রবিবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় মন্ত্রণালয় সবই করছে

নিজামুল হক বিপুল

আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় মন্ত্রণালয় সবই করছে

আনিসুল হক

দেশে আইনের শাসন কায়েম করতে গেল এক বছরে সরকার অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে। এক বছর বললে ভুল হবে। এ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর গত দুই বছরে আমার মেয়াদে অনেক আইন প্রণয়নের কাজ করেছি। অনেক আইন যুগোপযোগী করেছি। সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করা। আর অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে এবং স্বল্প সময়ের মধ্যে আমরা শিশু রাজন ও রাকিব হত্যার বিচারকাজ সম্পন্ন করেছি। যার ধারাবাহিকতায় আরও কয়েকটি হত্যা মামলার বিচারকাজও সম্পন্ন হয়েছে। সরকারের দুই বছর পূর্তি আর গত এক বছরে নিজের মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে এভাবেই বর্ণনা দিলেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক। ২৪ ডিসেম্বর গুলশানের বাসভবনে বসে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন আইনমন্ত্রী।

মন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন ছিল— গত এক বছরে দেশে আইনের শাসন কায়েমে তার এবং তার মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা কী ছিল? অর্জনই বা কী? জবাবে আনিসুল হক বলেন, আমার বা আমার মন্ত্রণালয়ের কাজের পরিধি হচ্ছে বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও সংসদের মধ্যে একটা সেতু হিসেবে কাজ করা। সে ক্ষেত্রে আমাদের অনেক কাজ। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আইন প্রণয়ন এবং অন্য যেসব যুগোপযোগী আইন করা হচ্ছে, সেগুলো ভেটিং করা। আইন ও বিচার বিভাগ যা করেছে তা হচ্ছে ভৌত অবকাঠামো স্থাপন। এটা ছিল খুবই জরুরি। সেই প্রয়োজনীয়তার আলোকেই ১৯৯৬ সাল থেকে সারা দেশে জেলায় জেলায় আদালত ভবন নির্মাণ ও ভার্টিকেল এক্সটেনশন, জেলা জজ ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেসি— সেই কাজগুলো আমরা ত্বরান্বিত করছি। দেখেন ১৯৯৬ সালে এ কাজ শুরু হলেও এখনো অনেক জায়গায় শেষ হয়নি। তা ছাড়া ২০ বছর আগের যে প্রয়োজনীয়তা, ২০ বছর পরে এসে আজকের প্রয়োজনীয়তায় অনেক পার্থক্য আছে। সেই পার্থক্যকে বিবেচনায় নিয়ে আমাদের এ প্রকল্পগুলোকে আরও মোটিভেটেড করতে হচ্ছে। এসব কাজের জন্য অর্থায়নের ব্যবস্থা করা। ভৌত অবকাঠামোর এ কাজগুলো আমরা করেছি।

আইনমন্ত্রী বলেন, বিচার বিভাগ স্বাধীন। বিচার বিভাগের স্বার্থে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন এবং সুপ্রিমকোর্ট আমাদের যেসব পরামর্শ দিয়েছেন আমরা সেগুলো বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছি। যখনই একজন প্রধান বিচারপতির সময় শেষ হয়ে আসে, নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয় তখন অনেক রকম জল্পনা-কল্পনা হয়। কিন্তু এই কয়েক বছরে অর্থাৎ ২০০৯ সাল থেকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ হয়েছে ধারবাহিকভাবে জ্যেষ্ঠতা অনুযায়ী। এ নিয়োগ দিয়ে থাকেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি। আমরা এখানে সেতু হিসেবে কাজ করি।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে একটা বড় ইস্যু। বছরজুড়ে আলোচনায় থাকা এ ইস্যু সম্পর্কে আইনমন্ত্রী বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং বিচার-পরবর্তী রায় কার্যকরের প্রক্রিয়া, আইন মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা এগুলো আপনারা দেখেছেন। এই আমার আমলেই তিনজন বড় যুদ্ধাপরাধীর রায় কার্যকর হয়েছে। বাকি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজ চলছে।

আইনমন্ত্রী বলেন, এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পর আমি যে কাজটা করেছি তা হচ্ছে সাবরেজিস্ট্রার বদলির ক্ষেত্রে ঘুষ-দুর্নীতি অনেকাংশে বিলুপ্ত করেছি। এটা আমার একটা বিশেষ কাজ ছিল। এখন কিন্তু ঘুষের বিনিময়ে বদলি হচ্ছে না এবং হবে না। আমি সাবরেজিস্ট্রারদের সঙ্গে একটা ওয়ার্কিং রিলেশন গড়ে তুলেছি। কারণ আমি চাই জনগণ সাবরেজিস্ট্রার অফিসে যে সেবার জন্য আসে, হয়রানি ছাড়া আইনত যেটা তাদের পাওয়ার কথা, সেটা যেন নিশ্চিত করা যায়, সে জন্য আমি সাবরেজিস্ট্রারদের সঙ্গে একটা সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছি। আমার মূল লক্ষ্য হচ্ছে সাবরেজিস্ট্রি অফিসে দুর্নীতি কমানো। মন্ত্রী বলেন, আমি যখন মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিই তখন আমাকে জানানো হয়, তারা চার বছর ধরে নকল দিতে পারছেন না। কারণ বালাম বই, রসিদ ছিল না। আমি দায়িত্ব নিয়েই বাজেট থেকে অর্থের ব্যবস্থা করে ১ লাখ ৯৫ হাজার বালাম বই দিই। আরও ৯৫ হাজার বালাম বই এখন দিচ্ছি। এখন কিন্তু আর ব্যাক লক নেই। আনিসুল হক বলেন, সরকারের প্রসিকিউশনের সুপারভিশনের দায়িত্বও আমার। তাই আমি প্রসিকিউশনের যেসব নিয়োগ দিয়েছি, সবার সঙ্গে আলোচনা করে দিয়েছি, যাতে স্বীয় জেলার যেসব কর্মকাণ্ড তা যেন সেখানকার জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে একটা সম্পৃক্ত থাকে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েই যেহেতু মামলা-মোকদ্দমার ব্যাপার, সেটাও যেন সবার নলেজের মধ্যে হয় সেই ব্যবস্থাও আমরা করেছি। প্রসিকিউটরদের বেতন অত্যন্ত অপ্রতুল। আমি তাদের বেতন বাড়ানোর প্রস্তাব করেছি, প্রধানমন্ত্রী সে প্রস্তাবে সম্মত হয়েছেন। আমার মনে হচ্ছে, আগামী বাজেটে এটি অনুমোদন পাবে। আইনমন্ত্রী বলেন, আমরা গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা করছি, সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করছি। সে ক্ষেত্রে সংবিধানের যেসব জায়গায় অগণতান্ত্রিক কথাবার্তা যেটা সামরিক সরকার ঢুকিয়ে দিয়েছিল সেটা আমরা পরিবর্তনের চেষ্টা করেছি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হচ্ছে ষোড়শ সংশোধনীতে। সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের প্রমাণিত গুরুত্বপূর্ণ গ্রস মিসকন্ডাক্ট এবং অসামর্থ্যতা— এ দুই কারণে তাদের সরানো যায় অর্থাৎ ১৯৭২ সালের সংবিধানে যেটা ছিল সেটা প্রতিস্থাপন করেছি বা ফিরিয়ে এনেছি। এর সঙ্গে অনুচ্ছেদ ৯৬-এর এই যে সাংবিধানিক সংশোধনের মধ্যেও (১৯৭২ সালের সংবিধানেও এটা ছিল) এটা করার জন্য যে পদ্ধতি তার জন্য একটা আইন করা হবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য আইন সংশোধনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, জামায়াতের বিচারের জন্য ১৯৭৩ সালের ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম অ্যাক্টসের যে সংশোধন প্রয়োজন সেই সংশোধনটাও কিন্তু আমরা করে দিয়েছি। এখন মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের অপেক্ষায়। আশা করছি আগামী মার্চের মধ্যেই এটি মন্ত্রিসভার অনুমোদন পেয়ে যাবে। নিজের মন্ত্রণালয়ের গত এক বছরের কর্মকাণ্ড তুলে ধরতে গিয়ে আনিসুল হক বলেন, অতিসম্প্রতি আপনারা দেখেছেন বাংলাদেশের ইতিহাসে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর এত দ্রুত কোনো হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি। যেটা আমি শিশু রাজন ও রাকিব হত্যা মামলার বিচারের ক্ষেত্রে করতে করেছি। আমি তো আর বিচার করতে পারি না। বিচার বিভাগ ও আদালত স্বাধীন। কিন্তু প্রসিকিউশনকে সেভাবে প্রস্তুত করেছি এবং দ্রুত বিচারের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য প্রসিউকিউশনকে সহযোগিতা করেছি; যার ফলে এ মামলাগুলো দ্রুত শেষ হয়েছে। এ দুটি বিচারের ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত কোনোরকম ত্রুটি নেই। এ বিচারের পর আপনারা দেখেছেন পরপর পাঁচ-সাতটি মামলা দ্রুত শেষ হয়েছে। আমি মনে করি, এ ধারা অব্যাহত থাকলে আমরা মামলাজট কমিয়ে ফেলতে পারব। আইনমন্ত্রী বলেন, আমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে মামলার জট কমিয়ে আনা। কারণ আমি মনে করি, ‘জাস্টিস ডিলেইড ইজ জাস্টিস ডিনাইড’। সে ক্ষেত্রে মামলা কমিয়ে আনার জন্য আমরা বিকল্প চিন্তা করছি। দেওয়ানি মামলায় আপসের ব্যাপারে যেসব পদ্ধতি সেগুলো সহজ করা, ফৌজদারি মামলায় আদালতকে উদ্বুদ্ধ করা, যে বা যারা বিচারপ্রার্থী হন তাদের যেসব মামলা আপসযোগ্য সেসব মামলা নিয়ে যেন তারা আদালতের দ্বারস্থ না হন। আরেকটা বিষয় হচ্ছে আমি ন্যাশনাল লিগ্যাল এইড সার্ভিসকে চাঙ্গা করেছি। তারা যেন জনগণকে শুধু আইনি পরামর্শই নয়, আদালতের বাইরে কেইস বেসিসে সমস্যা সমাধানে পরামর্শ দেন সে জন্য এ সংস্থাকে শক্তিশালী করছি। তিনি বলেন, আর জাতীয় মানবাধিকার সংস্থার কার্যক্রম তো আপনারা দেখছেন। আনিসুল হক বলেন, আমি মনে করি সার্বিকভাবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যা যা করা দরকার তার সবই আমি করছি। এখন জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনে বিচারক নিয়োগের কাজ চলছে। বিচারকের স্বল্পতার কথা স্বীকার করে মন্ত্রী বলেন, আমরা চেষ্টা করছি যে, যারা দক্ষ বিচারক, তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করার একটা অবকাঠামো তৈরির চেষ্টা করছি। ইতিমধ্যে আমরা ৪৫৭ জন বিচারক নিয়োগ করেছি। আরও করা হচ্ছে। এটা চলমান প্রক্রিয়া।

সর্বশেষ খবর