শুক্রবার, ১ জানুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

স্বস্তি ছিল না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে

সাখাওয়াত কাওসার

স্বস্তি ছিল না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে

জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর ২০১৫। পেট্রলবোমা আতঙ্ক আর রাজনৈতিক অস্থিরতা দিয়ে শুরু হলেও বছর শেষ হয়েছে ধর্মীয় উগ্রবাদীদের হামলার আশঙ্কা মাথায় নিয়ে। যানবাহনে পেট্রলবোমা, আগুনে পোড়া মানুষের গগনবিদারী আর্তনাদ, হূদয়বিদারক বীভত্স দৃশ্য, রক্ত আর বিকৃত লাশের মতো বিষয়গুলো অনেকটাই স্বাভাবিক মনে হয়েছিল সাধারণ মানুষের কাছে। শুধু ঘরে-বাইরে নয়, ধর্মীয় উপাসনালয়েও মানুষ ভুগেছে নিরাপত্তাহীনতায়। প্রাণঘাতী বুলেটের যন্ত্রণা থেকে বাদ যায়নি মায়ের পেটে থাকা নিষ্পাপ নবজাতকটিও। ক্ষমতাসীন দলের এমপির গুলিতে আহত হয়েছে শিশু। এর বাইরে দেশকে অকার্যকর রাষ্ট্র প্রমাণ করতে টার্গেট করে বিদেশি নাগরিকদের খুন করতে তত্পর ছিল দুর্বৃত্তরা। এ সময়ে দেশ ছিল অস্থির। স্বস্তিতে ছিল না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে ধর্মীয় জঙ্গি দমনের লক্ষ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তত্পরতা নজর কেড়েছে সাধারণ মানুষের। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের দাবি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ছিল যথেষ্ট স্বাভাবিক। কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা দিয়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পরিমাপ করা যাবে না। তবে দেশের ভালো চায় না এমন গ্রুপ সারা বছরই তত্পর ছিল। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা তত্পর থাকায় তারা সফল হতে পারেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, ২০১৫ সালের শেষ দিকে নতুন করে জঙ্গিবাদ উসকে দেওয়ার অপতত্পরতা অব্যাহত ছিল। তবে আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের কারণে তারা সফল হতে পারেনি। দেশের স্বার্থে বিশেষ করে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার স্বার্থে মাঝে মধ্যে এনকাউন্টারেরও প্রয়োজন রয়েছে।

আইন ও সালিস কেন্দ্র (আসক)-এর পরিচালক (তদন্ত) নূর খান লিটন বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বছরের শুরুতে যেমন ছিল ঠিক তেমনই আছে বলে আমার ধারণা। সমাজটা অস্থির হয়ে গেছে। এ সুযোগে বেড়ে গেছে নানারকম অপরাধ। এর বাইরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারা যে অপরাধ সংগঠিত হয় সেটা যে কমেছে এটা বলারও সুযোগ নেই।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছেন অপরাধ করে অপরাধীরা রেহাই পাচ্ছে না। তারা গ্রেফতার হচ্ছে। তিনটি ঘটনা ছাড়া গত বছর সংঘটিত সব চাঞ্চল্যকর অপরাধ উদঘাটন করেছে পুলিশ। ২০১৫ সালে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ শুরু হয় বছরের শুরুতে। সারা দেশে অবরোধের নামে পেট্রলবোমা, যানবাহনে আগুন, মানুষ পোড়ানোর চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় একাধিক রাজনৈতিক দল। ঝরে যায় একজন পুলিশ আর ৮০ জন সাধারণ মানুষের প্রাণ। ৯২ দিনের সেই শ্বাসরুদ্ধ অবস্থা থেকে এদেশের মানুষকে মুক্ত করার প্রত্যয়ে মাঠে থেকেছে পুলিশ। নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষের নিরাপত্তা এবং শান্তি ফিরিয়ে আনে তারা। এর মধ্যে অগ্নিদগ্ধ হয়ে নৃশংসভাবে প্রাণ হারিয়েছেন ৫৮ জন নিরীহ মানুষ। ওই সময় গ্রেফতার করা হয় অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সাত হাজার ৫৯৯ জনকে। কখনো পুলিশের হাতে, কখনো জনগণের হাতে ধরা পড়েছে তারা। বিজ্ঞ আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়ে অপরাধের দায় স্বীকার করেছে এদের কেউ কেউ। চলতি বছরে চাঞ্চল্যকর ৩০টি ঘটনা পর্যালোচনায় দেখা যায়, পুলিশ ২৭টি ঘটনা পুরোপুরি প্রতিরোধ এবং উদঘাটন করেছে। তিনটি ঘটনা নিয়ে তদন্ত চলছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, বছরের শুরুটা হয়েছিল চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা, সংঘর্ষ, গ্রেফতার ও নাশকতার মধ্য দিয়ে। ৫ জানুয়ারি দেশের ৩৬ জেলায় বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় পুলিশ ও সরকারদলীয় নেতা-কর্মীদের। এতে চারজন নিহত হন।

