মঙ্গলবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

সুর-তালে ভিজছে অন্তর্জমিন

মোস্তফা মতিহার

সুর-তালে ভিজছে অন্তর্জমিন

হেমন্তের আকাশে বৃষ্টি নেই, তবুও বৃষ্টি স্নাত আর্মি স্টেডিয়াম। অদৃশ্য বৃষ্টির ধারা প্রবাহিত হচ্ছে মাঠের ভেতরের এবং গ্যালারির সব সুরপিয়াসীদের অন্তর্জমিনে। আর সুরের সেই বৃষ্টির ছিটেফোঁটা আর্মি স্টেডিয়ামের বাইরের রাস্তার মানুষদের মনেও দোলা দিচ্ছিল। অসহনীয় যানজট উপেক্ষা করে সুরের টানে স্টেডিয়ামে আসার পর সুরের সমজদারদের বিন্দুমাত্র নিরাশ করেনি সুরের সাধকরা। সুরের বৃষ্টিতে কয়েক হাজার শ্রোতার অন্তর্জমিনকে ভিজিয়ে উচ্চাঙ্গসংগীত আসরের চতুর্থ রাতের আসরকে সুরের রঙে রাঙিয়ে তোলেন শাস্ত্রীয়সংগীতের উপমহাদেশের প্রখ্যাত শিল্পীরা। স্কয়ার টয়লেট্রিজের নিবেদনে ও বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের আয়োজনে গত ২৭ নভেম্বর রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়ামে শুরু হয় পাঁচরাতের ‘বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব ২০১৫’। গত বছরের এই দিনে অর্থাৎ উৎসবের চতুর্থ রাতের আসরে বক্তৃতারত অবস্থায় চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং পরবর্তীতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন বলে গতরাতের উৎসবে কাইয়ুম চৌধুরী স্মরণে প্রদর্শিত হয় ‘নিসর্গের আঁকিয়ে’ শীর্ষক ৮ মিনিটের তথ্যচিত্র। বরেণ্য এই প্রয়াত চিত্রশিল্পীর স্মরণে এই তথ্যচিত্রটি  প্রদর্শনের মধ্য দিয়েই উৎসবের চতুর্থ রাতের আসরের সূচনা ঘটে। এ সময় শাস্ত্রীয় সুরের এই বর্ণাঢ্য আসরে কিছু সময়ের জন্য বয়ে আসে রাজ্যের নীরবতা। বিষাদের সুর বেজে উঠে অনুষ্ঠানস্থলে আগত সব শ্রোতা ও দর্শকের হƒদয়ে। বেদনাবিদুর পরিবেশে এ সময় অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়ে অনেক শ্রোতা। এই উৎসবে বক্তৃতারত অবস্থায় অসুস্থ হয়ে কাইয়ুম চৌধুরী না ফেরার দেশে চলে যান বলে এবারের উৎসবটি উৎসর্গ করা হয়েছে প্রয়াত বরেণ্য এই চিত্রশিল্পীকে। কাইয়ুম চৌধুরীকে স্মরণের পরে আবারও শুরু হয় সুরের খেলা। এরপর মঞ্চে আসেন ভারতের বিশিষ্ট নৃত্যদম্পতি দম্পতি গুরু রাজ রেড্ডি ও রাঁধা রেড্ডি। কর্নাটকী ভারতীয় নৃত্য কুচিপুডির অনবদ্য পরিবেশনায় অনুষ্ঠানস্থলের সুরপিয়াসীদের নৃত্যের তাক ধিনা ধিন মুদ্রায় সুন্দর ও শিল্পের নৈপুণ্যের ঝঙ্কার তোলেন ভারতের এই নৃত্যদম্পতি। দর্শক শ্রোতাদের পিনপতন নীরবতা প্রমাণ কমর চোখ দিয়ে দেখলেও সম্পূর্ণ নাচকে তারা হƒদয় দিয়ে গ্রহণ করছেন। ভারত সরকারের পদ্মশ্রী ও পদ্মভ‚ষণ পুরস্কার পাওয়া এ দম্পতির যুগল নৃত্য সুরের এই আসরে যোগ করে ভিন্নতা। এরপর নাচের মুদ্রায় দর্শকদের নাচান গণেশ ও কুমারেশ রাজাগোপালন। চতুর্থ রাতের তৃতীয় শিল্পী হিসেবে মঞ্চে আসেন পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা। সন্তুরের বাদনে স্টেডিয়ামের সব শ্রোতাকে সুরের মায়াজালে আবদ্ধ করে তোলেন জম্মু কাশ্মীরের এই শিল্পী।

