মঙ্গলবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

বন্ধ হয়নি ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ

দেখার কেউ নেই

শিমুল মাহমুদ

বিশ্ববাজারে যখন বাংলাদেশি ওষুধের গ্রহণযোগ্যতা ও নির্ভরতা বাড়ছে তখন দেশের বাজারেই নকল, ভেজাল, নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। ওষুধ বাণিজ্যের এ অরাজক পরিস্থিতির জন্য ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের লাইসেন্সপ্রাপ্ত ওষুধ কারখানাগুলোরই মুখ্য ভূমিকা রাখার অভিযোগ উঠেছে। কঠোর মনিটরিং ও কার্যকর শাস্তির ব্যবস্থা না থাকায় ভেজালকারীরা বেপরোয়া। যেসব কোম্পানি নকল ও ভেজাল ওষুধ তৈরির দায়ে অভিযুক্ত সেগুলো ঘুরেফিরে বার বার এ তৎপরতায় লিপ্ত হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রাজধানীসহ সারা দেশে মাঝেমধ্যেই নকল ওষুধ কারখানায় অভিযান চালায়। ইতিমধ্যেই এমন অনেক কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে মানহীন ওষুধ প্রস্তুতকারক অনেক কোম্পানির। কিন্তু অনেক কোম্পানি আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে আবার নিম্নমানের ওষুধ তৈরি করছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। অনেকে আবার নাম-ঠিকানা পাল্টে নতুন উদ্যমে নকল ও ভেজাল ওষুধ উৎপাদনে নেমে পড়ে। নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ বিপণনের ক্ষেত্রে রাজধানীর মিটফোর্ডকেন্দ্রিক ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট, ফার্মেসিগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্টস অ্যাসোসিয়েশনের কোনো কোনো নেতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার অভিযোগ রয়েছে। দেশজুড়ে সংঘবদ্ধভাবে গড়ে উঠেছে  নকল, ভেজাল ওষুধের বিস্তৃত নেটওয়ার্ক। ওষুধ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে এ অপরাধীদের তৎপরতা কমে আসবে। গত ১০ জুলাই মধ্যরাতে মিটফোর্ডের পাইকারি ওষুধের মার্কেটে কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্টস অ্যাসোসিয়েশনের ঢাকা শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবু বক্কর খান মিলনের গুদামে অভিযান চালিয়ে বিপুল ভেজাল ও আমদানিনিষিদ্ধ ওষুধ উদ্ধার করে পুলিশ, যার দাম প্রায় ১০ কোটি টাকা। দেশের ওষুধ বাজারে সরকারের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ না থাকায় রাজধানীসহ সারা দেশের ফার্মেসিগুলোয় নিয়মিত বিক্রি হচ্ছে ভেজাল, নকল ও নিম্নমানের ওষুধ। খোদ রাজধানী ঢাকা এবং পাশের এলাকাগুলোতেও ভেজাল, নকল ওষুধের কারখানা গড়ে উঠেছে। গত কয়েক মাসে ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার বিভিন্ন কারখানায় অভিযান চালিয়ে কোটি কোটি টাকার ওষুধ বিনষ্ট করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। কিন্তু পুলিশি অভিযানে এসব কারখানা বন্ধ হলেও ঠিকানা পাল্টে পুরনো উদ্যোক্তারাই আবার ভেজাল ও নকল বাণিজ্যে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। গত ৭ মে রাজধানীর বনানীতে লাইসেন্সবিহীন একটি ওষুধ তৈরির কারখানায় র‌্যাব-২-এর ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালান। অভিযানে ওষুধ প্রশাসনের অনুমোদন না থাকা ও নিম্নমানের ওষুধ তৈরির অপরাধে প্রতিষ্ঠানটি সিলগালা ও এর মালিক মো. মঈন উদ্দিনকে আটক করে জেল-জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ ছাড়া ১১ মে মুন্সীগঞ্জের টঙ্গিবাড়ীতে গ্লোব ল্যাবরেটরি নামের একটি প্রতিষ্ঠানে অবৈধভাবে উৎপাদিত কোটি টাকা মূল্যের ওষুধ ধ্বংস করে স্বাস্থ্যবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির গঠিত বিশেষজ্ঞ দল। এ সময় প্রতিষ্ঠানটির শ্রমিক সাইদুর রহমানকে আটক করে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। মিটফোর্ডের কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, নকলবাজদের গ্রেফতারের পর তারা আদালত থেকে জামিনে ছাড়া পেয়ে আবারও নকল, ভেজাল ওষুধ তৈরি ও বিক্রিতে জড়িত হন। সূত্র জানায়, ভেজাল, নকল, নিম্নমানের ওষুধ শনাক্ত ও দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলোর শৈথিল্যের অভিযোগ রয়েছে। দেশে দুটি ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরির একটি মহাখালীতে ও অন্যটি চট্টগ্রামে। নকল, ভেজাল ওষুধের বিস্তারের পরও এ ল্যাবের ব্যবহার খুব কমই হয়। অন্যদিকে মানহীন, নকল ওষুধ জব্দ করে ল্যাবরেটরিতে নেওয়ার পর সেগুলো বদলে ফেলা হয়। পরীক্ষার আগেই পাল্টে যায় জব্দ করা ওষুধ। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর যোগসাজশে এটি করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী, বিশ্বের ভেজাল ও নিম্নমানের ৩৫ ভাগ ওষুধ তৈরি হয় ভারতে। এর বার্ষিক বাজার মূল্য ৪ হাজার কোটি রুপি বা ৬ হাজার কোটি টাকা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৩ ভাগ ভেজাল বা নিম্নমানের ওষুধ তৈরি হয় নাইজেরিয়ায়। দেশটির মোট ওষুধের ৪১ ভাগই ভেজাল বা নিম্নমানের। পাকিস্তানে তাদের মোট ওষুধের ১৫ ভাগ ভেজাল বা নিম্নমানের, যার বাজার মূল্য ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। একটি বেসরকারি সংস্থার তথ্যমতে, বাংলাদেশে ভেজাল বা নিম্নমানের ওষুধের বার্ষিক বিক্রি প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা, যা মোট বিক্রির প্রায় শতকরা ১০ ভাগ। ওষুধ খাতে দুর্নীতি, আইন প্রয়োগে শৈথিল্য, দুর্বল বিচারব্যবস্থা, শক্ত আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের পাশাপাশি প্রযুক্তিগত অসমর্থতা, দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব এবং অজ্ঞতা ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ বাজার বিস্তারের প্রধান কারণ বলে সূত্র জানায়।

জানা যায়, ভেজাল, নকল ও মেয়াদোক্তীর্ণ ওষুধের বিস্তৃতি মফস্বলের ওষুধের বাজারজুড়ে। মফস্বলের ওষুধ বাজারে কারও নিয়ন্ত্রণ না থাকায় সাধারণ মানুষের অজ্ঞতার সুযোগে নকল ও নিম্নমানের ওষুধ সহজেই ঠাঁই করে নিয়েছে। এসব নিম্নমানের ভেজাল ও নকল ওষুধ ব্যবহার করে দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ অসুস্থতায় আরোগ্যলাভের পরিবর্তে নতুন করে স্বাস্থ্যগত জটিলতায় পড়ছেন। বাড়তি টাকা খরচ করেও কাক্সিক্ষত সুফল পাচ্ছেন না তারা। ওষুধের বাজারে পর‌্যাপ্ত তদারকি ও নজরদারি না থাকায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন ওষুধ খাতের বিশেষজ্ঞরা। একশ্রেণির ওষুধ ব্যবসায়ী ভেজাল, নকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ একটি সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেডের মাধ্যমে মফস্বলের ওষুধ বাজারে ছড়িয়ে দিচ্ছে। এ ছাড়া সরকারি হাসপাতালের মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধও প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিক্রি হচ্ছে অবাধে। ওষুধের মেয়াদ টেম্পারিংয়ের মাধ্যমে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি করছে মফস্বলের ফার্মেসিগুলোতে। মাঝেমধ্যে এ ওষুধ সিন্ডিকেটের হোতারা ধরা পড়লেও সহজেই জামিনে বেরিয়ে আবার পুরনো অপকর্মে লিপ্ত হন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক ইতোপূর্বে বলেন, একসময় নকল, ভেজালের সঙ্গে জড়িত লাইসেন্সবিহীন প্রতিষ্ঠান ধরা পড়ত। এখন ওষুধ প্রশাসন থেকে লাইসেন্স পাওয়া প্রতিষ্ঠানই ধরা পড়ছে। কার্যকর মনিটরিং ও কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা থাকলে এটা রোধ করা যেত।

সর্বশেষ খবর