রবিবার, ১০ জানুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

টানাপড়েনে বাংলাদেশ পাকিস্তান সম্পর্ক

চলছে বিকল্প চিন্তা সম্পর্ক ছিন্ন করতে আগ্রহী নয় সরকার

জুলকার নাইন

পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুরোপুরি ছিন্ন করতে আগ্রহী নয় সরকার। আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বিভিন্ন ফোরামের কথা মাথায় রেখে দুই রাষ্ট্রের সম্পর্ক একেবারে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে চায় না পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও। বরং পরিস্থিতি আরও পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে আগ্রহী সরকার। তবে পাকিস্তানের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের প্রেক্ষাপটে আপাতত সম্পর্ক সীমিত করে আনা বা অন্য কোনো বিকল্প পদক্ষেপ নেওয়া যায় কি না তা নিয়েই সরকারের মধ্যে চলছে চিন্তাভাবনা। সাবেক কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরাও সরকারের এ মনোভাবকে এক বাক্যে সমর্থন দিচ্ছেন। তারা বলছেন, সম্পর্কে শীতলতা আসতেই পারে। সে কারণে একেবারে বিচ্ছিন্ন করে দিলে ক্ষমা প্রার্থনাসহ পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের যে দাবিগুলো আছে, তা কখনোই পূরণ হবে না। বরং কার্যকর কূটনীতির মাধ্যমে পাকিস্তানের কাছ থেকে দাবি আদায়ের পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে।

কূটনৈতিক সূত্রের তথ্যানুসারে, পাকিস্তানে বর্তমানে বাংলাদেশের দুটি কূটনৈতিক মিশন রয়েছে। রাজধানী ইসলামাবাদে আছে স্থায়ী  হাইকমিশন ও বাণিজ্যিক শহর করাচিতে আছে ডেপুটি হাইকমিশন। এর মধ্যে ইসলামাবাদের হাইকমিশনে নিয়মিতভাবে এক সিনিয়র রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে আসছেন। করাচিতে ডেপুটি হাইকমিশনে দায়িত্ব পালন করছেন একজন করে মধ্যম সারির কূটনীতিক। শুধু তা-ই নয়, পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য লাহোরে বাংলাদেশের হয়ে একজন অনারারি কনসাল জেনারেল বাণিজ্যিক বিভিন্ন বিষয়ে স্বার্থ রক্ষার কাজ করছেন। অপর রাজ্য পেশোয়ারে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক স্বার্থ দেখার কাজ করছেন একজন অনারারি কনসাল। এর মধ্যে ইসলামাবাদ মিশনে হাইকমিশনার হিসেবে চুক্তিভিত্তিক দায়িত্বে রয়েছেন অবসর নেওয়া কূটনীতিক সোহরাব হোসেন। মুক্তিযোদ্ধা এই কূটনীতিক ২০১০ সাল থেকে ইসলামাবাদে দায়িত্বে রয়েছেন। এর মধ্যে দুই দফায় তার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এপ্রিলে তার মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু সর্বশেষ গত ডিসেম্বরে দুই দেশের উত্তপ্ত পরিস্থিতির সময় ঢাকায় অবস্থান করায় সোহরাব হোসেনকে যে আর পাকিস্তানের দায়িত্বে রাখা হচ্ছে না এটি মোটামুটি নিশ্চিত। হাইকমিশনার সোহরাব হোসেন ঢাকায় থাকায় তখন অনভিজ্ঞ মৌসুমী রহমানকে মুখোমুখি হতে হয়েছিল পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দফতরের রূঢ় আচরণের। সরকারের শীর্ষস্থানীয় সূত্র বলছে, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক সীমিত করার একটি চিন্তাভাবনা ভেবে দেখা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে সোহরাব হোসেনের মেয়াদ শেষে নতুন কাউকে পূর্ণাঙ্গ হাইকমিশনার পদে নিয়োগ না দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়া এমনিতেই ইসলামাবাদে বর্তমানে ডেপুটি হাইকমিশনার পদেও কেউ নেই। ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন পলিটিক্যাল কাউন্সিল ও হেড অব চ্যান্সারি পদে থাকা মৌসুমী রহমান। তিনিও এখন পর্তুগাল চলে গেছেন। এ ছাড়া এই মিশনে আছেন একজন ডিফেন্স অ্যাটাচি ও একজন কাউন্সিলর। নতুন চিন্তায় ইসলামাবাদ মিশন সর্বোচ্চ একজন হেড অব চ্যান্সারি দিয়ে চালানো হতে পারে। অন্যদিকে একজন কাউন্সিলর থাকতে পারেন করাচি মিশনে। তবে এর কিছুই এখনো চূড়ান্ত নয়। এ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে পাকিস্তানের ঢাকা মিশনকেও বিশেষ বিবেচনায় রাখা হচ্ছে। জানা যায়, যুদ্ধাপরাধের বিচারকে কেন্দ্র করে ঢাকা ও ইসলামাবাদের মধ্যে সম্পর্কের টানাপড়েন শুরু হয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বক্তব্য দেওয়ায় পাকিস্তানের হাইকমিশনারকে একাধিকবার তলব করে ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এর মধ্যেই পাকিস্তানের এক কূটনীতিকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে জঙ্গি কানেকশনের তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়। ফারিনা আরশাদ নামের এই নারী কূটনীতিককে মৌখিকভাবে ঢাকা ছাড়তে বলা হয়। ফারিনার আগে মাজহার খান নামের এক দূতাবাস কর্মকর্তাকে জঙ্গি কানেকশনে হাতেনাতে আটকও করেছিল ঢাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পরে তাকেও দেশত্যাগের সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু ফারিনা আরশাদের বিষয়টির অপব্যাখ্যা করে পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে কোনো কারণ ছাড়াই বাংলাদেশের মৌসুমী রহমানকে ইসলামাবাদ ত্যাগের জন্য বলে পাকিস্তান। তাকে ঢাকায় ফিরিয়ে না এনে পর্তুগালে পাঠায় বাংলাদেশ। সর্বশেষ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় ‘সাউথ এশিয়ান কনফারেন্স অন স্যানিটেশন’ শীর্ষক আঞ্চলিক মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে প্রতিনিধি পাঠাচ্ছে না পাকিস্তান। আগামীকাল শুরু হতে যাওয়া এ সম্মেলনে দক্ষিণ এশিয়ার পাকিস্তান ছাড়া অন্য সব দেশ অংশ নিচ্ছে। পাকিস্তানের অভিযোগ, বাংলাদেশের হাইকমিশন ১০ দিন আটকে রেখেও ভিসা দেয়নি পাকিস্তানের ১৩ কর্মকর্তাকে। বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকা থেকে আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণপত্র দেওয়া হলেও বারবার প্রতিনিধি তালিকা পাল্টেছে পাকিস্তান। কাকে কাকে পাঠানো হবে সেটিই চূড়ান্ত করে জানানো হয়নি। অন্যদিকে প্রায় এক বছর আগে পাকিস্তানিদের জন্য অনঅ্যারাইভাল ভিসা বন্ধ করে দেওয়া বাংলাদেশ এ বছর বিশ্ব ইজতেমায় যোগ দিতে আগ্রহী পাকিস্তানিদের অনুকূল গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতেই ভিসা দিচ্ছে। আগেও বিভিন্ন সময় ইজতেমায় যোগ দেওয়া প্রায় ১৫০ জনকে ইতিমধ্যে দেওয়া হয়েছে ভিসা। এদিকে যুদ্ধাপরাধের বিচারের সমালোচনা এবং একাত্তরে গণহত্যার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে পাকিস্তানের দেওয়া বিবৃতির প্রতিবাদে দুই মাস ধরেই বাংলাদেশের বিভিন্ন সংগঠন পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি জানিয়ে বক্তব্য-বিবৃতি দিচ্ছে, বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করছে। সম্পর্ক ছিন্ন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। শুক্রবার ৭২ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছে গণজাগরণ মঞ্চ। এরই মধ্যে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী একাধিকবার বলেছেন, ‘পাকিস্তানের কর্মকাণ্ড সম্পর্কের জন্য সুখকর নয়। আমরা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। সম্পর্ক আগের মতোই থাকবে, তবে জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে কোনো আপস করা হবে না।’ সাবেক কূটনীতিক হুমায়ূন কবির বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছেন, দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা হলো সর্বশেষ পদক্ষেপ। এরপর আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। তাই সম্পর্ক ছিন্ন করার আগে আরও কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ আছে কি না তা ভেবে দেখাই যৌক্তিক। এখানে দ্বিপক্ষীয় বিষয় আছে, আঞ্চলিক সম্পর্কের বিষয়গুলোও আছে। তাই সম্পর্ক ছিন্ন করার আগে অবশ্যই সব বিষয় গভীরভাবে ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে। তিনি বলেন, ‘এখন পাকিস্তান যে ধরনের মনোভাব দেখাচ্ছে, এর বিরুদ্ধে আমরা বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সবল ও সঠিক অবস্থান তুলে ধরতে থাকব। আশা করি, পাকিস্তান হয়তো সত্য ও বাস্তব অবস্থান অনুধাবন করে তাদের দায় স্বীকার করে বাংলাদেশের দাবি ও অন্যান্য ইস্যুর সমাধান করবে।’

সর্বশেষ খবর