শুক্রবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

পাটের ব্যাগ ব্যবহারে ৩০ নভেম্বর থেকে অভিযান

সুদিন ফিরে আসবে : মির্জা আজম

শিমুল মাহমুদ

পাটের ব্যাগ ব্যবহারে ৩০ নভেম্বর থেকে অভিযান

পাটের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে এবং ধান, চাল, গম, ভুট্টা, সার, চিনিঃ এ ছয়টি পণ্যে পাটের মোড়ক ব্যবহার নিশ্চিত করতে ৩০ নভেম্বর থেকে সারা দেশে সাঁড়াশি অভিযান শুরু হচ্ছে। ‘ম্যান্ডেটরি প্যাকেজিং অ্যাক্ট, ২০১০’ নামের আইনটি কার্যকর করতে ইতিমধ্যে ১০টি মনিটরিং টিম গঠন করেছে সরকার। পাটকল রয়েছে এবং যেখানে পাটের বস্তা ব্যবহার হয় এমন ৩১টি জেলায় কাজ করবে এসব টিম। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে ছয় পণ্যে পাটজাত মোড়ক ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে। এর মধ্য দিয়ে দেশে পাটের হারানো সুদিন ফিরে আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। আইনটি বাস্তবায়ন হলে দেশের পাটকলগুলোয় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার কাজের সুযোগ  সৃষ্টি হবে এবং পাটকলগুলো সারা বছর সচল থাকবে। জানা গেছে, ম্যান্ডেটরি প্যাকেজিং অ্যাক্ট কার্যকর করতে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সঙ্গে বৈঠক করেছে। তারা আইনটি বাস্তবায়নে এগিয়ে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দেশনা জারি করেছে, ধান, চাল, গম, ভুট্টা, সার ও চিনি ব্যবসায়ীরা পাটের ব্যাগ ব্যবহার না করলে ব্যাংক ঋণ পাবেন না। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নিশ্চিত করেছে, পাটের ব্যাগ ব্যবহার না করলে লাইসেন্স বাতিল হবে রাইস মিল, হাসকিং ও চাতাল মালিকদের। পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র পেতে প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে মুচলেকা দিতে হবেঃ ডব্লিউপিপি ব্যাগ উৎপাদন ও সরবরাহ করবে না। এভাবে অনেক মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট রয়েছে নতুন এ আইনটি বাস্তবায়নে। এ লক্ষ্যে দেশের সড়ক-মহাসড়ক, চাল উৎপাদনকারী এলাকাসহ রাজধানীর প্রবেশপথে সাঁড়াশি অভিযান চালাবে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম নতুন আইন বাস্তবায়ন ও পাট খাতের ভবিষ্যৎ নিয়ে সম্প্রতি কথা বলেন বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ম্যান্ডেটরি প্যাকেজিং অ্যাক্ট বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে দেশে পাটের সুদিন ফিরে আসবে। সরকারি-বেসরকারি পাটকলগুলো সারা বছর কর্মমুখর থাকবে। বর্তমানে আমরা যে পরিমাণ পাট রপ্তানি করি, নতুন আইনটি বাস্তবায়ন হলে সে পরিমাণ পাটের বাজার দেশেই সৃষ্টি হবে।

