বুধবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

অনিয়ম-ভোগান্তির আখড়া ময়মনসিংহ হাসপাতাল

সৈয়দ নোমান, ময়মনসিংহ

অনিয়ম-ভোগান্তির আখড়া ময়মনসিংহ হাসপাতাল

অনিয়ম ও ভোগান্তির আখড়ায় পরিণত হয়েছে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। রোগীদের অভিযোগ, বহির্বিভাগের আবাসিক সার্জন ও চিকিৎসকরা নিজেদের স্বার্থে হাসপাতাল থেকে কৌশলে রোগী ভাগিয়ে দিচ্ছেন নিজেদের পছন্দসই ক্লিনিক বা প্যাথলজিতে। সেবার বদলে রোগীদের গলা কাটছেন তারা। ফলে ওয়াকিবহালরা তাদের নামের শেষে দিয়েছেন ‘কসাই’ উপাধি। বৃহত্তর ময়মনসিংহের ছয় জেলার মানুষের প্রধান চিকিৎসাস্থল এ হাসপাতালের এক্স-রে মেশিনগুলো সচল। কিন্তু রোগীর ভিড় নেই। কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়, অনিয়মের প্রধান আখড়া অর্থোপেডিক্স বহির্বিভাগ। এখানকার আবাসিক সার্জন প্র্যাকটিস করেন হাসপাতালের প্রধান ফটকের উল্টো দিকের নিউ মেডিকেয়ার প্যাথলজিতে। হাসপাতালে এক্স-রে ফি ২০০ টাকা হলেও সেখান থেকে করাতে হয় ৩০০ টাকা দিয়ে। আগত সব রোগীর এক্স-রে অনেকটাই বাধ্যতামূলক সেখানে। কয়েক দিন ধরে বহির্বিভাগ ঘুরে এবং অনুসন্ধানে জানা গেছে, মেডিসিন বহির্বিভাগে দীর্ঘ ১০ বছর দালালি করার অভিজ্ঞতা রয়েছে ঝাড়ুদার মিন্টুর। ঝাড়ুদার হলেও তাকে ঝাড়ু হাতে দেখেননি এ বিভাগের কোনো কর্মচারী। তার নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রতিটি কক্ষের দু-তিন জন দালাল। মিন্টুর নিয়োগপ্রাপ্ত নজরুল নামের এক দালাল ঝাড়ু চালিয়ে পরিষ্কার করেন এ ওয়ার্ড। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জানান, এ নিয়ে কেউ কথা বললে দম্ভোক্তি করে মিন্টু প্রায়ই বলেন, ‘আমাকে চাকরি দিয়েছে বিএমএর এক স্যার। সে-ই কিছু বলে না, তোমরা বলার কে?’ অর্থোপেডিক্স বহির্বিভাগের প্রতিটি কক্ষের সামনেই রয়েছে নিউ মেডিকেল প্যাথলজির লোক। হাত-পা ভাঙা রোগীদের প্লাস্টার করার জন্য পাঠানো হয় ১০৬ নম্বর কক্ষে। সেখানে সালাম ও মনির নিয়োগপ্রাপ্ত চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। এ দুজনের ওয়ার্ডবয় হিসেবে থাকার কথা থাকলেও তাদের সহযোগী হিসেবে লিটন ও বিল্লাল অবস্থান করেন বহিরাগত হিসেবে। বিনামূল্যে প্লাস্টার করার কথা থাকলেও ২০০ থেকে ২৫০ টাকায় রোগীদের প্লাস্টার করাতে হয়। হাসপাতালের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের অর্থোপেডিক্স বিভাগে মঙ্গলবার গিয়ে দেখা যায়, নিউ মেডিকেয়ার ল্যাব থেকে এক্স-রে করে এনেছেন পা ভেঙে যাওয়া সেকান্দর (৪৮)। হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ১২ সেপ্টেম্বর। সেখানে কে পাঠিয়েছে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, যারা ট্রলি টানেন তারাই সেখানে তাকে নিয়ে গেছেন। খোঁজ নিয়ে এবং বিভিন্ন সূত্রের অভিযোগে জানা যায়, হাসপাতালের বহির্বিভাগে মনির, হেলাল, কবির, মনির, লতিফসহ ১০-১৫ জনের দালাল চক্র সব সময় অবস্থান করেন হাসপাতালে। রোগী আসামাত্রই তারা বলে ওঠেন আজ ডাক্তার নেই, ধর্মঘট চলছে ইত্যাদি। পরে বিভিন্ন ক্লিনিকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় সহজ-সরল রোগীদের। ডাক্তারের ফিতে ৬০০ টাকায় নেন ২০০ টাকা আর পরীক্ষার ফিতে গোনেন ৫০ ভাগ কমিশন। জরুরি বিভাগেও রয়েছে ২৫-৩০ জনের একটি শক্তিশালী দালাল চক্র। দাদন ভুইয়া, তারা, ফেরদৌস, এসডি রুবেল ও রফিকুল হচ্ছেন এ সিন্ডিকেটের অন্যতম। অপারেশনের রোগীদের বাগিয়ে নিতে পারলেই পান নির্দিষ্ট কমিশন। এমনকি যতদিন রোগী ভর্তি ততদিন কমিশনও নিশ্চিত। আরও জানা গেছে, সার্জারি বহির্বিভাগের আবাসিক সার্জন আজিম উদ্দিন ভুইয়া। তিনি অন্যদের মতো না হলেও বেপরোয়া তারই অফিসসহায়ক শফিকুল ইসলাম। তারও সহযোগী হিসেবে থাকেন খায়রুল, মিল্টন, সাইফুলসহ আরও দু-তিন জন। চৌকস এ কর্মচারী ব্রাদার দিয়ে করিয়ে থাকেন ছোটখাটো অপারেশন। বিনিময়ে এক থেকে দেড় হাজার টাকা নিয়ে থাকেন। জানা যায়, সার্জারি বহির্বিভাগের রোকনউদ্দৌলা ও জরুরি বিভাগের মতিউর রহমান ব্রাদার হয়েও শফিকুল ইসলামের ডাকে সাড়া দিয়ে করে থাকেন অপারেশন। রোগীদের অভিযোগ অনুযায়ী, হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক বসেন নতুন ভবনের দ্বিতীয় তলায় বহির্বিভাগে। বেলা ২টা পর্যন্ত তার থাকার কথা থাকলেও ঘড়ির কাঁটা ১২টা স্পর্শ করলেই তিনি চলে যান। তাকে আর হাসপাতালে পাওয়া যায় না। একইভাবে হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক আসেন দুপুর ১টা থেকে দেড়টার মধ্যে। দেখেন রেফার্ড রোগী। কিন্তু সময়মতো না থাকায় রোগীরা পড়েন ভোগান্তিতে। সময়মতো ডাক্তারদের উপস্থিত না থাকা প্রসঙ্গে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নতুন পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাছির উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সরাসরি নির্দেশনা আছে ডাক্তারদের ডিউটির পুরো সময়টা নিয়োজিত থাকার। কিন্তু অনেকেই এ নির্দেশনা পালন করেন না বলে আমি জেনেছি।’

সর্বশেষ খবর