শুক্রবার, ২৭ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত মংলা

সামছুজ্জামান শাহীন, মংলা থেকে ফিরে

চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত মংলা

পদ্মা সেতু চালু হলে মংলা বন্দরের ব্যবহার কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। সে চাপ সামাল দিতে প্রস্তুতিও চলছে। ইতিমধ্যে বঙ্গোপসাগর থেকে বন্দর জেটি পর্যন্ত সংযোগ চ্যানেলটির ড্রাফট (গভীরতা) বাড়াতে ক্যাপিট্যাল ড্রেজিং চলছে। কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের আধুনিক যন্ত্রপাতি কেনাও হয়েছে। একই সঙ্গে তিন হাজার কোটি টাকার একটি মেগা প্রকল্পের এমইউ স্বাক্ষরও সম্পন্ন হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রস্তুত হচ্ছে মংলা বন্দর।

মংলা বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল রিয়াজউদ্দীন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে সড়কপথে রাজধানী ঢাকার সবচেয়ে কাছাকাছি সমুদ্রবন্দরের স্থানটি দখল করবে মংলা বন্দর। তখন এ বন্দর দিয়ে আমদানি ও রপ্তানি খরচ চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ে অনেক গুণ কমে  যাবে। সঙ্গত কারণেই আমদানি-রপ্তানিকারকরা অর্থ সাশ্রয়ে মংলা বন্দর ব্যবহারে আগ্রহী হয়ে উঠবেন। তখনকার চাপ সামলানোর জন্যই নানামুখী প্রস্তুতি চলছে। মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে মংলা বন্দরের পাঁচটি জেটির কার্যক্ষমতার অর্ধেকটা ব্যবহৃত হচ্ছে। বাকি অর্ধেক অব্যবহৃত থাকছে। আগামী দিনের চাপের কথা চিন্তা করে পাঁচটি জেটির সম্পূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বড় ড্রাফটের জাহাজের নির্বিঘ্ন চলাচল নিশ্চিত করতে বন্দরের বহির্নোঙর থেকে জেটি পর্যন্ত ১৩১ কিলোমিটার পশুর চ্যানেলটির নাব্য বাড়াতে ক্যাপিট্যাল ড্রেজিং চলছে। ইতিমধ্যে এ চ্যানেলের এক-তৃতীয়াংশ ক্যাপিট্যাল ড্রেজিং সম্পন্ন হয়েছে। এতে ব্যয় করা হয়েছে ১১২ কোটি টাকা। বাকি দুই-তৃতীয়াংশ ড্রেজিংয়ের জন্য ৪৩১ কোটি টাকার দুটি প্রকল্প একনেকে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। একই সঙ্গে চ্যানেলের প্রয়োজনীয় নাব্য ধরে রাখতে নিজস্ব দুটি মেইনটেনেন্স  ড্রেজার মেশিন কেনা হয়েছে। কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের জন্য ইতিমধ্যে কেনা হয়েছে ২২টি আধুনিক যন্ত্রপাতি, যা আগামী বছরের শেষ নাগাদ বন্দরের হ্যান্ডলিংয়ের কাজে যুক্ত হবে। বিদেশি জাহাজের জ্বালানি তেল সহজলভ্য করতে বন্দরেই নির্মিত হচ্ছে বৃহৎ আকারের ডিপো। বন্দরে শুল্কায়ন ইউনিট স্থাপনের কাজও চলছে। ইতিমধ্যে ইপিজেডে কাস্টমস তাদের শুল্কায়নের কাজ শুরু করেছে। এ ছাড়া ‘ভিশন-২০২১’ সামনে রেখে বন্দরের উন্নয়নে চীনের সঙ্গে তিন হাজার কোটি টাকার একটি বৃহৎ প্রকল্পের এমইউ স্বাক্ষরিত হয়েছে। এ প্রকল্পে নতুন চারটি জেটি ও দুটি ইয়ার্ড নির্মাণ, বহুতলবিশিষ্ট গাড়ি রাখার মাল্টিস্টোরেজ কার পার্ক নির্মাণ, ১১টি সার্ভে ও টাগবোর্ড ক্রয়, কার্গো ও কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের জন্য অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ক্রয়, চার লেনের সড়ক উন্নয়নসহ আটটি কম্পোনেন্ট রয়েছে। এই বৃহৎ প্রকল্পটি এখন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। জানা যায়, মংলা থেকে ঢাকা পর্যন্ত উন্নত সড়কব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও শুধু দীর্ঘ সময় ও অনিয়মিত ফেরি পারাপার ব্যবস্থার কারণে মংলা বন্দর রাজধানী থেকে অনেক দূরে রয়ে গেছে। ফলে দেশের, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, সাভার, গাজীপুরের শিল্প ও বাণিজ্য খাত তথা ট্রেডগুলো মংলা বন্দরের ওপর নির্ভর করতে পারেনি। এগুলো সব সময়ই চট্টগ্রাম বন্দরকেই বেশি প্রাধান্য দিয়ে আসছে। চট্টগ্রাম বন্দরে প্রায়ই জাহাজজট হয়। বহির্নোঙরে ২৫ দিন অপেক্ষার মতো উদাহরণ আছে অনেক। এর পরও আমদানি-রপ্তানিকারক ও শিপিং কোম্পানিগুলো মংলা বন্দর ব্যবহারে উৎসাহ দেখায়নি। কিন্তু পদ্মা সেতু চালু হলে এ অবস্থার পরিবর্তন হবেই। কারণ বর্তমানে ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের দূরত্ব সড়কপথে প্রায় ২৬৫ কিলোমিটার। পদ্মা সেতু চালু হলে ঢাকার সঙ্গে মংলা বন্দরের দূরত্ব হবে সড়কপথে প্রায় ১৭০ কিলোমিটার। অর্থাৎ ঢাকার সঙ্গে সড়কপথে মংলা বন্দরের রাস্তা চট্টগ্রাম বন্দরে চেয়ে প্রায় ৯৫ কিলোমিটার কমে যাবে। এতে পরিবহন খরচ ও সময় দুটিরই সাশ্রয় হবে। খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ-উজ-জামান বলেন, পদ্মা সেতু মংলা বন্দরকে গতিশীল করার একটি নিয়ামক শক্তি এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়। সেতুটি চালু হলে শুধু মংলা বন্দর গতি পাবে তা নয়, দক্ষিণের ২১ জেলায় নতুন করে শিল্প-কারখানা গড়ে তুলতে দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ীদের আকৃষ্ট করবে। হাজারো বেকার মানুষের কর্মসংস্থানের পথ খুলে যাবে। মংলা বন্দরে ইপিজেডে পড়ে থাকা বাণিজ্যিক প্লটেও গড়ে উঠবে নানা শিল্প-কারখানা। চাপ কমবে ঢাকার ওপর। অর্থনৈতিক অচলাবস্থা দূর হবে। আর এর সঙ্গে যদি পাইপলাইনে গ্যাস আনা যায় তাহলে আরও সমৃদ্ধ হবে এ অঞ্চলের শিল্পায়ন প্রক্রিয়া। মংলা বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল রিয়াজউদ্দীন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বাংলাদেশের সমুদ্রপথে আমদানি-রপ্তানিটা দুর্ভাগ্যজনক হলেও শুধু চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর নির্ভশীল হয়ে গিয়েছিল। এটি দেশের জন্য অত্যন্ত খারাপ সময় ছিল। দ্বিতীয় একটি সমুদ্রবন্দর থাকা সত্ত্বেও বন্দরটিকে আমরা ব্যবহার করিনি। আমরা একটিমাত্র সমুদ্রবন্দরের ওপর নির্ভরশীল হয়ে গিয়েছিলাম। ২০০৯ সাল থেকে বর্তমান সরকার এ বিষয়টিকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে নেয়। মংলা বন্দরও যে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে এ বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিয়ে বন্দরের উন্নয়নমূলক প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। পর্যায়ক্রমে এ প্রকল্পগুলোর কাজ এখন চলছে। ১৩১ কিলোমিটারের পশুর চ্যানেলের একটি অংশে ক্যাপিট্যাল ড্রেজিং শেষ হওয়ায় এখন সাড়ে সাত মিটার ড্রাফটের জাহাজ জেটিতে আসতে পারছে। বাকি দুটি ক্যাপিট্যাল ড্রেজিং সম্পন্ন হলে অ্যাংকরেজ এরিয়াগুলো, আকরাম পয়েন্ট ও হারবাড়িয়া এলাকায় ৯ থেকে সাড়ে ৯ মিটার ড্রাফটের জাহাজ আসতে পারবে। এ চ্যানেলে ভবিষ্যতে আরও বেশি ড্রাফটের জাহাজ আনার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পরিকল্পনাও রয়েছে।’ তিনি বলেন, বিগত সময়ে বন্দরের কার্গো ও কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় ইকুইপমেন্ট, আধুনিক যন্ত্রপাতির কথা চিন্তাই করা হয়নি।

