শুক্রবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১৫ ০০:০০ টা

ব্যবসায় কেন মন্দা গতি

মানিক মুনতাসির ও আলী রিয়াজ

দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে কঠিন সময় চলছে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা রয়েছেন আস্থার সংকটে। একদিকে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের অসহযোগিতা অন্যদিকে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ থেকে দূরে সরে আছেন। পরিস্থিতি উত্তরণে সরকারের যে ভূমিকা দরকার তা নেই বলে অভিযোগ। অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলেছেন- মানিক মুনতাসির ও আলী রিয়াজ

 

পদে পদে হতে হয় হয়রানি

                         -খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ

 

 

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেন, একজন বিনিয়োগকারীকে বিনিয়োগ করতে পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হয়। ঘুষ ছাড়া বিদ্যুৎ সংযোগ পাওয়া যায়  না। গ্যাস সংকট দীর্ঘদিন থেকে। গ্যাস না পেলে কীভাবে বিনিয়োগ হবে। বিদ্যুৎ সংযোগ না পেলে কারখানার উৎপাদন কীভাবে হবে। এক যুগের বেশি সময় ধরে আলাদা অর্থনৈতিক অঞ্চল করার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত চালু করতে পারেনি সরকার। ব্যাংকে প্রচুর পরিমাণ মন্দ ঋণ আছে। তাই নতুন করে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ঝুঁকি নিতে চাইছে না। এসব সংকটের কারণে বিনিয়োগের মন্দা পরিস্থিতি কাটছে না। তিনি বলেন, আমাদের গ্যাস সংকট কাটানো সম্ভব হবে না। বিদ্যুৎ দিয়ে শিল্পের উৎপাদন করতে হবে। এখন দেশে কোনো বিদ্যুৎ ঘাটতি নেই। কিন্তু বিনিয়োগকারীরা বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। ছয় মাস এক বছর ঘুরেও সংযোগ পান না অনেকে। এ পরিস্থিতির উন্নতি করতে হবে। উদ্যোক্তারা যখনই বিনিয়োগের জন্য যান, তখন নানা ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয়। একজন উদ্যোক্তাকে এভাবে হয়রানি করলে তারা আগ্রহ হারাবে। তিনি বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো অসৎ ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে যারা আর ফেরত দিচ্ছে না। এসব ঋণ এখন মন্দ হিসেবে শ্রেণিকৃত হয়েছে। মন্দার কারণে বেসরকারি ব্যাংকগুলোও মন্দ ঋণের চাপ থেকে বের হতে পারেনি। ফলে নতুন করে ঋণ দেওয়ায় ঝুঁকি নিতে পারছে না। পুরনো টাকা দ্রুত আদায় করে ভালো প্রকল্প বাছাই করে ঋণ দিতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আলাদা অর্থনৈতিক অঞ্চল দ্রুত বাস্তবায়ন করে অবকাঠামো নির্মাণে ব্যবসায়ীদের জমি দিতে হবে। জমি সংকট না কাটাতে পারলে বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।


বিনিয়োগ পরিবেশের মান বাড়ছে না

                                                     -ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ

 

 

দেশে বর্তমানে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নেই বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে এ অবস্থার কোনো পরিবর্তনও হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা হলো, দেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশের মানোন্নয়ন হচ্ছে না। ফলে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে এগিয়ে আসছেন না। এ ছাড়া রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরলেও অনিশ্চয়তা কাটেনি। ফলে মানুষের মধ্যে এক ধরনের আস্থাহীনতা কাজ করছে। যার ফলে কেউ ঝুঁকি নিয়ে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। সবার মধ্যে পুঁজি হারানোর আশঙ্কা কাজ করছে। ব্যাংকগুলোও বড় ধরনের বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। ফলে ব্যাংক খাতেও অতিরিক্ত তারল্য বিরাজ করছে। তার মতে, ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ সংক্রান্ত ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) জরিপে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ায় খুব একটা চিন্তার কারণ নেই। কেননা দুই ধাপ পিছিয়েছে সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হলো, ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশের মানোন্নয়ন হচ্ছে না। এ জায়গায় সরকারকে এড্রেস করতে হবে। উদ্যোক্তাদের মাঝ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনার কোনো বিকল্প নেই। তিনি বলেন, এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে মানুষের মধ্যে আস্থার সংকট কাটাতে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। ব্যাংক খাতে নজরদারি বাড়াতে হবে। পাশাপাশি গ্যাস-বিদ্যুতের সমস্যার দ্রুত সমাধান করতে হবে। যদিও গ্যাস-বিদ্যুতের নতুন সংযোগ দিতে শুরু করেছে সরকার। এ প্রক্রিয়াকে আরও ত্বরান্বিত করতে হবে। ব্যাংক, বিনিয়োগ বোর্ড, সরকারি দফতরসহ অন্য সবাইকে নিজের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে। তাহলেই ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশের মানোন্নয়ন করা সম্ভব।


বিদ্যুৎ আছে, সংযোগ পাওয়া যাচ্ছে না

                                                                - মীর নাসির হোসেন

 

 

বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন বলেছেন, বিনিয়োগের উন্নতির জন্য শুধু পদক্ষেপই নেওয়া হয়। বাস্তবে অগ্রগতি খুব সামান্য। পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে কিন্তু ব্যবসায়ীরা তা পাচ্ছেন না। আগে থেকেই গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। আমাদের শিল্পায়ন হয়েছে গ্যাসনির্ভর। কিন্তু গ্যাসের দাম দ্বিগুণ করা হয়েছে। দীর্ঘদিন থেকে চললেও ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেনের রাস্তার কাজ এগোচ্ছে না, বিনিয়োগের জন্য জমি সংকট। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বাংলাদেশে শিল্পায়নে বিদ্যুৎ সংকটের কথা প্রথমেই বলা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে দুই বিদেশি হত্যায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শঙ্কিত। একই সঙ্গে ব্যাংক টাকা নেওয়ার লোক পাচ্ছে না। যারা বিনিয়োগ করে টাকা ফেরত দিতে পারবে এমন উদ্যোক্তা পাওয়া যাচ্ছে না। এসব কারণে বিনিয়োগ পরিস্থিতিতে মন্দা অবস্থা তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, জ্বালানি সংকটের দ্রুত সমাধান না হলে কোনো বিনিয়োগকারীই আসবেন না। অনেক প্রতিষ্ঠানে গ্যাস থাকলেও প্রেসার কম। গ্যাস ব্যবহার করতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। ক্যাপটিভ পাওয়ারের কথা বলা হয় কিন্তু ব্যবসায়ীরা তার অনুমতি পান না। গ্যাসনির্ভরতা থেকে বিদ্যুৎনির্ভর শিল্প করতে হলে সংযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে দ্রুত কাজ করতে হবে। জমি সংকট কাটিয়ে ব্যবসায়ীদের উপযুক্ত জমি অবকাঠামো নিশ্চিত করতে হবে। কয়েকটি দেশের দূতাবাস তাদের নাগরিকদের বিষয়ে সতর্কতা জারি করেছে। বাংলাদেশে একটি শঙ্কা কাজ করছে। এ শঙ্কা দূর করতে হবে।


ব্যাংকগুলো অল্পতেই মুনাফা করতে চায়

                                                   - আলমগীর শামসুল আল আমিন

 

 

আবাসন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন রিহ্যাবের সভাপতি আলমগীর শামসুল আল আমিন মনে করেন, দেশের ব্যাংকগুলো স্বল্পমেয়াদি বিনিয়োগ করে মুনাফা করতে চায়। বড় ধরনের কোনো বিনিয়োগ বা দীর্ঘমেয়াদি কোনো বিনিয়োগে ব্যাংক আগ্রহ দেখায় না। ফলে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশের উন্নতি হচ্ছে না। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে ব্যাংকগুলোকে বিনিয়োগে আসতে হবে। টাকা বসিয়ে না রেখে উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করতে হবে। প্রয়োজনে সরকারকে ব্যাংকগুলোকে বলতে হবে তোমরা বিনিয়োগ কর। তিনি মনে করেন, ব্যাংকিং সিস্টেম তার সঠিক দায়িত্ব পালন করছে না। শুধু মুনাফার কথা ভাবছে। কিন্তু কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের কথা ভাবছে না। ফলে বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। শামসুল আল আমিন মনে করেন, বিশেষ করে আবাসন খাতে ব্যাংকগুলো কোনো ধরনের সহযোগিতাই করছে না। ব্যবসায়ী-ভোক্তা সবাইকে ব্যাংকগুলোর উচিত সহযোগিতা করা। এক্ষেত্রে হোমলোন বাড়াতে হবে। ক্রেতাদের সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। কম সুদে ফ্ল্যাট কেনার ঋণ দিতে হবে। এ খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত আরও ২৭০টি শিল্প প্রায় ধ্বংসের মুখে পতিত হয়েছে। এ অবস্থা থেকে বেরোতে হলে ব্যাংক খাতের বিশেষ সহযোগিতা প্রয়োজন। ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর আইএফসির জরিপে যে ফলাফল এসেছে, বাস্তব অবস্থা তার চেয়েও খারাপ বলে মনে করেন তিনি। গ্যাস-বিদ্যুৎ সমস্যার কিছুটা সমাধান হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরছে খুবই ধীর গতিতে। এক্ষেত্রে সরকারের উচিত বিনিয়োগকারীদের সহযোগিতা করা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর