মঙ্গলবার, ২০ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে পদে পদে রোগী ভোগান্তি

মনিরুল ইসলাম মনি, সাতক্ষীরা

সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে পদে পদে রোগী ভোগান্তি

সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল নামেই চিকিৎসালয়। স্বাস্থ্যসেবার জন্য এখানে কার্যত কোনো সুব্যবস্থা নেই। তার বদলে আছে পদে পদে ভোগান্তি। একে তো ডাক্তার সংকটে বেসামাল অবস্থা, তার সঙ্গে রয়েছে হাসপাতালের অনিয়ম, দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনা। ফলে ১০০ শয্যার এ হাসপাতাল এখন সেবার বদলে ভোগান্তির হাসপাতালে পরিণত হয়েছে।

দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, দীর্ঘদিন ধরে এ হাসপাতালে নেই সিনিয়র কনসালট্যান্ট, মেডিসিন-চক্ষু-অ্যানেসথেসিয়ার জুনিয়র

কনসালট্যান্ট এবং নাক-কান-গলা-প্যাথলজি মেডিকেল অফিসার। রেডিওলজিস্টসহ মোট ৯টি বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পদ শূন্য পড়ে আছে। বছরখানেক আগে এসব পদে কর্মরত ডাক্তাররা তদ্বির করে হাসপাতাল ছেড়েছেন। তারা বদলি হয়েছেন সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ অন্যান্য স্থানে। তারপর থেকে সংকট মহীরুহের রূপ নিয়েছে। এখন জোড়াতালি দিয়ে কোনোরকমে চলছে চিকিৎসাসেবা। কিন্তু শূন্যপদগুলোতে ডাক্তার নিয়োগের ব্যাপারে সিভিল সার্জন বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো মাথাব্যথা নেই। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে এ হাসপাতালে ২৭ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার পদের স্থলে ১৮টি পদে মেডিকেল অফিসার কর্মরত। তাদের হাসপাতালে পাওয়া যায় না। কারণ তারা ব্যস্ত সময় কাটান অন্য কোনো হাসপাতাল বা নিজস্ব ক্লিনিকে। চক্ষু বিভাগ নামে বিভাগ থাকলেও ডাত্তার নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ৭৪ জন সিনিয়র স্টাফ নার্সের মধ্যে ১০ জন স্টাফ নার্সের পদও খালি। যে কারণে রোগীরা কাক্সিক্ষত সেবা পান না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাতক্ষীরা সরকারি সদর হাসপাতালের অ্যানেসথেসিয়া বিভাগের ডাক্তার না থাকায় সেখানে প্রেষণে দায়িত্ব পালন করছেন কলারোয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার জুনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. আসাদুজ্জামান। তিনি কলারোয়া উপজেলা থেকে আসা-যাওয়া করেন। প্রতিদিন তাকে হাসপাতালে আসতে ২০ কিলোমিটার করে মোট ৪০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। তিনি নিয়মিত আসা-যাওয়া করতে পারেন না। এর ফল ভোগ করেন রোগীরা। রোগীদের অভিযোগ, জরুরি বিভাগের টিকিট কাউন্টারে রয়েছে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি। এখান থেকে জনপ্রতি পাঁচ টাকা দিয়ে টিকিট সংগ্রহ করার নিয়ম। কিন্তু আদায় করা হয় রোগীপ্রতি সাত টাকা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১০ টাকাও আদায় করা হয়। প্রতিদিন প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০ রোগীকে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য এভাবে প্রাথমিক ধাপেই বাড়তি টাকা গুনতে হয়। টিকিট মাস্টার লিটন, ইনসান ও লিপির দাবি, সরকার নির্ধারিত ফির বাইরে অবৈধ অতিরিক্ত এ টাকা আরএমও এবং সিভিল সার্জনের নির্দেশে দুস্থ রোগীদের কল্যাণার্থে নেওয়া হয়। কিন্তু অভিযোগে জানা যায়, বাস্তবে এ বাড়তি টাকা মাস শেষে ভাগবাটোয়ারা করে নেন ডাক্তার ও স্টাফরা।

জানা যায়, জরুরি বিভাগ থেকে শুরু করে হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন কোনো রোগীকে হাসপাতাল থেকে ঠিকমতো ওষুধ সরবরাহ করা হয় না। সরকারিভাবে ওষুধ সরবরাহের কথা থাকলেও নামকাওয়াস্তে রোগীদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় গ্যাসের ট্যাবলেট, কাশি অথবা সর্দির সিরাফ ও এন্টিবায়োটিক ওষুধ। বিভিন্ন জটিল রোগের জন্য মেলে না ইনজেকশন ও ওষুধ। প্রসূতি মায়েদের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। ওষুধের জন্য কোনো রোগী বাকবিতণ্ডা করলে সাফ বলা হয়, ‘সরবরাহ নেই’।

জরুরি, বহির্বিভাগ, রেডিওলজিস্ট ও প্যাথলজি বিভাগে রয়েছে পদে পদে দুর্নীতি আর অনিয়ম। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রেডিওলজিস্ট বিভাগে সিটিস্ক্যান, এক্সরে, আল্টাসনোগ্রাম (ইউএসজি) টেকনিসিয়াল থাকলেও নেই কোনো ডাক্তার। ফলে সিটিস্ক্যান, এক্সরে, আল্টাসনোগ্রাম কার্যক্রম নেই। এগুলো টেকনিসিয়ানদের মাধ্যমেই বাইরে থেকে করাতে হয়। এর জন্য রোগীদের গুনতে হয় বাড়তি টাকা। অভিযোগ অনুযায়ী, নরমাল এক্সরে করে আদায় করা হচ্ছে ডিজিটাল এক্সরের বিল। ১৪ অক্টোবর এই প্রতিবেদক দেখতে পান, ডার্করুম সহকারী কাকলি শারমিন ডিজিটাল এক্সরের নামে ২০০ টাকা করে নিয়ে রোগী কল্যাণ সমিতির রসিদ দিচ্ছেন। কারণ জিজ্ঞেস করতেই একই বিভাগের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট জাহাঙ্গীর আলম উত্তর দেন, ‘হাসপাতালে ডিজিটাল ফিল্ম সরবরাহ না থাকায় সমাজসেবা অফিস বাইরে থেকে ফ্লিম কিনে আমাদেরকে দেয়। যে কারণে আমরা রোগী কল্যাণ সমিতির নামে আদায় করা সব টাকার একটি অংশ তাদের দেই। মাসে প্রায় ৫০ হাজার টাকার মতো তাদের দেওয়া হয়।’ এ ছাড়া অভিযোগে জানা যায়, সিটিস্ক্যান বাবদ নেওয়া হয় দুই হাজার টাকা। কিন্তু এর ফ্লিম না দিয়ে কম্পিউটারে অপশন দেখে রোগীদের রিপোর্ট দেওয়া হয়। যে কারণে সিটিস্ক্যানের পুরো টাকা সরকারি ঘরে জমা না হয়ে ডাক্তারদের পকেটে চলে যায়। এভাবে রেডিওলজিস্ট ও প্যাথলজি বিভাগ থেকে প্রতিদিন সাধারণ রোগীর কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে গড়ে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা। আল্টাসনোগ্রাম এবং প্যাথলজি বিভাগের একই চিত্র। এ দুই বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের কাছ থেকে বিধি মোতাবেক সরকারি ফি নেওয়া হলেও রসিদ দেওয়া হয় না। দিনে ২৫ থেকে ৩০ রোগীর নাম রেজিস্টারভুক্ত করে বাকি টাকা পকেটস্থ করা হয়। জানা যায়, প্রতিদিন এ দুই বিভাগে প্রায় শতাধিক রোগী চিকিৎসাসেবা নিয়ে থাকেন।

এসব বিষয়ে সিভিল সার্জন ডা. সালেহ আহমেদ বলেন, ‘সরবরাহ না থাকায় রোগীদের বাধ্য হয়ে বাইরে থেকে ওষুধ কিনতে হচ্ছে। ডাক্তার সংকটের বিষয়ে মাসিক মিটিং করে সংশ্লিষ্ট অধিদফতর ও মন্ত্রণালয়ে বলা হচ্ছে। ডাক্তারের পোস্টিং চেয়ে কয়েকবার পত্রও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনোভাবেই কাজ হচ্ছে না।’

সর্বশেষ খবর