সন্তুরের তারে তারে যে সুরের এত খেলা লুকিয়ে আছে তা আরেকবার নতুন করে জানলেন এই শিল্পী। পদ্মশ্রী ও পদ্মবিভ‚ষণ সম্মাননায় ভ‚ষিত এই শিল্পীর পরিবেশনা মন্ত্রমুগ্ধের মতো উপভোগ করেন দর্শক-শ্রোতা। পণ্ডিত শিবকুমার শর্মার সন্তুরের সুরের রেশ কাটতে না কাটতেই সরোদের স্বর্গীয় সুরের আবেশে স্টেডিয়ামের সমগ্র প্রাঙ্গণে এক অমৃত ধারা প্রবাহিত করেন সরোদ শিল্পী পণ্ডিত তেজেন্দ্র নারায়ণ মজুমদার। সরোদের তালে বুদ্ধিবৃত্তিক গভীরতা এবং কৌশলগত দক্ষতার এক অপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়েছেন। এর পাশাপাশি ধ্র“পদ, তন্ত্রকারি ও বিভিন্ন ধরনের গায়কীর উপাদানও তার পরিবেশনায় স্পষ্ট।

গত রাতের মূল আকর্ষণ ছিলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত ওস্তাদ জাকির হোসেন। এই শিল্পীর তবলার তালে ধন্য হতে সন্ধ্যা থেকেই স্টেডিয়াম প্রাঙ্গণে সুর-পাগলদের গভীর প্রতীক্ষা। শ্রোতাদের ধৈর্যের প্রমাণ শিল্পী দিয়েছেন তার সপ্তর্ষি সুরের তবলার নিপুণ বাদনে। এরপর গভীর রাতে মঞ্চে আসেন পণ্ডিত উলহাস কশলকর। বিখ্যাত এই শিল্পী পরিবেশন করেন খেয়াল। কণ্ঠের ওাা-নামায় রাগ-রাগিনীর খেলায় খেয়ালের এক চমৎকার ঢেউ তোলেন শাস্ত্রীয়সংগীতের এই শিল্পী।

আজ শেষ হবে পাঁচ রাতের এই আসর। মঙ্গলবার পঞ্চম ও সমাপনী আসর শুরু হবে সন্ধ্যা ৭টায়। অনিমেষ বিজয় চৌধুরীর পরিচালনায় সিলেটের আটজন শিল্পীর অংশগ্রহণে ধামার পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শেষ রাতের সুরের খেলা শুরু হবে।  সমাপনী আয়োজনে প্রধান অতিথি থাকবেন ব্র্যাক ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান স্যার ফজলে হাসান আবেদ। বিশেষ অতিথি থাকবেন প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিকবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী, বিনিয়োগ বোর্ডের এক্সিকিউটিভ চেয়ারম্যান ড. সৈয়দ এ সামাদ। অতিথি থাকবেন ভারতীয় হাইকমিশনার পংকজ শরণ ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক। সভাপতিত্ব করবেন ইমিরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। সমাপনী রাতের মূল আকর্ষণ হিসেবে থাকছেন পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া। এ ছাড়া আরও থাকবেন ওস্তাদ বিলায়েত খাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র ইরশাদ খান। খেয়াল পরিবেশন করবেন সামিহান কশলকর। বিলায়েত খাঁর পুত্র ওস্তাদ সুজাত খান।

সর্বশেষ খবর