বৃহস্পতিবার, ২৬ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

বিশিষ্ট ব্যক্তিদের হুমকিদাতা আটক

গ্রেফতার ‘জিহাদি জন’

নিজস্ব প্রতিবেদক

সমাজের গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক ও রাজনীতিবিদসহ ১৫৩ বিশিষ্ট ব্যক্তিকে ইসলামিক স্টেট (আইএস) এবং আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) নামে হত্যার হুমকি দিয়ে আসছিলেন আবদুল হক নামে এক জামায়াত কর্মী। মঙ্গলবার তেজগাঁও এলাকায় অভিযান চালিয়ে আবদুল হককে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এ সময় তার কাছ থেকে দুটি ল্যাপটপ ও একটি স্মার্টফোন জব্দ করা হয়। পূর্বশত্রুতার জের ধরে তিনজনকে ঝামেলায় ফেলতে তিনি ‘জিহাদি জন’ নামে এমনটি করেছেন। গতকাল  দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে যুগ্ম-কমিশনার (ডিবি) মনিরুল ইসলাম এসব তথ্য জানান। মনিরুল ইসলাম বলেন, আবদুল হকের কাছ থেকে জব্দ করা ল্যাপটপ ও স্মার্টফোন থেকে হুমকি দেওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, প্রফেসর মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ইতিহাসবিদ প্রফেসর মুনতাসীর মামুন, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নেতা শাহরিয়ার কবির, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ, সাংবাদিক মিজানুর রহমান খানসহ সমাজের গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক ও রাজনীতিবিদকে হত্যার হুমকি দিয়েছেন আবদুল হক। তিনি বলেন, আবদুুল হক দীর্ঘদিন ধরে নিজ পরিচয় গোপন করে পূর্বশত্রুতার জের ধরে ফাইজুর রহমান, সালেহ আহম্মেদ ফোয়াদ ও মাওলানা সাদ নামে ফেসবুকে আইডি খুলে তাদের মোবাইল ফোন নম্বর স্পুফিংয়ের (ক্লোন) মাধ্যমে ব্যবহার করে দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে বিভিন্ন ধরনের অশ্লীল ও প্রাণনাশের বার্তা পাঠাতেন, যাতে ওই তিনজন ঝামেলায় পড়েন। আবদুল হক সিলেটের জকিগঞ্জের একটি মাদ্রাসার শিক্ষক। তিনি আরবি ও বাংলা ভাষার পাশাপাশি ইংরেজি ও আইটি এক্সপার্ট। ইন্টারনেটে আইএসের লেখা পড়ে উদ্বুদ্ধ হয়ে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে তিনি জড়িয়ে পড়েন। এদিকে আইএসের পক্ষে অনলাইনে প্রচারণা চালানোর অভিযোগে নাহিদ হাসান নামে এক শিবির কর্মীকে গ্রেফতার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। মঙ্গলবার রাতে বাড্ডার হোসেন মার্কেট এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। নাহিদ দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করাসহ অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য নানা ধরনের পরিকল্পনা নিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন ডিএমপির যুগ্ম-কমিশনার (ডিবি) মনিরুল ইসলাম। মনিরুল ইসলাম বলেন, নাহিদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘উসকানিমূলক বক্তব্য’ প্রচারের কথা ‘স্বীকার’ করেছেন। ইসলামিক স্টেট-দাওলা আল ইসলামিয়া নামে একটি পেজ চালাতেন তিনি। সেখানে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকারের পাশাপাশি আইএসের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবহিত করা হতো। নাহিদ ফেসবুকে ‘খালিদ বিন ওয়ালিদ’ ও ‘জিহাদি জন’ নাম ব্যবহার করতেন এবং ‘আর্মি ক্যাপ্টেন অব খিলাফত’ নামে নিজের পরিচয় দিতেন। তিনি জানান, নাহিদ এর আগে ‘শিয়া কাফের’ নামে একটি ফেসবুক পেজের অ্যাডমিন ছিলেন, যেখানে শিয়া সম্প্রদায় সম্পর্কে বিভিন্ন উসকানিমূলক বক্তব্য প্রচার করা হতো। তিনি নিজে ধর্ম পালন করেন না। তার সঙ্গে থাকা মোবাইল জব্দ করে বেশ কিছু অশ্লীল ভিডিও পেয়েছেন গোয়েন্দারা।

আইটি ত্রাস আবদুল হ্যাকের যত কাণ্ড : অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, জাফর ইকবাল, মুনতাসীর মামুনসহ বিশিষ্টজনদের হত্যার হুমকির অভিযোগে ঢাকার তেজগাঁও থেকে গ্রেফতার হওয়া আবদুল হক সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলার গাঙপার নোয়াকোট গ্রামের বাসিন্দা। মাদ্রাসা শিক্ষক। শিক্ষক ছিলেন সিলেট জেলার জকিগঞ্জ উপজেলার শাহবাগের একটি মাদ্রাসার। ফেসবুক, ই-মেইল হ্যাক, সিম ক্লোনিংসহ সাইবার ক্রাইমে সিদ্ধহস্ত আবদুল হক ঘনিষ্ঠজনদের কাছে পরিচিত ‘আবদুল হ্যাক’ হিসেবেই। তার সাইবার ক্রাইমের শিকার হয়ে জেল খেটেছেন ফায়জুর রহমান নামের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তার এক বন্ধু। হয়রানির শিকার হয়েছে অনেক বন্ধুবান্ধব। সাইবার ক্রাইমার হিসেবে আবদুল হকের যখন পরিচিতিটা প্রকাশ পেয়ে যায় তখন তার বন্ধুবান্ধবরা দূরে সরে যেতে থাকেন। কিন্তু তাতেও রেহাই মেলেনি তাদের। একের পর এক হয়রানির শিকার হতে হয় তাদের। বন্ধুবান্ধবদের কাছে আবদুল হক ছিলেন একজন ‘আইটি ত্রাস’।

