শুক্রবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

দুধের গ্রাম চণ্ডীপুর

সামছুজ্জামান শাহীন, খুলনা

দুধের গ্রাম চণ্ডীপুর

কাকডাকা ভোরেই জেগে ওঠে চণ্ডীপুর গ্রাম। তখনই শুরু হয়ে যায় নতুন দিনের কর্মযজ্ঞ। বউ-ঝিরা ছোটেন গোয়াল ঘরে। গাভীগুলোকে উঠোনে জড়ো করেন। গোবর সরিয়ে রাখেন নির্দিষ্ট স্থানে। চলতে থাকে পরিচ্ছন্নতার কাজও। এরপর একে একে গাভীগুলোর দুধ দুইয়ে ভর্তি করা হয় ছোট বড় সিলভারের কলসিতে। সেই কলস নিয়ে পুরুষরা ছোটেন স্থানীয় দুধ বিক্রির সেন্টারে। সেখানে আগে থেকেই অপেক্ষায় থাকেন ডেইরি ফার্মের প্রতিনিধিরা। এভাবেই নিত্যদিনের কর্মযজ্ঞ চলে দুধের গ্রাম চণ্ডীপুরে। খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম চণ্ডীপুর। গাভী পালন ও দুধ উৎপাদনে বিখ্যাত গ্রামটি পরিচিতি পেয়েছে ‘ঘোষ গ্রাম বা দুধের গ্রাম’ নামে। খুলনা, সাতক্ষীরা, যশোর ও বাগেরহাট অঞ্চলের অধিকাংশ ডেইরি ফার্ম, মিষ্টির দোকান ও গৃহস্থ্যের দুধের চাহিদা মেটানো হয় এ গ্রাম থেকেই। এই গ্রামের ঘোষপাড়ায় অঞ্জলী ঘোষ সাতটি গাভী পালন করেন। তিনি বললেন, ‘বউ হয়ে আসার পর থেকেই দেখেছি গ্রামের সকলেই গাভী পালন করছে। গাভী পালন ও দুধ উৎপাদনে এখানকার মানুষ সফল। নির্ভেজাল ও ফরমালিনমুক্ত খাঁটি দুধ সরবরাহ করছি আমরা।’ গ্রামবাসীর ভাষ্য অনুযায়ী, বাড়িতে স্বল্প জায়গায় ঝুঁকিবিহীন সফল ব্যবসা গাভী পালন। ধান, গম ও পাটের চেয়ে এটি বেশ লাভজনক। গাভী পালন চণ্ডীপুর গ্রামের মানুষের একমাত্র পেশা। প্রত্যেকের ঘরেই দুই থেকে ১০টি পর্যন্ত গাভী আছে। দুধ বিক্রি করে এখানকার মানুষ সুখের মুখ দেখেছেন। আত্মকর্মসংস্থানের পাশাপাশি পরিবারের ভরণ-পোষণ ও জীবন-জীবিকায় স্বাবলম্বী হয়েছেন তারা। সরেজমিন গিয়ে জানা যায়, সাধারণত দুটি গাভী থেকে প্রতিদিন গড়ে ১২ লিটার দুধ বাজারে বিক্রি হয় ৪০০ টাকায়। সেই হিসাবে মাসে দুধ বিক্রি করে আয় হয় ১২-১৩ হাজার টাকা। যাদের গাভী বেশি তাদের আয়ও বেশি। নিজেদের উত্পন্ন নেপিয়ার ঘাসের (বড় জাতের ঘাস) সঙ্গে দোকান থেকে কেনা গো-খাদ্য ও ভুসিতে দুটি গাভীর প্রতিদিন খরচ ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। এই গ্রামের দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমিতির সভাপতি সুবীর ঘোষ জানান, গ্রাম থেকে প্রতিদিন কমপক্ষে দুই হাজার লিটার দুধ সরবরাহ করা হয়। ৫০টির মতো ঘোষ পরিবারে গাভী রয়েছে তিনশ’র বেশি। এর মধ্যে অধিকাংশই শংকর জাতের বড় গাভী। গ্রামে কয়েকঘর মুসলমান আছে, তারাও দুধের ব্যবসায় নিয়োজিত। তিনি জানান, দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমিতির মাধ্যমে গ্রামবাসীকে একত্রিত করা হয়েছে। বর্তমানে সমিতির সদস্য সংখ্যা ৪১। স্থানীয়ভাবে দুধ সংগ্রহের পর তা মিল্কভিটা, প্রাণ ও ব্র্যাকের মতো ডেইরি ফার্মগুলোতে বিক্রি করা হয়। তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘মিল্কভিটার সাতক্ষীরা অফিস থেকে দুধের ন্যায্য দাম দেওয়া হয় না। এ অফিসের কর্মকর্তারা নানা বাহানা করে খামারিদের ঠকাচ্ছেন। কর্মকর্তারা দুধ রিসিভ না করে দারোয়ান দিয়ে রিসিভ করান। ফ্যাটের পরিমাণও কম নির্ধারণ করছেন। এতে খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।’ দুধ উৎপাদনকারী কার্তিক ঘোষ বলেন, ‘গ্রামে কেউ বাছুর লালন-পালন করে না। একটু বড় হলে তা বাজারে বিক্রি করে দেয়। যারা গাভী চাষ করে তারাই আবার খেতে নেপিয়ার ঘাষ চাষ করে। সেই ঘাস গাভী খায়। অনেকে দুধ বিক্রি ছাড়াও গরুর গোবর থেকে তৈরি ঘুটে বিক্রি ও শুধু খেতে নেপিয়ার ঘাস চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। ফড়িয়ারা গ্রাম থেকে গবরের ঘুটে কিনে শহরে জ্বালানি হিসেবে বিক্রি করেন।’ চণ্ডীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক খলিলুর রহমান বলেন, ‘বহু বছর আগ থেকেই চণ্ডীপুর বিখ্যাত দুধের গ্রাম বলে পরিচিতি পেয়েছে। তবে সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতায় এখানে গাভী লালন-পালনের ব্যবস্থা নেই। দীর্ঘ সময় দুধ সংরক্ষণেরও কোনো ব্যবস্থা নেই। গ্রামে পাকা সড়ক না থাকায় যোগাযোগের সমস্যায় গাভী পালনকারীদের মাঝে-মধ্যেই বিপাকে পড়তে হয়।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর