শনিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

বাড়ছে কোটিপতি বাড়ছে কর ফাঁকি

রুহুল আমিন রাসেল

বাড়ছে কোটিপতি বাড়ছে কর ফাঁকি

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দ্রুতগতিতে বাড়ছে কোটিপতি। এর সঙ্গে প্রত্যাশিত সুশাসনের অভাবে বাড়ছে কর ফাঁকিও। তাতে উচ্চবিত্তদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে আছেন দেশের মধ্যবিত্তরাও। উন্নয়নশীল এই বাংলাদেশে বার্ষিক কর ফাঁকি দেওয়া অর্থের প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা নিরাপদে পাচার হচ্ছে উন্নত দেশগুলোতে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) দায়িত্বশীল শীর্ষ কর্মকর্তাদের মতে, স্বচ্ছ লেনদেন ও রেকর্ড রাখার ব্যবস্থা না থাকায় কর ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন এক শ্রেণির করদাতা। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ট্রান্সফার প্রাইসিংয়ের মাধ্যমে করযোগ্য আয় অন্য অধিক্ষেত্রে স্থানান্তরের কৌশল অবলম্বন করে কর ফাঁকি দেয়। দেশীয় কোম্পানিগুলো কর অবকাশ বা করমুক্ত সহযোগী প্রতিষ্ঠানে করযোগ্য আয় স্থানান্তরের মাধ্যমে কর ফাঁকি দিয়ে থাকে। ভুয়া আয়-ব্যয়ের হিসাব দেখিয়ে প্রকৃত আয় গোপন করার মাধ্যমেও কর ফাঁকি দেওয়া হয়।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ট্যাক্স জাস্টিস নেটওয়ার্ক’ গত ২ নভেম্বর প্রকাশিত ফাইনান্সিয়াল সিকিউরিটি ইনডেক্স-২০১৫ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে বছরে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা হুন্ডির মাধ্যমে, ১০ থেকে ১৬ হাজার কোটি টাকা আমদানি-রপ্তানি পণ্যের মূল্য অবমূল্যায়ন এবং অন্যান্য অবৈধ উপায়ে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। ফলে বাংলাদেশ প্রতি বছর বিপুল অঙ্কের রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আর্থিক গোপনীয়তা রক্ষায় ৯২টি দেশের সঞ্চিত অবৈধ অর্থ নিরাপত্তা পায়। এই আর্থিক গোপনীয়তা রক্ষায় শীর্ষ দেশগুলো হলো- সুইজারল্যান্ড, হংকং, যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, কেম্যান আইল্যান্ড (যুক্তরাজ্য), লুক্সেমবার্গ, লেবানন, জার্মানি, বাহরাইন এবং দুবাই ইত্যাদি। এ প্রসঙ্গে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কর ফাঁকিবাজদের বিরুদ্ধে এখন আমাদের অবস্থান অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে কঠোর। কর ফাঁকি দিয়ে বিদেশে অর্থপাচার যারা করছেন, তাদের বাঘের চেহারা দেখাব। এ জন্যই সরকার এনবিআরকে মানি লন্ডারিং আইন প্রয়োগের ক্ষমতা দিয়েছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক ড. বিনায়ক সেনের ‘বাংলাদেশে মধ্যবিত্তের আকার ও প্রবৃদ্ধি’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ১৯৯০ থেকে ২০১০ সালের এই ২০ বছরে বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত হয়েছে ২০ শতাংশ মানুষ। মধ্যবিত্তদের ৪৮ দশমিক ৪ শতাংশ বা প্রায় অর্ধেকই বেসরকারি চাকরি করেন। আবার ২০ শতাংশের বেশি সরকারি চাকরি করেন। তবে প্রায় ২২ শতাংশ ব্যবসা করেন। গত দুই দশকে মধ্যবিত্ত জনসংখ্যা দ্বিগুণের বেশি বেড়ে ২০ শতাংশ হয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৩৩ সালে মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ এ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হবে। এই অর্থনীতিবিদ তার প্রতিবেদনে মধ্যবিত্ত শ্রেণি সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে গিয়ে বলেছেন, দৈনিক আয় দুই থেকে তিন মার্কিন ডলার হলে তাকে মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত বিবেচনা করা হয়। উচ্চ মধ্যবিত্তের সীমা ধরা হয়েছে তিন থেকে চার ডলার। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠান ক্রেডিট সুইসের গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ ইনস্টিটিউট প্রকাশিত সর্বশেষ গ্লোবাল ওয়েলথ প্রতিবেদন-২০১৫ তথ্যমতে, ২০০০ সালে বাংলাদেশের মানুষের হাতে ৭৮ বিলিয়ন বা ৭ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ সম্পদ ছিল। আর এর ১৫ বছরের মাথায় তা বেড়ে হয়েছে ২৩৭ বিলিয়ন বা ২৩ হাজার ৭০০ কোটি ডলার। সূত্রমতে, দেশে কোটি টাকা ব্যাংক হিসাবধারীর সংখ্যা বর্তমানে ৫৭ হাজার ৫১৬টি। এটা এক বছর আগে ছিল ৫১ হাজার ৫৫০। অর্থাৎ এক বছরে কোটি টাকার ব্যাংক হিসাবধারীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৬ হাজার। যদিও ১৯৭৫ সালেও কোটি টাকার বেশি থাকা হিসাবের সংখ্যা ছিল ৪৭টি। তবে এই হিসাব কোটিপতির সংখ্যায় প্রকৃত হিসাব নয়। কারণ, বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের প্রকৃত কোটিপতির সঠিক হিসাব প্রকাশ করে না। তবে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ব্যাংকগুলোতে ১ থেকে ৫ কোটি টাকার আমানত আছে এমন ব্যাংক হিসাবধারীর সংখ্যা ৫৪ হাজার ৬৯৮টি। আর ৫০ কোটি টাকার বেশি আছে এমন ব্যাংক হিসাবধারীর সংখ্যা ৫৭৫টি। অথচ ১ বছর আগেও যা ছিল ৪৯৪।