জানা যায়, নানা অপকর্মের কারণে জকিগঞ্জের শাহবাগ মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ গত বছর তাকে চাকরিচ্যুত করে। পরিচিতজনদের ফেসবুক, ই-মেইল হ্যাক করে বিকৃত আনন্দ উপভোগ করতেন আবদুল হক। ফেসবুক আইডি হ্যাক করে বন্ধু তালিকায় থাকা বিভিন্নজনকে অশ্লীল, কুরুচিপূর্ণ ম্যাসেজ দিতেন। এতে আইডির মূল মালিককে পড়তে হতো বিব্রতকর পরিস্থিতিতে। আবদুল হকের ‘সাইবার ত্রাসে’ সর্বদা তটস্থ থাকতেন তার পরিচিতজনরা। কখন কাকে ফাঁসিয়ে দেন, এমন ভয় কাজ করত সবার মধ্যে।

একসময় আবদুল হকের বন্ধু ছিলেন সিলেটের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র ফায়জুর রহমান। তার বাড়িও গাঙপার নোয়াকোট গ্রামে। পারিবারিক বিরোধে ফায়জুরকে ‘শত্রু’ বানিয়ে ফেলেন আবদুল হক। এই ‘শত্রুতা’ থেকেই ২০১৩ সালের ১৪ জুন অর্থমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রীসহ সিলেটের ছয় সংসদ সদস্যকে ফায়জুরের ব্যবহৃত সিম ক্লোন করে এসএমএস পাঠিয়ে হত্যার হুমকি দেন আবদুল হক। ওইদিন রাতেই ফায়জুরকে গ্রেফতার করে পুলিশ। জব্দ করে তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন। এ ঘটনায় প্রায় চার মাস জেল খেটে জামিনে মুক্ত হন ফায়জুর। কিন্তু ফায়জুরকে আবারও ফাঁসিয়ে দেন আবদুল হক। ২০১৪ সালের ৩০ জুন আইনমন্ত্রীকে এসএমএসে হত্যার হুমকি দেওয়ার অভিযোগে ফায়জুরকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। ওই হুমকিতে ব্যবহার করা হয় পুলিশের কাছে জব্দ থাকা ফায়জুরের মোবাইল ফোন নাম্বার। আইনমন্ত্রীকে হুমকি দেওয়ার অভিযোগে ফায়জুরকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। জেলে থাকাবস্থায় ফায়জুরের ওই বন্ধ নাম্বার থেকে কারাকর্তৃপক্ষকে হুমকি দেওয়া হয়। পরে তদন্তে ফায়জুর নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ায় ওই মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। কিন্তু গরিব মেধাবী হিসেবে ফায়জুর বিনাখরচে পড়ালেখার যে সুযোগ পেতেন তা বাতিল করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

আবদুল হকের আরেক শিকার ফায়জুর রহমানের বন্ধু সালেহ ফুয়াদ। হক যে মাদ্রাসায় চাকরি করতেন, ওই মাদ্রাসায় সহকারী শিক্ষক ছিলেন ফুয়াদ। ওই সময় হকের কুকীর্তির বিষয়ে জানতে পারেন তিনি। কিন্তু হক যদি কোনোভাবে ফাঁসিয়ে দেন, এই ভয়ে কারও কাছে মুখ খুলেননি ফুয়াদ। ভয় পেয়ে ফুয়াদ নিজের পুরনো সিম ডিঅ্যাকটিভেট করে নতুন সিম কিনেন। তবু ‘আইটি ত্রাস’ আবদুল হকের শিকার হওয়া থেকে মুক্তি মেলেনি ফুয়াদের! তার সেই ডিঅ্যাকটিভেট করা সিম ক্লোন করে চলতি মাসের ১০ তারিখ অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে হত্যার হুমকি দেয় হক। এ ঘটনায় ফুয়াদকে আটক করে পুলিশ। কিন্তু তার নাম্বার ডিঅ্যাকটিভেট করে রাখার বিষয়টি নিশ্চিত হয় পুলিশ। পরে তদন্তে সিম ক্লোন করে হুমকি দেওয়ার সত্যতা পেয়ে আবদুল হককে গ্রেফতার করা হয়।

এখানেই শেষ নয়, শাহবাগ মাদ্রাসা থেকে বরখাস্ত হওয়ার পর আবদুল হক ওই মাদ্রাসার নাজিম (রেজিস্ট্রার) মাওলানা সাদ উদ্দিনের সিম ক্লোন করে হত্যার হুমকি দেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ সেলিমকে। এ ঘটনায় সাদকে গ্রেফতার করে পুলিশ। প্রায় ছয় মাস জেল খাটতে হয় তাকে। এ ছাড়া জামায়াত সংশ্লিষ্টতার কারণে কওমি ধারার মাদ্রাসা ছাত্রদের সাহিত্য সংগঠন ‘মুক্তস্বর’ থেকে আবদুল হককে বহিষ্কার করা হয়। এর প্রতিশোধ নিতে সে সিলেটের তিন সাংবাদিকের নামে ভুয়া ই-মেইল আইডি খুলে গণমাধ্যমে মুক্তস্বরের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ‘সংবাদ’ পাঠাত। সেসব ‘সংবাদ’ প্রকাশিত হলে শুরু হয় তোলপাড়। সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকরা তাদের নামে ই-মেইল ব্যবহার করে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে বলে অভিযোগ করেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বেরিয়ে আসে আবদুল হকের ‘আইটি সন্ত্রাসের’ বিষয়টি।

সর্বশেষ খবর