মঙ্গলবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

কারাভোগ ও গ্রেফতার আতঙ্কে প্রার্থী সংকট বিএনপিতে

মাহমুদ আজহার

হবিগঞ্জ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান পৌরসভার মেয়র জি কে গউছ। সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যা মামলায় প্রায় এক বছর ধরে কারান্তরীণ। দলের ‘সবুজ সংকেত’ পেলে কারাগারে থেকেই আসন্ন পৌরসভা নির্বাচনে অংশ নেবেন তিনি। স্থানীয় নেতা-কর্মীদের মুখে মুখেও তার নাম। এখনো সেই অর্থে গণসংযোগ শুরু না করলেও তার নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করে স্থানীয় বিএনপির একাংশ পোস্টারও সাঁটিয়েছেন নগরীতে। যশোর নগর বিএনপির সভাপতি ও বর্তমান পৌর মেয়র মারুফুল ইসলাম। নাশকতার এক মামলায় সম্প্রতি তিনি কারামুক্তি লাভ করেন। বের হওয়ার পরপরই তার বিরুদ্ধে নাশকতার আরেকটি মামলা করা হয়। এরপর থেকেই পালিয়ে বেড়াচ্ছেন মারুফুল ইসলাম। তার বিরুদ্ধে আরও বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে। সারা দেশে বিএনপির সম্ভাব্য মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের চালচিত্র প্রায় একইরকম। মামলা, হামলা আর গ্রেফতারে ‘যোগ্য’ প্রার্থী সংকটে পড়েছে বিএনপি। ডিসেম্বরের শেষদিকে হতে যাচ্ছে অন্তত ২৪০ পৌরসভার নির্বাচন। বিএনপির অভিযোগ, নির্বাচনকে ঘিরে তাদের প্রায় তিন শতাধিক নেতা-কর্মী গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে পৌর মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থী দুই শতাধিক। গ্রেফতার আতঙ্ক আর হুলিয়া নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন অনেকেই। সম্ভাব্য প্রার্থীদের প্রচারে জড়িত নেতা-কর্মীরাও ঘরছাড়া। সব মিলিয়ে অপেক্ষাকৃত ভালো প্রার্থী খুঁজতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে বিএনপি।

বিএনপির নীতি নির্ধারকরা জানান, স্থানীয় নির্বাচনে বিএনপি বরাবরই অংশ নিয়েছিল। এর আগে স্থানীয় নির্বাচনে বিএনপি জয়লাভও করেছে। আবার সরকার বিএনপির বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছে অধিকাংশ এলাকায়। এবার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। তবুও নির্বাচনে না যাওয়ার সুযোগ নেই। তাছাড়া স্থানীয় সরকারে ক্ষমতার পালাবদল হয় না। যত প্রতিকূল পরিস্থিতিই থাকুক না কেন, স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে অংশ নিলে তৃণমূল কিছুটা হলেও চাঙ্গা হয়। এ জন্যই খালি মাঠে ক্ষমতাসীনদের গোল দিতে না দেওয়ার পক্ষে তারা। দিলে রাজনৈতিকভাবে দলটি আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করেন নেতারা। জানা যায়, বিএনপি সমর্থিত বর্তমানে পৌরসভার মেয়র ও কাউন্সিলদের একটি অংশ স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ প্রশাসনের সঙ্গে ‘যোগসাজশ’ করে নিজেরা আবারও প্রার্থী হওয়ার জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিএনপির বিগত তিন মাসের আন্দোলনে মাঠে ছিলেন না তারা। বিএনপির সাবেক মন্ত্রী-এমপিদের অনুকম্পা নিয়ে তারা আবারও প্রার্থী হতে কেন্দ্রে ধরনা দিচ্ছেন। ঢাকার নেতাদের বাসায় বাসায় দেখা যায় অনেক প্রার্থীকে। কেন্দ্রীয় বিএনপির একাধিক নেতা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মেয়র, কাউন্সিলর, কিংবা চেয়ারম্যান পদে থেকে যারা এলাকার নেতা-কর্মীদের উপেক্ষা করে সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে রাজনীতি করছেন, তাদের তালিকা বিএনপি চেয়ারপারসনের কাছে রয়েছে। ওইসব এলাকায় ত্যাগী নেতাদের তালিকাও তৈরি করা হয়েছে। তৃণমূল বিএনপির অভিযোগ, বিগত সময়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিএনপির সমর্থন নিয়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাও আন্দোলন বাধাগ্রস্ত করেছে। মাঠের নেতা-কর্মীদের পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে দেওয়ার অভিযোগও আছে অনেকের বিরুদ্ধে। আগামীতে দলের রাজনীতিতে কিংবা তাদের মেয়র, কাউন্সিলর কিংবা চেয়ারম্যান পদে সমর্থন দেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা হবে। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মো. শাহজাহান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিগত ৫ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনসহ সাম্প্রতিককালে যতগুলো স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয়েছে, কোনোটাতেই জনমতের প্রতিফলন ঘটেনি। দেশে-বিদেশে কোথাও বিশ্বাসযোগ্যতা পায়নি। জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। জনমনে বদ্ধমূল ধারণা, এখন সরকার যেভাবে চাইবে নির্বাচন সেভাবেই হবে। এখানে ভোটারের কোনো গুরুত্ব নেই। শুধু তাই নয়, ৫ জানুয়ারির আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিরোধী দলের অসংখ্য জনপ্রতিনিধি সরকার বরখাস্ত করে সরকার সেখানে নিজেদের পছন্দমতো লোক বসিয়েছে। ভোটারদের বৃদ্ধাঙ্গলী প্রদর্শন করা হয়েছে। এখানে ভোটারদের কোনো মূল্য নেই। এরপরও যদি কেউ নির্বাচিত হয়, তাদের বরখাস্ত করা হচ্ছে। এ অবস্থায় আসন্ন পৌর বা ইউপি নির্বাচন নিয়ে মন্তব্য করার কোনো মূল্য নেই।

বিএনপির এই নেতা বলেন, দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আগে সরকারকে একটি বিষয় পরিষ্কার করতে হবে, দলীয় প্রতীকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের যেমন কলমের খোঁচায় বরখাস্ত করা যায় না, তেমনই পৌরসভায় নির্বাচিত মেয়রদের স্থানীয় সরকারের এক কলমের খোঁচায় বরখাস্ত করা যাবে না। সরকার যে এ বিষয়ে অঙ্গীকার করবে, তার প্রমাণস্বরূপ বহিষ্কার হওয়া অসংখ্য মেয়রদের স্বপদে ফিরিয়ে আনতে হবে। কারারুদ্ধ হওয়া মেয়রদের মুক্তি দিতে হবে। সংসদসহ সব গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবিতে চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে আসন্ন পৌর নির্বাচনকে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করতে পারে বিএনপি। তাও নির্ভর করবে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরামের ওপর।  সিরাজগঞ্জ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোকাদ্দেস আলী। পৌর নির্বাচনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী। নাশকামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে সম্প্রতি তাকে পৌর মেয়রের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। বেশ কিছুদিন কারাগারেও ছিলেন। সম্প্রতি জামিনে মুক্তি পেয়ে বেরিয়ে এলেও এলাকাছাড়া বিএনপির এই নেতা। তার বিরুদ্ধে প্রায় ডজনখানেক মামলা রয়েছে। জামালপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ওয়ারেছ আলী মামুন। বর্তমান পৌর মেয়রও তিনি। নাশকতার দুই মামলায় জামিন নিয়ে আসন্ন পৌর নির্বাচনে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। সাতক্ষীরা জেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক তাসকিন আহমেদ চিশতী। আসন্ন পৌর নির্বাচনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী। ক্লিন ইমেজের তরুণ এ নেতার বিরুদ্ধে কোনো মামলা না থাকলেও সর্বশেষ তিন মাস সরকারবিরোধী আন্দোলনে স্থানীয় নেতা-কর্মীদের ওপর ঝড় বয়ে গেছে। এ ছাড়া নিজ দলীয় এক নেতা খুন হওয়াকে কেন্দ্র করে কেউ কেউ কারাগারে, অনেকেই পলাতক। অনেক নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে নাশকতার মামলার খড়গও ঝুলছে। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, নতুন করে সারা দেশে নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে গ্রেফতার অভিযান চলছে। অতীত মামলায় যারা উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেয়েছিলেন, মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তারাও নিম্ন আদালতে যেতে ভয় পাচ্ছেন। কারণ নিম্ন আদালতে গেলে জামিন বাতিল করে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এ অবস্থায় স্থানীয় বিএনপির নেতা-কর্মীরা নির্বাচনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। এ প্রসঙ্গে বিএনপির মুখপাত্র ড. আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, ‘দলীয় প্রতীকে পৌর নির্বাচনে বিরোধী দলের প্রার্থীরা যাতে নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে সরকার সেই ব্যবস্থাকে পাকাপোক্ত করতে গণগ্রেফতার শুরু হয়েছে। দেশব্যাপী ধরপাকড়ে নির্বাচনের পরিবেশ বিঘিœত হবে। বিরোধী দলের পক্ষে নির্বাচনে অংশ নেওয়া এবং প্রচারণা চালানো দুরূহ হয়ে উঠবে। দলের সম্ভাব্য প্রার্থী, পোলিং এজেন্ট, নির্বাচনী এজেন্ট এবং নির্বাচনী প্রচারণার কর্মী-সমর্থকরা এরই মধ্যে গ্রেফতার হয়ে পড়েছে। অন্যরাও জুলুম নির্যাতনের আশঙ্কায় এলাকাছাড়া হয়ে পড়েছেন। এ অবস্থায় গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে।

সর্বশেষ খবর