এর আগে বিগত ২০০৫-০৬ থেকে ২০১৩-১৪ পর্যন্ত মোট ১০টি অর্থবছরে দেশের প্রভাবশালী ব্যক্তি ও ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের আয়কর ফাইল অনুসন্ধান ও তদন্ত করে ১৫ হাজার ৮১৭ মিলিয়ন বা ১ হাজার ৫৮১ কোটি টাকা কর ফাঁকির সন্ধান পেয়েছে সরকারের কর গোয়েন্দো সংস্থা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি)। সংস্থাটি বিগত এক দশকের কার্যক্রম নিয়ে গত বছর প্রকাশিত ‘ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ফর ট্যাক্স কমপ্লায়েন্স’ বা ‘কর সুশাসনে গোয়েন্দা ও অনুসন্ধান’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলেছে, দেশের অধিকাংশ করদাতা সৎ। তারা ভালোভাবেই কর দিতে চান। কিন্তু তারা ভয়ে কর দিতে পারছেন না। চোরাচালান, অর্থপাচার, মাদক পাচারে অর্থায়ন, সন্ত্রাসী অর্থায়ন, বৈদেশিক মুদ্রাজাল, ঘুষ ইত্যাদি। এ ধরনের অপরাধ দেশের অর্থনীতির জন্য হুমকি বলেও মনে করছে সিআইসি। সিআইসি মূলত কর ফাঁকিবিষয়ক তথ্য পায়- টেলিফোন, বার্তা, চিঠি, অভিযোগ, ই-মেইল, ওয়েব রেফারেন্স, পেশাগত যোগাযোগসহ বিভিন্ন মাধ্যমে। এসব মাধ্যমে পাওয়া তথ্য ব্যাংকি, নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান, সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্চ কমিশন (সিইসি), স্টক এক্সচেঞ্জ, সঞ্চয় পরিদফতর, কাস্টমস ও ভ্যাট কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), ভূমি রেজিস্ট্রার, আবাসন খাত, গাড়ির পরিবেশক, রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কমিশনসহ (আরজেএসসি) বিভিন্ন সংস্থা, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করা হয়। পাশাপাশি খতিয়ে দেখা হয়, করদাতার আয়কর বিবরণীর অতীত তথ্য, সরাসরি অনুসন্ধান, গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরসমূহ। সিআইসি মূলত ব্যাংক থেকে পাওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করার পর সাধারণত প্রাপ্ত তথ্যে কোনো গরমিল পাওয়া গেলেই করদাতাকে তলব করা হয়। প্রকৃত আয় গোপন করে বড় অঙ্কের কর ফাঁকির প্রমাণ পাওয়া গেলে আয়কর অধ্যাদেশ-১৯৮৪ এর ধারা ১১৭(৪) অনুযায়ী সংশ্লিষ্টদের সব ব্যাংক হিসাব জব্দ করতে পারে এনবিআর।

সর্বশেষ খবর