আহত হন শতাধিক ব্যক্তি। রাজনৈতিক এই অনভিপ্রেত পরিবেশে ১৯ জানুয়ারি রাজধানীর মতিঝিলের এজিবি কলোনির কাঁচাবাজারে ডিবির সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন নড়াইল পৌরসভার মেয়র ইমরুল কায়েস। পরের দিন খিলগাঁও জোড়াপুকুর বালুর মাঠে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন ছাত্রদল নেতা নুরুজ্জামান জনি। ১৪ জানুয়ারি বঙ্গবাজারে ককটেল বিস্ফোরণে আহত সরকারি কবি নজরুল কলেজের ছাত্র সানজিদ হোসেন অভি মারা যায় ২১ জানুয়ারি। ২৫ জানুয়ারি রামপুরায় র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন দুই যুবক। এর পরদিন মিরপুর থেকে চারজনের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়। ১ জানুয়ারি থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে বন্দুকযুদ্ধে মারা যায় ১৭ জন। ১ ফেব্রুয়ারি রাতে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে বাসে পেট্রলবোমা ছুড়ে মারে দুর্বৃত্তরা। এতে প্রাণ হারান চারজন। ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে একুশে গ্রন্থমেলা থেকে বের হওয়ার পথে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক লেখক-ব্লগার অভিজিত্ রায় ও তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যার ওপর হামলা চালায় জঙ্গিরা। এতে অভিজিত্ রায় মারা যান। ৩০ মার্চ তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার দক্ষিণ বেগুনবাড়ী এলাকায় কুপিয়ে হত্যা করা আরেক ব্লগার ওয়াসিকুর রহমান বাবুকে। ১০ এপ্রিল মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকরা করা হয়। ১৩ এপ্রিল নিউ ইস্কাটনে যানজটে আটকে পড়ে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করেন মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও এমপি পিনু খানের ছেলে বখতিয়ার আলম রনি। তার গুলিতে একজন রিকশাচালক ও জনকণ্ঠ পত্রিকায় কর্মরত এক অটোরিকশা চালক নিহত হন। ১৪ এপ্রিল বাংলা বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে নারীদের শ্লীলতাহানীর বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় হয় সারা দেশে। ২১ এপ্রিল আশুলিয়ার কাঠগড়াবাজারে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক লুট করার উদ্দেশে হানা দেয় জঙ্গিরা। বিষয়টি তাত্ক্ষণিকভাবে জানাজানি হলে পার্শ্ববর্তী মসজিদের মাইক থেকে ডাকাতির বিষয়টি ঘোষণা করা হয়। এ সময় চারপাশ থেকে লোকজন দুর্বৃত্তদের ঘেরাও করে। গুলি ও ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে দুর্বৃত্তরা। এ সময় দুই দুর্বৃত্তসহ আটজন মারা যায়। ১২ মে সিলেটে ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।

 

৮ জুলাই সিলেটের কুমারগাঁওয়ে চুরির অপবাদে রাজন নামে এক শিশুকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এই ঘটনার ভিডিও চিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপলোড হলে দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ৪ আগস্ট কম্প্রেসার দিয়ে পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে খুলনার টুটপাড়ায় ১২ বছরের শিশু রাকিবকে হত্যা করা হয়। ২৩ জুলাই ঘটে আরও একটি নির্মম ঘটনা। মাগুরার কারিগরপাড়ায় ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ হন বাচ্চু ভূঁইয়ার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী নাজমা বেগম। মায়ের পেটে গুলিবিদ্ধ হয়ে অপরিণত অবস্থায় জন্ম হয় এক কন্যা সন্তানের। ৭ আগস্ট রাজধানীর গোড়ানের ১৬৭ নম্বর বাড়ির পঞ্চম তলার বাসায় ঢুকে কুপিয়ে হত্যা করা হয় ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয়কে।

২৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় গুলশানের কূটনীতিক পাড়ায় দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হন ইতালিয়ান নাগরিক তাভেলা সিজার। বিদেশি নাগরিক হত্যার ঘটনায় অল্প সময়ের মধ্যেই দেশ-বিদেশে তোলপাড় শুরু হয়। আন্তর্জাতিক জঙ্গিসংগঠন আইএস-এর দায় স্বীকার করলেও জঙ্গি সম্পৃক্ততা পায়নি বলে দাবি করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ ঘটনায় গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে আদালতে স্বীকারোক্তি দেন। তবে তাদের স্বজনদের অভিযোগ, স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করা হয়েছে তাদের। তাভেলা সিজার হত্যকাণ্ডের পর ৩ অক্টোবর রংপুরের কাউনিয়ার আলুটারি গ্রামে জাপানি নাগরিক হোশি কোনিওকে একই কায়দায় হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা পান গোয়েন্দারা।

২ অক্টোবর রংপুরের সুন্দরগঞ্জের বামনডাঙ্গা সড়কে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র শাহাদাত হোসেন সৌরভকে নিজ পিস্তল দিয়ে গুলি করেন গাইবান্ধা-১ আসনের এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন। এই ঘটনায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। ৫ অক্টোবর মধ্যবাড্ডার নিজ বাড়িতে গলা কেটে হত্যা করা হয় পিডিবির সাবেক চেয়ারম্যান ও কথিত পীর মুহম্মদ খিজির খানকে। একই দিন ঈশ্বরদীতে লুক সরকার নামে এক যাজককে গলা কেটে হত্যার চেষ্টা করে দুর্বৃত্তরা। ২৩ অক্টোবর ঢাকায় শিয়াদের তাজিয়া মিছিল প্রস্তুতির সময় হোসনি দালানের ইমামবাড়ায় বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। এতে দুজন নিহত হন। বিষয়টি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও খবর হিসেবে উঠে আসে। ২২ অক্টোবর রাজধানীর দারুস সালাম এলাকার চেকপোস্টে দায়িত্ব পালনকালে দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে নিহত হন পুলিশের এএসআই ইব্রাহিম মোল্লা। ৩১ অক্টোবর শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে জাগৃতি প্রকাশনীর কর্ণধার ফয়সাল আরেফিন দীপনকে গলা কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। প্রায় একই সময়ে লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বর প্রকাশনীতে ঢুকেও হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। এতে শুদ্ধস্বরের কর্ণধার আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুল, লেখক রণদীপম বসু ও তারেক রহিম গুরুতর আহত হন। ৪ নভেম্বর আশুলিয়ায় চেকপোস্টে দায়িত্বপালনকালে দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে নিহত হন পুলিশ সদস্য মুকুল হোসেন। ১৮ নভেম্বর দিনাজপুরে ইতালীয় নাগরিক ফাদার পিয়েরো পিচুমের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। ২১ নভেম্বর রাত ১২টার পর যুদ্ধাপরাধের দায়ে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। ২৬ নভেম্বর বগুড়ার শিবগঞ্জে শিয়া মসজিদে মাগরিবের নামাজরতদের ওপর গুলি চালানো হয়। এতে একজন নিহত হন। ১৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশ নৌবাহিনীর চট্টগ্রামের ঈশা খাঁ ঘাঁটির মসজিদে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। এতে নৌবাহিনীর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ছয়জন আহত হন। গত ২৪ ডিসেম্বর রাজধানীর মিরপুরে অভিযান চালিয়ে জঙ্গি আস্তানা থেকে তিনজন জঙ্গিসহ বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক উদ্ধার করে পুলিশ। গত ২৬ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে বড় ধরনের জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পেয়েছে ডিবি পুলিশ। সর্বশেষ গত ২৭ ডিসেম্বর গাজীপুরে একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে অভিযান চালালে র্যাবের সঙ্গে জঙ্গিদের বন্দুক যুদ্ধের ঘটনা ঘটে। পরে সেখান থেকে দুই জেএমবি সদস্যের মৃত দেহ ও বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক উদ্ধার করে র্যাব।

সর্বশেষ খবর