মঙ্গলবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

বিমানে লোকসান সিন্ডিকেটে

সাঈদুর রহমান রিমন

বিমানে লোকসান সিন্ডিকেটে

সর্বগ্রাসী দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে গত চার দশক ধরেই ধুঁকছে বিমান। রাষ্ট্রীয় এ সংস্থাটি এখন সরকারের জন্য একটি শ্বেতহস্তীতে পরিণত হয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকা লোকসান দিয়েও বিমান রুট ও শিডিউল ঠিক রাখতে পারছে না। ‘আকাশে শান্তির নীড়’ রচনার লক্ষ্য নিয়ে বিমানের যাত্রা শুরু হলেও এখন সে শান্তির নীড় গুটিয়ে গেছে। লুটপাটের সিন্ডিকেটের কারণে বছরের পর বছর ধরে গুনতে হচ্ছে লোকসান। ছোট হয়ে গেছে বিমানের পৃথিবীও। ৪২টি দেশের সঙ্গে চুক্তি থাকলেও মাত্র ১৬টি দেশে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে। এ বছর বিমানের রুট আরও গুটিয়ে ফেলা হচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে।

অব্যাহত লোকসানের ঘানি টানতে টানতে বিমান এখন ন্যুব্জ, ভঙ্গুর একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরিত হয়। এরপর ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ৫ কোটি ১৯ লাখ ও ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ১৫ কোটি ৫৭ লাখ টাকা মুনাফা করতে সমর্থ হয় বিমান। কিন্তু ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে আবারও লোকসান দিতে শুরু করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। ২০০৯-১০ অর্থবছরে ৮০ কোটি, ২০১০-১১ অর্থবছরে ১৯১ কোটি, ২০১১-১২ অর্থবছরে ৬০৫ কোটি ৯৫ লাখ, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ২১৪ কোটি, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ২২০ কোটি এবং গেল অর্থবছরে বিমানের লোকসানের পরিমাণ ২৬৩ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। কিন্তু চলতি অর্থবছর লোকসান থেকে উত্তরণে কর্তৃপক্ষের কোনো প্রচেষ্টা নেই। এক প্রতিবেদনে বিমান জানিয়েছে, ২০১০-১১ অর্থবছরের তুলনায় ২০১১-১২ অর্থবছরে ১৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ আয় বাড়লেও খরচ বেড়েছে ২২ দশমিক ৩৩ শতাংশ। বিভিন্ন রুটে বিমান লোকসান দিচ্ছে। তাহলে এই রুট প্ল্যানিং কে করেন? কোন বিশেষজ্ঞের মতামত নিয়ে নতুন উড়োজাহাজ আনা হয়েছে? এর জবাব বিমানের কাছে নেই। বিশ্বের সব বিমান সংস্থার রুট যখন বাড়ছে, তখন বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট কমতে শুরু করেছে। অনেক আন্তর্জাতিক রুট বন্ধ হয়ে গেছে। চালু ১৯টি আন্তর্জাতিক রুটের মধ্যে অন্তত  ৯টি লোকসানি। এভাবে রুট কমিয়ে, ফ্লাইট কমিয়ে অনেক দিন আগে থেকেই বিমানের পৃথিবী ছোট বানিয়ে ফেলা হয়েছে। সংস্থাটিকে ঘিরে গড়ে ওঠা শক্তিশালী দুর্নীতিবাজ চক্রের কারণেই এর ব্যবসা গুটিয়ে যেতে শুরু করে। বিমানের ব্যবসা চলে যায় অন্য ফ্লাইট অপারেটরদের দখলে। যাত্রী পরিসেবায় অন্যান্য আন্তর্জাতিক বিমান সংস্থার চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ বিমান। এমনকি প্রবাসী বাংলাদেশিরাও বিমানে ভ্রমণ করতে নারাজ। রুট বিন্যাসে নেই কোনো পরিকল্পনা। বাজার জরিপ ও বাণিজ্যিক পরিকল্পনা ছাড়াই অনেক রুট চালু করে লোকসান দিতে হচ্ছে। বিজ্ঞপ্তি ছাড়া লোক নিয়োগেরও নজির রয়েছে। কর্মীদের বিল-ভাতা, ওভারটাইমে কারচুপি আকাশচুম্বী। বাড়তি ফ্লাইং আওয়ার দেখিয়ে করা হয় ব্যাপক অনিয়ম। আর উড়োজাহাজ কেনা ও লিজ নেওয়ার কাজে রীতিমতো ‘সাগরচুরি’র কারসাজি ঘটে। ছোট হয়ে আসছে বিমানের পৃথিবী : সংকুচিত হয়ে আসছে বিমানের দূরপাল্লার যাতায়াত। সক্ষমতা অনুযায়ী দূরপাল্লায় আশানুরূপ যাত্রী না পাওয়ায় বিপাকে বিমান। ফলে দিন দিন লোকসান বাড়ছেই। মূলত অপরিকল্পিত রুট চালু, ফ্লাইট শিডিউল ঠিক না রাখা, উন্নত সেবা নিশ্চিত করতে না পারার কারণে দূরপাল্লার রুটে বিমান কাক্সিক্ষত যাত্রী পাচ্ছে না। সেবার মান ও সময়মতো ফ্লাইট না ছাড়ায় কম ভাড়ায়ও যাত্রী পাচ্ছে না বিমান। একই সঙ্গে বাজার যাচাই না করে শুধু রাজনৈতিক চাপে অনেক রুটে ফ্লাইট চালু রাখায় বছরের পর বছর লোকসান গুনছে বিমান।

ঢাকা-রোম-ফ্রাংকফুর্ট রুট যাত্রীর অভাবে প্রতিটি ফ্লাইটেই বিমানকে গড়ে ২ কোটি ১০ লাখ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। ঢাকা-হংকং রুটেও ফ্লাইটপ্রতি বিমানকে ৩৪ লাখ টাকা লোকসান গুনতে হয়। একই অবস্থা বিরাজ করছে ঢাকা-দিল্লি রুটে, ফ্লাইটপ্রতি লোকসান ১৪ লাখ টাকা। চারদিকে বিমানের এমন লোকসানের হিড়িকে সাময়িকভাবে এসব রুট বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিমানের পরিচালনা পর্ষদ। সেই সঙ্গে লন্ডন, কুয়ালালামপুর, ব্যাংকক, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন রুটে ফ্লাইটও কমিয়ে আনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

অব্যবস্থাপনাই দায়ী : লোকসান আর নানা কেলেঙ্কারির জন্য বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের অব্যবস্থাপনাকেই দায়ী করেন বিশেষজ্ঞরা। লোকসান থেকে উত্তরণে বিমানের ব্যবস্থাপনা কৌশল ও মার্কেটিংকে আরও শক্তিশালী করার কথ? বলছেন তারা। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে বরাবরই বিমান কর্তৃপক্ষের উদ্যোগের অভাব রয়েছে। আয়ের বদলে ব্যয় বাড়ানোই বিমানের প্রচলিত রেওয়াজ। রাজস্ব আয় বাড়ানোর পাশাপাশি ব্যয় কমাতে বেশি মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের বিমান-সংক্রান্ত কমিটির এক প্রতিবেদনে। লোকসানি প্রতিষ্ঠানের অবস্থান কাটাতে আর্থিক বিষয়ে ১৫ দফা সুপারিশ এসেছে। এসব সুপারিশে মাথা ভারি প্রশাসন ব্যবস্থা ভেঙে জনবল কমিয়ে আনার ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বিমানকে কোম্পানিতে পরিণত করার সময় সরকারের নির্দেশনা ছিল অনুমোদিত জনবল ৬ হাজার ৮৮৩ থেকে কমিয়ে ৩ হাজার ৪০০ জনে নামিয়ে আনা। কিন্তু জনবল এখনো ৪ হাজার ৪৫১ জন। প্রায় এক হাজার বেশি জনবল বিমানের ব্যয় বাড়ার অন্যতম কারণ। শুধু অতিরিক্ত জনবলই নয়, সেখানে বেতন-ভাতা-ওভারটাইমের নানা কারসাজি আর দুর্নীতিতে প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটে বলে অভিযোগ রয়েছে। কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পর‌্যালোচনা করলে দেখা যায়, মূল বেতনের ১৭২ শতাংশ ভাতা হিসেবে খরচ হয়। ৪০ শতাংশ খরচ হয় ওভারটাইম হিসেবে। ব্যক্তি পর‌্যায়ে অনেকে মূল বেতনের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি ওভারটাইম বিল উত্তোলন করে থাকেন। বিমানের আয়ের পথগুলো দিন দিন সংকুচিত হওয়ায় লোকসানের পাল্লা ভারি হয়ে উঠছে।