মির্জা আজম বলেন, পাট নিয়ে আমরা নতুন করে মাঠে নেমেছি। ‘ম্যান্ডেটরি প্যাকেজিং অ্যাক্ট’ ২০১০ সালে পাস করা হয়েছিল। এর আওতায় ধান, চাল, গম, ভুট্টা, সার ও চিনিঃ এ ছয়টি পণ্যের মোড়কীকরণে পাটের ব্যাগ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আগামী ৩০ নভেম্বর থেকে সারা দেশে অভিযান চলবে। ছয় পণ্যের মোড়কে পাটের ব্যাগ ব্যবহার করা না হলে কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। তিনি বলেন, আইনটি ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। আমরা ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারিতে দায়িত্ব নেওয়ার পর দু-এক বার উদ্যোগও নিয়েছিলাম। কিন্তু সে সময় আমাদের উদ্যোগটি সফলতার মুখ দেখেনি। সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ থেকে পরিবেশের ওপর সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘চ্যাম্পিয়ন্স অব দি আর্থ’ পেলেন। এটা পাওয়ার পর আমরা মনে করেছি, বাংলাদেশের পরিবেশ রক্ষায় বিশাল দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে আমাদের ওপর। যেহেতু প্রধানমন্ত্রী পরিবেশ রক্ষায় এত বড় অর্জন নিয়ে এসেছেন দেশের জন্য, সেহেতু আমাদের পরিবেশ সংরক্ষণে ম্যান্ডেটরি প্যাকেজিং অ্যাক্টটি কার্যকর করতে হবে। তিনি বলেন, পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের আইন হলেও এটি কার্যকরে অন্য মন্ত্রণালয়গুলোরও সহায়তা প্রয়োজন। আমরা এ নিয়ে আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক করেছি। কারণ, এ আইনটি বাস্তবায়নের সঙ্গে অনেক মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের যেসব স্টেকহোল্ডার আছেন, যেমন রাইস মিল মালিক, চাতাল মালিক, আড়ত মালিক, খাদ্য বিভাগের লাইসেন্সের মাধ্যমে তারা যে ব্যবসাটা করেন তাদের জন্য খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা জারি করা হয়েছে, ছয়টি পণ্যের ক্ষেত্রে ‘ম্যান্ডেটরি প্যাকেজিং অ্যাক্ট’ ফলো না করলে তাদের লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবে। নতুন লাইসেন্স পাওয়ার ক্ষেত্রেও এটি ফলো করতে হবে। মাঠ পর্যায়ের ইন্সপেক্টর লেভেলের কেউ যদি নিশ্চিত হন নির্দিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠান এটি বাস্তবায়ন করছে না তিনি রিপোর্ট করলে সঙ্গে সঙ্গেই তার লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠকের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে যে সিদ্ধান্ত হয়েছে তা হলো, ছয়টি পণ্যের ক্ষেত্রে যারা ব্যাংক ঋণ নেবেন তারা আইনটি ফলো না করলে তাদের ব্যাংক ঋণ দেওয়া হবে না। ইতিমধ্যে এ সম্পর্কিত একটি নির্দেশনাসংবলিত চিঠি সব ব্যাংকের শাখা পর্যায়ে ইস্যু করা হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ ছয়টি পণ্য যারা আমদানি-রপ্তানি করেন তারা আইনটি ফলো না করলে তাদের এলসি বাতিল হয়ে যাবে। ইতিমধ্যে এলসির গায়ে এ নির্দেশনা সম্পর্কিত সিল মেরে দেওয়া হচ্ছে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমাদের বৈঠক হয়েছে, তাদের যত নৌ ও স্থল বন্দর, ফেরিঘাট রয়েছে, তাদের আওতার মধ্যে ‘ম্যান্ডেটরি প্যাকেজিং অ্যাক্ট’ অনুসরণ না করলে তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ আইন বাস্তবায়নে সরকারের যত হাত আছে সব কাজে লাগাতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মির্জা আজম বলেন, বর্তমানে জেলায় জেলায় ডিসিরা যে মাসিক সমন্বয় সভা করেন তাতে ম্যান্ডেটরি এজেন্ডা হচ্ছে ‘ম্যান্ডেটরি প্যাকেজিং অ্যাক্ট’ ফলোআপে রাখা। গত জেলা প্রশাসক সম্মেলনেও বিষয়টি ডিসিদের বলা হয়েছে। কেবিনেট ডিভিশন থেকে এ আইন বাস্তবায়নে সরকারের বিভিন্ন দফতরকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমাদের বৈঠকের পর র‌্যাব-পুলিশসহ সবাইকে একযোগে কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম বলেন, এ আইন মানার পক্ষে সবাই। কেউ এ আইন মানার বিরোধিতা করছে না। পাটের ব্যাগ ব্যবহারের মধ্যে দেশপ্রেম রয়েছে, দেশাÍবোধ রয়েছে। এটা পরিবেশবান্ধব। বন্ধ পাটকলগুলো এখন চালু হচ্ছে। এ আইন বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে প্রতি বছর ৫৫ কোটি জুট ব্যাগের প্রয়োজন পড়বে। এর ফলে ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকার পাট আমরা স্থানীয়ভাবে কনজিউম করতে পারছি। এটা প্রতি বছর আমরা যে পরিমাণ পাট রপ্তানি করি তার প্রায় সমান। মির্জা আজম বলেন, এ কারণে ‘ম্যান্ডেটরি প্যাকেজিং অ্যাক্ট’ বাস্তবায়নে আমরা যে উদ্যোগ নিয়েছি তার ফলে পাটকল শ্রমিকদের মুখে হাসি ফুটেছে। পাটকলগুলো নতুন করে সচল হয়েছে। কিছু পাটকল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেক শ্রমিক বেকার হয়ে বাড়ি চলে গিয়েছিল। তারা অন্য পেশায় চলে যাচ্ছিল। কেউ রিকশা চালাচ্ছে, কেউ মুদি দোকানে কাজ করছে। এখন জুট মিল এলাকাগুলোয় মাইকিং করে তাদের মিলে ডাকা হচ্ছে, তোমরা আসো, লুম বন্ধ, কাজে যোগ দাও। ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে মুখ্যসচিব স্বাক্ষরিত অনুশাসন জারি করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, পাটশিল্পের বিকাশের স্বার্থে যথাসম্ভব দেশীয় সংস্কৃতি ধারণ করে পরিবেশবান্ধব পাটজাত পণ্যের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী বলেন, যেহেতু আগামী আগস্টের আগে নতুন পাট আসবে না সে জন্য আমরা আপাতত এক মাসের জন্য কাঁচা পাট রপ্তানি বন্ধ করেছি। আগামী নয় মাসে আমাদের মিলগুলোয় দেড় লাখ টন কাঁচা পাটের প্রয়োজন হবে। আমরা বিভিন্নভাবে তথ্য নিচ্ছি আমাদের দেশে বর্তমানে কী পরিমাণ পাটের মজুদ আছে। আমাদের যদি দেড় লাখ টন পাট মজুদ না থাকে তাহলে পাটের অভাবে পাটকল বন্ধ হয়ে যাবে। সে জন্য আমরা যাচাই-বাছাই করছি কী পরিমাণ পাট আছে। সঠিক তথ্য যাচাই-বাছাই চলছে। যদি মনে হয় আমাদের যে পাটের প্রয়োজন, আগামী নয় মাস ছালা বানানোর জন্য তার চেয়ে বেশি পাট আছে, তাহলে এক মাস পর আবার রপ্তানি চালু হয়ে যেতে পারে। যদি আমরা বুঝতে পারি বাকি সময়টায় আমাদের ছালা বানানোর পাটের মজুদ নেই তাহলে কাঁচা পাট রপ্তানির নিষেধাজ্ঞাটা অব্যাহত থাকবে। তিনি বলেন, বর্তমানে কৃষক পাটের ভালো দাম পাচ্ছে। আমরা আশা করছি আগামী বছর পাটের আবাদ আরও বেশি হবে। ‘ম্যান্ডেটরি প্যাকেজিং অ্যাক্ট’ কার্যকর করা গেলে আমাদের সরকারি-বেসরকারি পাটকলগুলো সারা বছর কর্মমুখর থাকবে। পাট ফিরে পাবে সেই হারানো সুদিন। মির্জা আজম বলেন, পাট নিয়ে প্রধানমন্ত্রী আমাদের অনেক নির্দেশনা দিয়েছেন। এর মধ্যে বন্ধ পাটকলগুলো চালু করার নির্দেশ রয়েছে। এ ছাড়া চলতি অর্থবছরে বিভিন্ন সমস্যা তৈরি হয়েছিল। কিছু দিন আগে ভারত বাংলাদেশ থেকে কাঁচা পাট আমদানিতে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করে। সে কারণে কিছু জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারের বিশেষ করে আমাদের পাট আমদানিকারক কিছু দেশে মন্দা অবস্থা তৈরি হয়েছে। তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে পাট রপ্তানি কিছুটা কমে গিয়েছিল। এসব কিছু সামলে নিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। তিনি বলেন, আমাদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর সবচেয়ে বড় নির্দেশনা হলো, পরিবেশ রক্ষার্থে ২০১০ সালে করা ‘ম্যান্ডেটরি প্যাকেজিং অ্যাক্ট’টি বাস্তবায়ন করতে হবে। এ আইন বাস্তবায়ন হলে পাট নিয়ে আমাদের আর কোনো হতাশা থাকবে না। আমরা পাটপণ্যের বহুমুখীকরণে মনোযোগ দিতে পারব।

সর্বশেষ খবর