শনিবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

গণপরিবহন ঘিরে চাঁদাবাজির উৎসব

সাঈদুর রহমান রিমন

গণপরিবহন ঘিরে চাঁদাবাজির উৎসব

মন্ত্রীর ধমক, মোবাইল কোর্টের তৎপরতার পাশাপাশি জনতার প্রতিরোধ সত্ত্বেও গণপরিবহনে যাত্রী ভাড়া কমছেই না। রাজধানীর প্রতিটি রুটসহ দূরপাল্লার কোচসমূহে শতকরা ২৫ ভাগেরও বেশি ভাড়া বাড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা জানিয়েছেন, যন্ত্রাংশসহ সবকিছুর মূল্য বৃদ্ধি, সিএনজির দাম ঊর্ধ্বমুখী, আছে চাঁদাবাজির মহোৎসব। ফলে গণপরিবহনে যাত্রী ভাড়া বাড়ানোর বিকল্প নেই। তারা অভিযোগ করে জানান, টার্মিনাল, স্ট্যান্ডসমূহে মাত্রাতিরিক্ত চাঁদাবাজি চলছে। পাশাপাশি যানবাহনে ভাড়া বৃদ্ধি ঠেকানোর নামেও নতুন করে চাঁদাবাজি শুরু করছে পুলিশ। এসব কারণে গাড়ি পরিচালনা ব্যয় প্রায় দেড় গুণ বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় যাত্রীদের কাঁধেই চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে অতিরিক্ত ভাড়ার বোঝা। সায়েদাবাদ টার্মিনাল, গুলিস্তান বাসস্ট্যান্ডসহ রাজধানীর সর্বত্রই পরিবহন সেক্টর ঘিরে চাঁদাবাজির মহোৎসব শুরু হয়েছে। সায়েদাবাদে বিভিন্ন রুট কমিটি ভাঙা-গড়ার নামে চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা মাত্রাতিরিক্ত চাঁদাবাজিতে মেতে উঠেছে। টার্মিনাল-সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করে জানিয়েছেন, সায়েদাবাদ টার্মিনাল থেকে দেশের পূর্ব-উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাসমূহের ৪৭টি রুটে চলাচলরত দুই সহস ক্ষাধিক যানবাহন থেকে দৈনিক ফ্রিস্টাইলে চলছে চাঁদাবাজি। এর মধ্যে চট্টগ্রাম, সিলেট, নোয়াখালী, কুমিল্লা, চাঁদপুর, যশোর, খুলনা, বরিশাল, ফরিদপুরসহ ৩২টি রুটে প্রতিদিন এক হাজার ২০০ কোচ। এ ছাড়া রাজধানীর গাবতলী টার্মিনাল, মহাখালী, উত্তরা, গাজীপুর, টঙ্গী, কালিগঞ্জ, শ্রীপুর, কাপাসিয়াসহ শহর ও শহরতলির অন্যান্য রুটে সহস ক্ষাধিক বাস-মিনিবাসের চলাচল রয়েছে।

যানবাহনের চালক, কন্ডাক্টর ও হেলপাররা জানায়, কোনো রুটের যানবাহনই চাঁদামুক্ত নয়। বরং চলাচলকারী সব গাড়িকে প্রতি ট্রিপেই ‘নির্ধারিত অঙ্কের চাঁদা পরিশোধের পর টার্মিনাল ছাড়তে দেওয়া হয়।’ সে ক্ষেত্রে দূরপাল্লার কোচ থেকে ১২০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদাবাজি চলছে এবং লোকাল সার্ভিসের প্রতিটি গাড়ি থেকে প্রতি ট্রিপে আদায় করা হচ্ছে ৫০০-৭০০ টাকার চাঁদা।

আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে চাঁদাবাজিসহ সবকিছুর মূল নিয়ন্ত্রক ছিলেন একজন এমপির ভাতিজা। কিন্তু প্রতিপক্ষ চাঁদাবাজ গ্রুপের হাতে তিনি নির্মম হত্যার শিকার হন। এখন ওই এমপিপুত্রের আশীর্বাদে খুনিরাই টার্মিনাল জবরদখল করে বেপরোয়া চাঁদাবাজিতে লিপ্ত হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

বিভিন্ন রুটে চলাচলরত গাড়ির মালিক-শ্রমিকরা জানান, কমিটি দখল ও মাত্রাতিরিক্ত চাঁদাবাজির অত্যাচারে মালিকরা পথে বসতে চলেছে। শ্রমিকদের আয়ও কমে গেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন মালিক বলেন, লাকসাম, কিশোরগঞ্জ, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন রুটে এখন গাড়িপ্রতি ১২০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হচ্ছে।

চাঁদাবাজির শিকার পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা প্রতিদিন চাঁদা প্রদানের বিস্তারিত তালিকা তুলে ধরছেন। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, পরিবহন-সংশ্লিষ্ট একটি কেন্দ্রীয় ফেডারেশনের নামে ৫০ টাকা, মালিক সমিতি ৮০ টাকা, শ্রমিক ইউনিয়ন ৪০ টাকা, টার্মিনাল কমিটি ২০ টাকা, কলার বয় ব্যবহার বাবদ ২০ টাকা, কেরানির ভাতা ২০ টাকা, মালিক-শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও কল্যাণের নামে ৫০ টাকা এবং একটি রাজনৈতিক দলের স্থানীয় দুই প্রভাবশালী নেতার নামে ৫০ টাকা করে চাঁদা নেওয়া হচ্ছে।

দাউদকান্দি রুটের মিনিবাস চালক লুৎফর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া রুটের বাসশ্রমিক বেলায়েত, হোসেন আলী, খবির মিয়াসহ কয়েকজন জানান, চাঁদা না দিয়ে কোনো গাড়ি টার্মিনাল থেকে বাইরে বের করার সাধ্য কারও নেই। চাঁদা নিয়ে টু শব্দ করলে নির্যাতনসহ টার্মিনালছাড়া হতে হয় বলেও পরিবহন শ্রমিকরা মন্তব্য করেন। একজন মালিক বলেন, টার্মিনাল দখলবাজি নিয়ে বহিরাগত অস্ত্রবাজদের আনাগোনা বেড়েছে। অনেক মালিকই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন।

গুলিস্তানে চাঁদাবাজ চক্রের দৌরাত্ম্য : গুলিস্তান স্ট্যান্ড ঘিরেও চাঁদাবাজির উৎপাত আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। পরিবহন সেক্টর ও ফুটপাথ বাজারকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা চাঁদাবাজ চক্রটি রীতিমতো স্থায়িত্ব লাভ করেছে। প্রতিটি সরকারের আমলেই তারা নানা কায়দা-কৌশলে ক্ষমতাসীন দলের ব্যানারেই বাধাহীন চাঁদাবাজিতে মেতে ওঠে।

নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, মাওয়াঘাট, দাউদকান্দি, গাজীপুর ও মুন্সীগঞ্জগামী বিভিন্ন পরিবহন থেকে দিনে ৮০০ থেকে ১১০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা ওঠানো হচ্ছে। ফ্লাইওভারের ঠিক মাথায় গাড়ি থামিয়ে যাত্রী ওঠানো-নামানোর সুযোগ দেওয়ার নামেও চলছে চাঁদাবাজি। নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, আদমজী, দাউদকান্দিসহ কয়েকটি রুটের বাস-মিনিবাসগুলো মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের গুলিস্তান লুপের ঠিক মুখেই অঘোষিত টার্মিনাল গড়ে তুলেছে। সেখানেই যাত্রী ওঠানামা করাতে একটি চক্র গাড়িপ্রতি ৩০০ টাকা করে চাঁদা হাতিয়ে নিচ্ছে। বাস-মিনিবাসের অঘোষিত এ স্ট্যান্ড গড়ে তোলার কারণে ফ্লাইওভারের বিরাট অংশ জুড়ে ভয়াবহ যানজটের সূত্রপাত ঘটছে। এদিকে গুলিস্তান বাসস্ট্যান্ডকেন্দ্রিক ফুটপাথ বাজার জুড়েও তিনটি চক্রের অব্যাহত চাঁদাবাজি চলছে। প্রতিদিন ফুটপাথের দোকানভেদে আদায় করা হচ্ছে ৩০০ থেকে হাজার টাকার চাঁদা। প্রকাশ্যেই লাইনম্যানরা এ টাকা উত্তোলন করে থাকে। গুলিস্তানের যাবতীয় চাঁদাবাজির নেপথ্যে রয়েছে কয়েকজন চিহ্নিত সন্ত্রাসী। তারা বরাবরই ক্ষমতাসীন দলের ব্যানার টানিয়ে চাঁদাবাজি চালালেও বাধা দেওয়ার যেন কেউ নেই। পুলিশসহ প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তার সঙ্গেই চাঁদাবাজ সন্ত্রাসীদের সখ্য থাকায় সব ধরনের প্রশাসনিক অভিযান থেকেও মুক্ত থাকে তারা।

 

সর্বশেষ খবর