বর্তমান সরকারের সময়ই ২২টি আধুনিক কার্গো হ্যান্ডলিং ইকুইপমেন্ট কেনা হয়েছে, যা দিয়ে চার-পাঁচ বছরের মধ্যে বন্দরের পাঁচটি জেটিতে যত-সংখ্যক জাহাজ আসবে, তা স্বাচ্ছন্দ্যে হ্যান্ডলিং করা যাবে। তিনি বলেন, যখন পদ্মা সেতু চালু হয়ে যাবে, তখন মংলা বন্দরের ওপর চাপ কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। কারণ ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের চেয়ে মংলা বন্দরের দূরত্ব ৯৫ কিলোমিটার কমে আসবে। বিশেষ করে গার্মেন্টসের একটা বড় অংশ মংলা বন্দর দিয়ে রপ্তানি হবে। পদ্মা সেতুতে রেলওয়ে থাকায় মংলা বন্দরের ব্যবহার আরও বাড়বে। ভবিষ্যতের এসব বিষয় চিন্তা মাথায় নিয়েই তিন হাজার কোটি টাকার একটি মেগা প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে চীনের সঙ্গে এমইউ স্বাক্ষরিত হয়েছে। এ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে চট্টগ্রাম বন্দরের মতোই হয়ে উঠবে মংলা বন্দর।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর