সোমবার, ২৪ আগস্ট, ২০১৫ ০০:০০ টা

বিমানের শিডিউল বিপর্যয় চরমে

অনিয়ম দুর্নীতি অব্যবস্থাপনা

বিমানের শিডিউল বিপর্যয় চরমে

গত শুক্রবারের ঘটনা। আবুধাবি যাওয়ার উদ্দেশ্যে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসেন যাত্রীরা। বাংলাদেশ বিমানের বিজি-২৭ ফ্লাইটটি ঢাকা থেকে বিকাল ৪টা ৪৫ মিনিটে ছেড়ে চট্টগ্রাম হয়ে আবুধাবি যাওয়ার কথা। কিন্তু বিমান ছাড়ার মাত্র আধা ঘণ্টা আগে জানানো হলো, ফ্লাইট অনিশ্চিত। যেতে হলে রুট পরিবর্তন করে দুবাই হয়ে যেতে হবে। এ নিয়ে বিমান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে শুরু হয় যাত্রীদের বাকবিতণ্ডা। এমতাবস্থায় ৪০-৫০ জন যাত্রীর সিট পরিবর্তন করে তাদের অন্য একটি ফ্লাইটে দুবাই পাঠানো হলো। এরপর বাকিদের নিয়ে বিজি-২৭ নামের ওই ফ্লাইটটিই আবার রাত ৮টা ২০ মিনিটে ছেড়ে যায় গন্তব্যে। এতে দুবাই হয়ে যাওয়া যাত্রীরা যেমন ভোগান্তিতে পড়েন তেমনি ঢাকা থেকে বিলম্বে ছেড়ে যাওয়া বিমানের যাত্রীদেরও পড়তে হয় চরম বিপাকে। এ নিয়ে বিমান কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনো সহমর্মিতা পাননি যাত্রীরা। বাংলাদেশ বিমানের শিডিউল বিপর্যয় কিংবা যাত্রী হয়রানির এই চিত্র নতুন কিছু নয়। প্রতিষ্ঠানটির বেহাল যাত্রীসেবা, অব্যাহত লোকসান, দুর্নীতি-লুটপাট ও দৈন্যদশা নিয়ে বিভিন্ন মহলে যখন সমালোচনার ঝড়, তখনো একই কাজ করে চলেছে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী এই প্রতিষ্ঠানটি। বিমানের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, এ নিয়ে সম্প্রতি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রীর সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠকও করেছেন বিমানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তাদের প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে- কোনোভাবেই বিমানকে আর লোকসানে নিয়ে যাওয়া যাবে না। এ বিষয়ে বিমানের চেয়ারম্যান এয়ার মার্শাল (অব.) জামাল উদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, হজ মৌসুমে যাত্রীদের জন্য তিনটি অতিরিক্ত উড়োজাহাজ বরাদ্দ করায় শিডিউল ঠিক রাখতে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে। আর বিজি-২৭ ফ্লাইটের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘সেটি একটি টেকনিক্যাল সমস্যা ছিল।’  

বিষয়টি যাত্রীদের আগে না জানিয়ে বিমানবন্দরে এনে হয়রানির যুক্তি কী- জানতে চাইলে তিনি বলেন, যাত্রার আগ মুহূর্তে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিলে আমরা কী করতে পারি?
জানা গেছে, শুধু হজ মৌসুমে নয়, সারা বছরই বিমানে চলছে শিডিউল বিপর্যয়। যে কোনো ফ্লাইটে ২০ মিনিট থেকে আধা ঘণ্টা বা ৪০ মিনিট বিলম্ব হওয়া বিমানের স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে। আর শিডিউল বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে সকালের বিমান দুপুরে ছাড়া, দুপুরেরটা রাতে যাওয়া যেন নৈমিত্তিক ঘটনা। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, যাত্রী সংকটে পড়ে আন্তর্জাতিক রুটের কোনো একটি ফ্লাইটই হুট করে বাতিল ঘোষণা করা হচ্ছে। এতে যাত্রীদের পড়তে হচ্ছে বিপদে। বিমান সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশের অভ্যন্তরে সাতটি রুট ছাড়াও ১৫টি আন্তর্জাতিক রুটে বাংলাদেশ বিমান তাদের ফ্লাইট পরিচালনা করছে। প্রায় তিন বছর বন্ধ থাকার পর চারজন মন্ত্রীর উপস্থিতিতে গত ৬ এপ্রিল একযোগে অভ্যন্তরীণ সাতটি রুটে বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট চালুর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর ওইদিনই শেষবারের মতো ঢাকা-রোম-ঢাকা রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করে বিমান কর্তৃপক্ষ। নানা অসঙ্গতি ও লোকসানের বোঝা নিয়ে বন্ধ হয়ে যায় এই রুটের ফ্লাইট অপারেশন। বিমানের নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে বিদেশি নাগরিক কাইল হেউড দায়িত্ব গ্রহণের এক মাসের মধ্যেই তিনি এ সিদ্ধান্ত নেন। জানা যায়, রুটটিতে একেকটি ফ্লাইট পরিচালনা করে ৮৮ লাখ টাকা করে লোকসান গুনতে হচ্ছিল। এদিকে অনেক দিন ধরে স্থগিত রয়েছে বিমানের দিল্লি এবং হংকং রুটের ফ্লাইট। সূত্র বলছে, এই রুট দুটিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য ফ্লাইট অপারেশন স্থগিতের কথা বললেও দিন দিন এটি রোমের পথেই যাচ্ছে। যে কোনো দিনই স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যেতে পারে এই দুটি রুট।  

