শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ২৬ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

হুমকিতে মহেশখালী মোহনা

শক্তিশালী ড্রেজার বসিয়ে বালি উত্তোলনে সংকটে পরিবেশ

সায়েদ জালাল উদ্দিন, কক্সবাজার

হুমকিতে মহেশখালী মোহনা

ড্রেজার বসিয়ে এভাবেই বালি উত্তোলন করা হচ্ছে -বাংলাদেশ প্রতিদিন

কক্সবাজার বিমানবন্দর সম্প্রসারণ কাজে নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বাঁকখালী নদীর মোহনা, মহেশখালী চ্যানেল ও নাজিরার টেক সমুদ্র এলাকাসহ প্রতিবেশ সংকটাপন্ন বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে শক্তিশালী ড্রেজার বসিয়ে হরদম বালি উত্তোলন করে যাচ্ছে। এতে চরম ঝুঁকির মুখে পড়েছে বাঁকখালী অববাহিকা ও উপকূলবর্তী বিভিন্ন এলাকা। সেই সঙ্গে নষ্ট হচ্ছে সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশ। কক্সবাজার বিমানবন্দর সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন কাজের টেন্ডার পাওয়া কোরিয়ান প্রতিষ্ঠান ইউনিশ ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন, সিউকে ওয়াং ডেভেলপমেন্ট কোং লি., হ্লা করপোরেশন লি., জেভি এবং এদের সহযোগী বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান মীর আকতার হোসেন লি. জয়েন্ট ভেঞ্চারে বিমানবন্দর উন্নয়নের কাজের টেন্ডার চূড়ান্তভাবে পেয়েছে। টেন্ডার পাওয়ার পর ওয়ার্ক অর্ডার অনুযায়ী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে ওই কাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর কক্সবাজার বিমানবন্দর সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। টেন্ডার ও ওয়ার্ক পারমিটে সিলেটি পাথর, ছোট নুড়ি পাথর ও সিলেটি বালি ব্যবহারের কথা উল্লেখ থাকলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বেআইনিভাবে বিভিন্ন পয়েন্টে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে দেদার সমুদ্রের মূল্যবান খনিজ বালি উত্তোলন করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রশ্ন উঠেছে সিলেটি বালির পরিবর্তে লবণাক্ত সামুদ্রিক বালি ব্যবহার করায় কক্সবাজার বিমানবন্দর সম্প্রসারণ কাজের গুণগত মান ও স্থায়িত্ব নিয়েও। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের সমিতিপাড়া পয়েন্ট, নাজিরার টেক পয়েন্ট ও বাঁকখালী নদীর মোহনায় উপকূল থেকে অন্তত ২০০ মিটার দূরে সমুদ্রে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বালি উত্তোলন করা হচ্ছে। উত্তোলিত বালি পাইপলাইনের মাধ্যমে নিয়ে আসা হচ্ছে স্থলভাগে। ১০ চাকার বিশালাকার ট্রাকে করে এসব বালি রাত-দিন পরিবহন করা হচ্ছে। এভাবে বালি উত্তোলনে নষ্ট হচ্ছে সামুদ্রের প্রাকৃতিক পরিবেশ। ধ্বংস হচ্ছে সামুদ্রিক খনিজ সম্পদ, সামুদ্রিক প্রাকৃতিক জীবসম্পদ, মৎস্য, চিংড়ি, শামুক, ঝিনুক, ডলফিন, কাঁকড়া, সি-উইড, সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী, এনাড্রস জাতের প্রাণী, ক্যাটাড্রমাস প্রজাতি, সেডেন্টারি প্রজাতি, বিভিন্ন জাতের প্রাণী, জু-প্লাঙ্কটন এবং ফাইটোপ্লাঙ্কটনসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের প্রজনন-আবাসস্থল। এভাবে জলবায়ু ও জীববৈচিত্র্যের ইকো-সিস্টেমকে বিপর্যস্ত করে রাষ্ট্রের শত শত কোটি টাকার ক্ষতিসাধন করা হচ্ছে। এ ছাড়া সমুদ্রতল, জলরাশি, জলস্রোত, বায়ু, সামুদ্রিক প্রবালপ্রাচীরও দূষিত হচ্ছে। অথচ জাতিসংঘের জেনেভা কনভেশন ১৯৫৮, ১৯৬০, ১৯৭০ সালের ১৭ ডিসেম্বরের ২৭৪৯(২৫) নম্বর সিদ্ধান্ত এবং জাতিসংঘের ১৯৮৪ সালের ৯ ডিসেম্বরের জ্যামাইকা কনভেশনে সাধারণ পরিষদের ১৫১৪(১৫) নম্বর সিদ্ধান্ত, জাতিসংঘের জীববৈচিত্র্য কনভেনশন ১৯৯২, ২০০০ সালের ২৯ জানুয়ারি কানাডার মন্ট্রিলে অনুষ্ঠিত জৈব নিরাপত্তা সংক্রান্ত প্রটোকল ২০০০, ১৯৭৩ সালের সাইটাস, ১৯৮০ সালের আইইউসিএন বিশ্ব সংরক্ষণ কৌশল, ১৯৮২ সালের প্রকৃতির বিশ্ব সনদ, ১৯৭২ সালের স্টকহোম ঘোষণা, দীর্ঘস্থায়ী জৈব রাসায়নিক পদার্থ সংক্রান্ত স্টকহোম কনভেনশন ২০০১, জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক জাতিসংঘ ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন ১৯৯২, রামসার কনভেনশন ১৯৭১-এ সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে, সমুদ্রের ইকো-সিস্টেমের ক্ষতিসাধন করে কোনো ধরনের ড্রেজার বসিয়ে মাটি বা বালি উত্তোলন করা যাবে না। জাতিসংঘের জেনেভা কনভেশন ও জ্যামাইকা কনভেনশনে বাংলাদেশ অন্যতম স্বাক্ষরকারী একটি দেশ। জাতীয় পরিবেশ নীতিমালা ১৯৯২-এর ৩(১০) ধারা অনুযায়ী দেশের উপকূলীয় ও সামুদ্রিক ইকো-সিস্টেম এবং সম্পদের পরিবেশসম্মত সংরক্ষণ, উন্নয়ন, দূষণরোধ করার এবং পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ সংশোধনী ২০১০-এর ৬(ঙ) ও ১৬ ধারা মোতাবেক সমুদ্রে ড্রেজার বসিয়ে বালি উত্তোলন করা সরাসরি নিষিদ্ধ থাকলেও আইনের তোয়াক্কা না করে হরদম সমুদ্রে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বালি উত্তোলন করে কক্সবাজার বিমানবন্দর সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন কাজ চালিয়ে যাচ্ছে অসাধু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এতে রাষ্ট্রের ক্ষতি হচ্ছে শত কোটি টাকা। এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদফতর কক্সবাজারের সহকারী পরিচালক সরদার শরিফুল ইসলাম জানান, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনগত কী ব্যবস্থা নেওয়া যায় তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। মৎস্য রক্ষণ ও সংরক্ষণ আইন ১৯৫০-এর ২ ও ৩ ধারা, মৎস্য রক্ষণ ও সংরক্ষণ বিধি ১৯৮৫-এর ৩(১)(২) বিধির উপবিধি(১) এবং সামুদ্রিক মৎস্যক্ষেত্র অধ্যাদেশ ১৯৮৩-এর ১(খ)(ঘ), ২৪(২) ক, খ, ২৬(ক)(খ)(গ)(ঘ) ধারা অনুযায়ী, নদীর মোহনা, সমুদ্রের মৎস্য প্রজনন ও আবাসস্থল এলাকায় বালি উত্তোলন করে মৎস্যসহ জীবন্ত সামুদ্রিক সম্পদের ক্ষতিসাধন করা যাবে না। এর পরও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মীর আকতার হোসেন লি. সমুদ্রে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে হরদম সামুদ্রিক বালি উত্তোলন করে যাচ্ছে। সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা (সদর) ড. মঈন উদ্দিন আহমদ জানান, সুস্পষ্ট অভিযোগ পেলে মীর আকতার হোসেন লি. কনস্ট্রাকশন ফার্মের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কক্সবাজার আণবিক শক্তি কমিশনের পরিচালক জানান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নীতিমলা অনুযায়ী খনিজ সম্পদ ও সামুদ্রিক খনিজ বালি পারমাণবিক শক্তি কমিশন ছাড়া আর কেউ উত্তোলন ও ব্যবহার করতে পারবে না। জনস্বার্থ ও দেশের কোটি কোটি টাকা ক্ষতি করে সামুদ্রিক প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি। কক্সবাজার বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক সাধন কুমার মোহন্ত বলেন, ‘বিমানবন্দর সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের জন্য একটি দেশীয় ও তিনটি কোরীয় প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া হয়েছে। তারা সমুদ্র থেকে বালি উত্তোলনের জন্য ড্রেজার মেশিন ক্রয় করেছে বলে শুনেছি।’ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রকল্প কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা বলেন, ‘সিলেটি বালি দিয়ে নির্মাণকাজ করার কথা থাকলেও আমরা সস্তায় ও কম খরচে সমুদ্রে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে সহজেই বালি উত্তোলন করে নির্মাণকাজ চালিয়ে যাচ্ছি। তবে এ পর্যন্ত কোনো ধরনের প্রশাসনিক বাধা-নিষেধ আসেনি।’ সামুদ্রিক বালি উত্তোলনে আইনগত বাধা-নিষেধের ব্যাপারে জানতে চাইলে তারা উল্টো প্রশ্ন করেন, ‘বাংলাদেশে কয়জন লোক আইন মেনে কনস্ট্রাকশন কাজ করে!’ এ ব্যাপারে মীর আকতার হোসেন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর নাসির হোসেনকে ফোন করলে সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তিনি লাইন কেটে দেন। ফলে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর