বুধবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

দেউলিয়া হওয়ার পথে ইউনাইটেড এয়ার

লাকমিনা জেসমিন সোমা

দেউলিয়া হওয়ার পথে ইউনাইটেড এয়ার

দেনার ভারে ভেঙে পড়েছে বেসরকারি এয়ারলাইনস কোম্পানি ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ (বিডি) লিমিটেড। ‘সি’ চেকসহ নানা জটিলতায় কোম্পানির ১১টি উড়োজাহাজের মধ্যে এখন ৯টিই পড়ে আছে অকেজো হয়ে। বন্ধ হয়ে গেছে বেশির ভাগ রুটের ফ্লাইট অপারেশন। সিভিল এভিয়েশন অথরিটি বা বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) বলছে, প্রতিষ্ঠানটির কাছে তাদের পাওনা প্রায় ১২৫ কোটি টাকা। অন্যদিকে নিজেদের দৈন্যদশার পেছনে খোদ বেবিচককেই দায়ী করছে কোম্পানিটি। দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিভিন্ন কোন্দলে চলছে পাল্টাপাল্টি মামলা। এরই মধ্যে এয়ারলাইনস থেকে চাকরি ছেড়ে চলে গেছেন অনেকেই। সব মিলিয়ে দেউলিয়ার পথে হাঁটছে এই বেসরকারি কোম্পানিটি।

বেবিচকের অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের কাছে তাদের পাওনা ১২২ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। দেশের অভ্যন্তরে বিমানবন্দর ও আকাশপথ ব্যবহারসহ বিভিন্ন সার্ভিস চার্জ বাবদ এ টাকা পাবে বেবিচক। সিভিল এভিয়েশন ও বিমান মন্ত্রণালয় সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুসারে, গত ২৯ জুন সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে ইউনাইটেডকে চারটি শর্তে শেষবারের মতো বকেয়া পরিশোধের সুযোগ দেওয়া হয়। এর মধ্যে প্রথমত,  জুলাই এবং আগস্টের ১৫ তারিখের মধ্যে ১ কোটি ৮ লাখ টাকা করে দুই কিস্তিতে বকেয়া পরিশোধ করবে। দ্বিতীয়ত, ৩০ আগস্টের মধ্যে এম্বারকেশন ফির সমুদয় বকেয়া অর্থ পরিশোধ করবে। তৃতীয়ত, ৩০ নভেম্বরের মধ্যে বেবিচকের বকেয়া পাওনা থেকে ২৫ কোটি টাকা পরিশোধ করবে। আর চতুর্থত, ৩০ নভেম্বরের মধ্যে এসব বকেয়া পরিশোধে ব্যর্থ হলে কোম্পানির সব কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হবে। জানা গেছে, ওপর মহলের এ বৈঠকের পর প্রথম শর্ত অনুসারে ১ কোটি ৮ লাখ টাকার দুটি চেক প্রদান করে ইউনাইটেড কর্তৃপক্ষ। কিন্তু চেকের টাকা তুলতে গিয়ে বিপাকে পড়ে বেবিচক। ইউনাইটেড কর্তৃপক্ষের অ্যাকাউন্টে পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় চেক দুটি ফেরত আসে। বাকি শর্তগুলোও পূরণে ব্যর্থ হয় কোম্পানিটি। এমন কি তারা বর্তমানে যে কটি ফ্লাইট পরিচালনা করছে, তারও কোনো চার্জ পরিশোধ করছে না। এ অবস্থায় গত ১৮ নভেম্বর বেবিচকের চেয়ারম্যান এম সানাউল হক স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে কোম্পানির এওসি বা লাইসেন্স নবায়ন না করার সুপারিশ করা হয়েছে। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ৩০ নভেম্বরের পর ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের এওসির মেয়াদ বাড়ানো ‘সমীচীন হবে না’। জানতে চাইলে বেবিচকের অর্থ বিভাগের সদস্য মিজানুর রহমান বলেন, ‘ইউনাইটেডকে বারবার সুযোগ দেওয়া সত্ত্বেও তারা কথা শুনছে না। উল্টো চেক নিয়ে বিপাকে পড়তে হয়েছে আমাদের। ছোট বিমান নিয়ে আন্তর্জাতিক রুটে চলাচল করে এত টাকা চার্জ দিতে পারবে কিনা, তা তাদের আগেই ভেবে দেখা উচিত ছিল।’

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ‘সি’ চেকসহ নানা জটিলতায় কোম্পানির ১১টি উড়োজাহাজের মধ্যে ৯টি উড়োজাহাজই এখন গ্রাউন্ডেড (ব্যবহার অনুপযোগী) হয়ে পড়ে আছে। নির্দিষ্ট সময় অন্তর উড়োজাহাজের ইঞ্জিন ও ল্যান্ডিং গিয়ারসহ গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ পরীক্ষা ও রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন পড়ে। ১৫ মাস অন্তর এটি করা বাধ্যতামূলক। আর এ কাজটিই হলো ‘সি’ চেক। তবে ইউনাইটেডের পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) এম শাহাবুদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাছে অভিযোগ করে বলেন, ‘নিয়ম অনুসারে বেবিচকের দুজন কর্মকর্তাকে নিয়ে বিদেশে সি চেক করতে যাওয়ার জন্য যাবতীয় অর্থসহ বারবার তাগাদা দিলেও সাড়া দিচ্ছে না সংস্থাটি। তাদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিদেশ ভ্রমণে সরকারি অনুমোদন (জিও) না পাওয়ায় তারা যেতে পারছেন না। ফলে সি চেকের অভাবে আমাদের উড়োজাহাজগুলোও কাজে লাগানো যাচ্ছে না।’ জানা গেছে, এ নিয়ে দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চলছে ব্লেম গেম। আর গ্যাঁড়াকলে পড়ে মরিচা ধরতে শুরু করেছে কোম্পানির উড়োজাহাজগুলোয়। কোম্পানিটি ২০০৭ সালে যাত্রা শুরু করে সর্বোচ্চ ১৮টি রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করলেও বর্তমানে তারা মাত্র দুটি উড়োজাহাজ দিয়ে অনিয়মিতভাবে ৫-৭টি রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। এদিকে গত শনিবার রাজধানীর উত্তরায় এয়ারলাইনসটির হেড অফিসে গিয়ে দেখা গেছে, কর্মীদের মাঝে সুনসান নীরবতা। অন্যদিকে নিজেদের দৈন্যদশা নিয়ে মিটিং-সিটিংয়ে ব্যস্ত ওপর মহল। এরই মধ্যে রিসিভশন বা তথ্য অনুসন্ধান ডেস্কে এসে কয়েকজন নিচু গলায় জানতে চাচ্ছিলেন— কোম্পানি কি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে? ঝামেলা কি কেটেছে? পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনুসন্ধানকারীরা সেখানে চাকরির ভাইভা দিতে এসেছিলেন। কিন্তু পরে তারা কোম্পানিটিই আদৌ থাকবে কিনা, তা নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেছেন। এ ব্যাপারে কথা বলতে সেখানে দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করেও কোম্পানির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাসবিরুল আহমেদকে পাওয়া যায়নি। জানা গেছে, পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের বর্তমানে ১ লাখ ৩৫ হাজার শেয়ারহোল্ডার রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, শেয়ারবাজার থেকে এখন তারা তাদের টাকা-পয়সা তুলে নেওয়ার চিন্তা করছে। এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) ইউনাইটেডের এমডি তাসবিরুলের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করেছে। তার বিরুদ্ধে শেয়ারবাজার থেকে ৪১৫ কোটি টাকা উত্তোলনের চেষ্টা, বিদেশ থেকে নিয়মবহির্ভূত পুরনো উড়োজাহাজ কেনার নামে টাকা পাচারসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে।

পাল্টাপাল্টি মামলা-মোকদ্দমা : ইউনাইটেডের দেওয়া ১ কোটি ৮ লাখ টাকার দুটি চেক ডিসঅনারর্ড হওয়ার ঘটনায় ইউনাইটেডের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাসবিরুল আহমেদ চৌধুরী এবং প্রশাসন ও অর্থ বিভাগের পরিচালক ফেরদৌস ইমামের বিরুদ্ধে ‘চেক প্রতারণার’ মামলা করেছে বেবিচক। এ মামলায় অভিযুক্তদের গত ১২ নভেম্বর আদালতে হাজির থাকার কথা থাকলেও তারা হাজির না হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে  গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। পরে পাল্টা অভিযোগ তুলে ১ হাজার ২০৮ কোটি ৮১ লাখ ৯৩ হাজার ৬৮৬ টাকা ক্ষতিপূরণের মোকদ্দমা করেছে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ। জানা যায়, নির্ধারিত সময়ে চার্জ পরিশোধ না করায় নিয়ম অনুযায়ী ছয় শতাংশ হারে সারচার্জ আরোপ করায় এ এয়ারলাইনসটির বকেয়া বিশাল আকার ধারণ করেছে। তাদের মূল বিল যেখানে ৫৩ কোটি ৮১ লাখ টাকা, সেখানে সারচার্জ হয়েছে ৬৯ কোটি ১৩ লাখ টাকা। তারপরও সরকারের পক্ষ থেকে একাধিকবার সুযোগ দেওয়া হয় কোম্পানিটিকে। প্রসঙ্গত, এর আগে প্রায় দেড়শ কোটি টাকা দেনা নিয়ে বন্ধ হয়ে যায় জিমেজি এয়ারলাইনস।

সর্বশেষ খবর