বিমানের ২৯ ঘাটে লুটপাট : বাংলাদেশ বিমানের দশ বিভাগের ২৯ ঘাটে প্রতি মাসে শত কোটি টাকার লুটপাট চলছেই। শ্রমিক লীগের এক প্রভাবশালী নেতাসহ ১১ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট এসব লুটপাটের অন্যতম হোতা। আধুনিক নানা পদ্ধতি প্রয়োগ করে, ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন এনেও সেসব লুটপাট বন্ধ করা যাচ্ছে না। অভিযোগ রয়েছে, লুটপাট করে বিমানের অর্ধ শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে উঠেছেন। বাড়ি-গাড়ি, শানশওকতের কোনো কমতি নেই তাদের। লুটপাটের টাকা বিমান ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা কয়েকজন কর্মকর্তাসহ প্রভাবশালী মহলের মধ্যেও ভাগবণ্টন হয়। ফলে অভিযুক্ত সিন্ডিকেট সদস্যরা বরাবরই থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। বিমানের মতিঝিল সেলস অফিস, কার্গো বিভাগ, এয়ারপোর্ট সার্ভিস বিভাগ, বিক্রয় ও বিপণন পরিদফতর, সম্ভার ও ক্রয় পরিদফতর, যানবাহন উপবিভাগ, সিকিউরিটি ও তদন্ত বিভাগ, বিএফসিসি, বিমানের কর্মচারী নিয়োগ, পদোন্নতি ও ডিউটি রোস্টার শাখায় মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেন ও লুটপাট ঘটে থাকে।

সিট রিজারভেশনের নামে হয় সবচেয়ে ক্ষতিকর কার্যকলাপ। সিট রিজারভেশন শাখায় এজেন্টদের কাছ থেকে সিট কনফার্মের নামে ফ্লাইটভিত্তিক টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। বিমানের ট্রাভেল এজেন্ট, মার্কেটিং ও রিজারভেশন শাখায় এই সিন্ডিকেট রীতিমতো স্থায়ী ঘাঁটি গেড়ে বসেছে। ঘাটে ঘাটে মাসোহারা, চাঁদাবাজিসহ লাগামহীন দুর্নীতি জেঁকে বসেছে বিমানে। উড়োজাহাজ কেনা, লিজ নেওয়া, প্রয়োজনীয় কেনাকাটা, মেরামত, স্পেয়ার পার্টস কেনা, বিএফসিসি, পোলট্রি, টিকিট বিক্রি, গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং, বৈদেশিক অফিস চালনা, লোকবল নিয়োগসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে চলছে সীমাহীন লুটপাট। কর্মচারী থেকে বোর্ড সদস্য কোথাও টাকা ছাড়া কাজ হয় না। ফলে বেসরকারি ও বিদেশি এয়ারলাইনস যখন লাভ করছে, তখন বাংলাদেশ বিমান গুনছে লোকসান।

সর্বশেষ খবর