আন্তর্জাতিক রুটে বর্তমানে লন্ডন, জেদ্দা, রিয়াদ, দাম্মাম, দোহা, দুবাই, আবুধাবি, কুয়েত, মাসকাট, কুয়ালালামপুর, সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, রেঙ্গুন, কাঠমান্ডু এবং কলকাতায় বিমানের ফ্লাইট পরিচালিত হচ্ছে। এসব রুটেও প্রতিনিয়ত ঘটছে শিডিউল বিপর্যয়। অথচ অভ্যন্তরীণ রুটে নতুন করে বিমান চালুর দিনই প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্টদের শিডিউল মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু তার নির্দেশনা সত্ত্বেও শুরু থেকেই শিডিউল বিপর্যয়ে পড়ে এই রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থা। এমনকি প্রথম দিনই তিনটি রুটে দুই থেকে পাঁচ ঘণ্টা বিলম্বে ছাড়ে ফ্লাইট। এ ছাড়া ওইদিন দুটি রুটের যাত্রাও বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিল বিমান কর্তৃপক্ষ। শিডিউল বিপর্যয়ের কারণ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অব্যবস্থাপনা এবং বিমানের অভ্যন্তরে দুর্নীতিগ্রস্তদের কারসাজিতে বহরে ত্রুটিপূর্ণ উড়োজাহাজ সংযোজনই শিডিউল বিপর্যয়ের মূল কারণ। দুর্নীতিবাজ এই সিন্ডিকেটটি নতুন বিমান কেনা বা লিজ নেওয়ার চেয়ে পুরনো বিমান ভাড়া করে আনতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। শুধু বিমান ভাড়ার ক্ষেত্রে নয়, ত্রুটিপূর্ণ বিমানের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ কিনতেও এ চক্রটি উদগ্রীব থাকে। পরবর্তীতে ত্রুটিপূর্ণ এই উড়োজাহাজগুলোই হুটহাট বড় ধরনের সমস্যা ঘটায়, আর ‘টেকনিক্যাল সমস্যা’ ব্যাখ্যা দিয়ে যাত্রীদের ভোগান্তিতে ফেলে দেয় বিমান সংশ্লিষ্টরা। এ বছরই টেন্ডারের মৌলিক শর্ত ভেঙে মিসরের স্মার্ট অ্যাভিয়েশন কোম্পানি থেকে ড্যাশ ৮-কিউ-৪০০ এনজি নামে এমন দুটি উড়োজাহাজ ভাড়া করে আনা হয়। জানা যায়, এ উড়োজাহাজের পেছনে পাঁচ বছরে যে খরচ হবে (আনুমানিক ৩২০ কোটি টাকা), তা দিয়ে এ ধরনের আরও চারটি বিমান কেনা সম্ভব। সূত্র বলছে, সব মিলিয়ে বিমানে বর্তমানে ১২টি উড়োজাহাজ রয়েছে। এর মধ্যে ছয়টি নিজস্ব ও ছয়টি লিজ নেওয়া। উড়োজাহাজগুলোর মধ্যে বি-৭৭৭-৩০০ ইআর ও এয়ারবাস-৩১০-এর ছয়টি ছাড়া বাকি (ড্যাস-৮-কিউ-৪০০ ও বি-৭২৭-৮০০ সহ) সবই লিজ নেওয়া। জানা গেছে, এসব উড়োজাহাজের অধিকাংশই ত্রুটিপূর্ণ এবং ২০ বছরের পুরনো। আর এসব উড়োজাহাজের জ্বালানি খরচও দ্বিগুণ। কোটি কোটি টাকা লোকসানে থাকা সত্ত্বেও আবার আগামী নভেম্বর ও ডিসেম্বরে আনা হচ্ছে বি-৭৩৭-৮০০ নামের আরও দুটি বিমান। এ ছাড়া বি-৭৭৭ একটি বিমান আনার পাঁয়তারা করছে স্বার্থান্বেষীরা। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বেচ্ছাচারিতা, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, দলবাজিসহ বিভিন্ন অব্যবস্থাপনাও শিডিউল বিপর্যয়ের কারণ বলে মনে করছেন এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা। দায়িত্বশীল অনেকে বলছেন, সংস্থার এমডি কাইল হেউড নিজেও  কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়মিত কার্যকর যোগাযোগ করতে পারেন না। সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষও তাকে মিটিংয়ের জন্য ডেকে পান না। দুর্নীতিবাজদের দৌরাত্ম্যে তিনি অনেকটা নীরব ভূমিকায় থাকেন। যদিও বিমানের চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন আহমেদ বিষয়টি সম্পূর্ণ নাকচ করে দিয়ে বলেন, তার মতো সে থাকে। আমাদের সঙ্গে যেটুকু দরকার সেটুকুই যোগাযোগ রাখেন। আমাদের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কিছু নেই।

সর্বশেষ খবর