ছাড় হয়েছে ৩০ জুন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোথাও কাজ হয়নি। কাগজে-কলমে প্রকল্পগুলোর অস্তিত্ব থাকলেও বাস্তবে নেই। অভিযোগ উঠেছে, সবই গেছে এমপি সমর্থক নেতাদের পকেটে।
টিআর প্রকল্পের আওতায় বকশীগঞ্জ হেলিপ্যাড সংস্কারে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৩০ হাজার ৫০০ টাকা। দীর্ঘদিনের পুরনো ঘাসে আবৃত উঁচু হেলিপ্যাডটিতে একমুঠো মাটিও ফেলা হয়নি। হেলিপ্যাডসংলগ্ন সীমারপাড় গ্রামের বাসিন্দা মো. ইব্রাহিম ও নুরেজা বেগম জানান, হেলিপ্যাডে কোনো কাজের কথা তারা এক যুগের মধ্যে শোনেননি, দেখেনওনি। ৩০ হাজার ৫০০ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও কাজ হয়নি কালু দফাদারের বাড়িসংলগ্ন সামাজিক কবরস্থান সংস্কার প্রকল্পে, কোনো কাজ হয়নি একই অঙ্ক বরাদ্দ দেওয়া মালিরচর নয়াপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় সংস্কারে। কাজ হয়নি বালুরচর নতুন বাজার পাঠাগার সংস্কারকাজ প্রকল্পে। বাট্টাজোড় ভূমি অফিস সংস্কারের জন্য ৩৫ হাজার এবং বাট্টাজোড় বীরগাঁও সামাজিক কবরস্থান সংস্কারকাজের জন্য ৩০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এলাকার বাসিন্দা দুদু মিয়া জানান, এখানে কোনো কাজ হয়নি। অবশ্য এ ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ডা. আবদুল মুন্নাফ এ দুটি প্রকল্পে ৬০ ভাগ কাজ হয়েছে দাবি করলেও বাস্তবে কোনো কাজের চিহ্ন চোখে পড়েনি এই প্রতিবেদকের। শুধু এসব প্রকল্প নয়, ৫৮টি প্রকল্পের কোথাও কাজ হয়নি। এসব প্রকল্পে কাজের চিহ্ন পাওয়া যায়নি এলাকা ঘুরে। টিআর তৃতীয় পর্যায়ে বকশীগঞ্জে এমপির বরাদ্দ ১৪ লাখ টাকা ও ৪ লাখ টাকা প্রায় পুরোটাই ভাগাভাগি হয়েছে এমপি ও তার সমর্থক নেতা-কর্মীদের মধ্যে। দেওয়ানগঞ্জেও বেশ কয়েকটি প্রকল্প ঘুরে একই চিত্র পাওয়া গেছে। কাজ না হলেও টিআর দ্বিতীয় পর্যায়ের বরাদ্দের অর্থ ছাড় করা হয়েছে গেল ৩০ জুনেই।
কাগজ-কলমে এসব প্রকল্পের নাম থাকলেও বাস্তবে কাজ হয়নি কোথাও। কাজ হয়নি অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসৃজন প্রকল্পে। শুধু কর্মসৃজন প্রকল্পেই দেওয়ানগঞ্জ ও বকশীগঞ্জ উপজেলায় লুটপাট হয়েছে ২ কোটি টাকার ওপরে। শুধু টিআর, কাবিখা, কর্মসৃজন নয়; ভিজিএফ নিয়েও এ দুই উপজেলায় চলছে নয়ছয়ের কারবার। ঈদ উপলক্ষে দেওয়ানগঞ্জ উপজেলায় ভিজিএফ কার্ড দেওয়া হয় ৫১ হাজার ৯৭১টি আর বকশীগঞ্জে ৩৯ হাজার ৯৭১টি। প্রতিটি কার্ডে দেওয়া হবে ১০ কেজি চাল। এসব কার্ডও ভাগাভাগি করে নিয়েছেন স্থানীয় চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা। তৃণমূল পর্যায়ে দরিদ্রদের মধ্যে ভিজিএফের চাল বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ মিলেছে বিস্তর।
এসব ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে বকশীগঞ্জ প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, ‘সোলারের কাজে কোনো অনিয়ম নেই। আমি উপস্থিত থেকে সোলার লাগাচ্ছি। টিআর, কাবিখার কাজ কিছু দেখেছি, কিছু কাজ চলমান আছে। অনিয়মের ব্যাপারে আমি এ মুহূর্তে কিছু বলতে পারব না।’
প্রথম দফা গম সরবরাহের তালিকা দেওয়ার পর ১ জুন জামালপুর-১ (বকশীগঞ্জ-দেওয়ানগঞ্জ) আসনের এমপি সাবেক মন্ত্রী আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে সেলফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি এই প্রতিনিধির কাছে তালিকা দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বলেছিলেন, ‘আমার নির্বাচনী এলাকার কৃষকদের তালিকা দিয়েছি।’  
টিআর, কাবিখাসহ অন্য প্রসঙ্গে জানতে গতকাল চেষ্টা করেও সেলফোনে তার সঙ্গে কথা বলা যায়নি।

সর্বশেষ খবর