পাল্টে যাচ্ছে দেশের টেলিযোগাযোগ খাত। আধুনিক প্রযুক্তি ও নীতিমালার মাধ্যমে এ খাতে নিয়ে আসা হচ্ছে ব্যাপক পরিবর্তন। এরই মধ্যে বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে প্রযুক্তির উন্নয়নে সরকার হাতে নিয়েছে বিভিন্ন পাইলট প্রকল্প। টেলিযোগাযোগ সংক্রান্ত সেবার মান বাড়াতে সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারি কোম্পানিগুলোর ওপরও বাড়ানো হয়েছে নজরদারি। টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো বলছে, চলতি বছরে সম্ভাবনাময় এ খাতে রাজস্ব ও সেবার মান বৃদ্ধি— দুটোই চলবে সমান্তরাল গতিতে।
এ প্রসঙ্গে ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম বলেন, চার মাসে টেলিযোগাযোগ খাতের প্রতিটি শাখায় হাত দিয়েছি। যেসব অনিয়ম-অভিযোগ চলে আসছে সেগুলো নিয়ে কাজ করছি। টেলিটকসহ প্রতিটি সেবা কার্যক্রম ঢেলে সাজানো হচ্ছে। প্রযুক্তি ও উন্নয়নের মাধ্যমে এ সেক্টরে একটি বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসার চেষ্টা করা হচ্ছে। জানা গেছে, নতুন বছরে টেলিযোগাযোগ খাতের উন্নয়নে মূলত চারটি মৌলিক নীতিতে এগোচ্ছে সরকার। এর মধ্যে রয়েছে— সেবার মান উন্নয়ন, সেবাকে সহজলভ্য করা, সাইবার নিরাপত্তা প্রদান ও টেলিযোগাযোগ খাতের সম্প্রসারণ। এ ছাড়া টেলিযোগাযোগ খাতের সার্বিক উন্নয়নে বিটিআরসির সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিলে (এসওএফ) পড়ে থাকা প্রায় ৮০০ কোটি টাকা কাজে লাগানো হবে। বিশেষ করে দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় ওয়্যারলেস কানেক্টিভিটি, দুর্যোগের পূর্বাভাস দেওয়া, সাইবার সিকিউরিটি এবং থ্রিজি সম্প্রসারণের কাজে এ টাকা ব্যয় হবে। বিটিআরসি সূত্র জানায়, ২০১১ সালে গঠিত তহবিলে মোবাইল কোম্পানিগুলোর বার্ষিক আয়ের ১ শতাংশ জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা জারি করা হয়। ওই বছরই জমা পড়ে ২২ কোটি ৩০ লাখ টাকা। পরের বছরে ১৭৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এভাবে অপারেটরদের আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তহবিলে টাকার পরিমাণও বাড়ছে। টেলিযোগাযোগ সূত্রে জানা গেছে, শিগগিরই প্রত্যন্ত অঞ্চলে থ্রি-জি নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ করছে টেলিযোগাযোগ বিভাগ। এ ছাড়া চলতি বছরে দেশে ফোর-জি তরঙ্গ নিলামের কথা রয়েছে। ইতিমধ্যে নিলামের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। সব অপারেটরের জন্যই এ নিলামের আয়োজন করা হবে। তবে টেলিটক যেমন নিলামের আগেই থ্রি-জি সেবা শুরু করতে পেরেছিল এবার তেমনটি হচ্ছে না। এদিকে, বেসরকারি মোবাইল কোম্পানিগুলোর সেবার মান বৃদ্ধিতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কোম্পানিগুলোকে বিটিআরসির নির্দেশনা মেনে চলার জন্য তাগিদ দেওয়া হয়েছে। নির্দেশনা মানছে কিনা সে ব্যাপারে তাদের রাখা হয়েছে বিশেষ নজরদারিতে। মূলত কলড্রপ রোধ, নেটওয়াকের্র মান বৃদ্ধি, অবাঞ্ছিত প্যাকেজ বন্ধ করা, কপিরাইট লঙ্ঘন রোধসহ কয়েকটি বিষয়ে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। গ্রাহকরা এ ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হলে যেন ক্ষতিপূরণ পেতে পারে তারও ব্যবস্থা করছে বিটিআরসি। এ ছাড়া ঢেলে সাজানো হচ্ছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন একমাত্র মুঠোফোন কোম্পানি টেলিটককে। নতুন করে ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য আগামী মাসে এর লোগোতে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানের নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তিও দেওয়া হয়েছে। আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি চালু হতে যাচ্ছে ডটবাংলা ডোমেইন। ডটবাংলা নিবন্ধন পেলেও কার্যকর করতে দেরি হওয়ায় এর অধিকার হারাতে বসেছিল বাংলাদেশ। ডোমেইনটি বিটিসিএল নাকি বিটিআরসি নিয়ন্ত্রণ করবে— এটি ঠিক করতেই কেটে যায় অনেক দিন। গত জুনে এর অধিকার বহাল রাখতে তত্পর হয় ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ। ডোমেইনটি ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে চালুর প্রস্তুতি থাকলেও ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে এর যাত্রা শুরুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে টেলিযোগাযোগ বিভাগ। মোবাইল টাওয়ারের সেবা সারা দেশে পৌঁছে দিতে চলতি বছরেই তৃতীয় পক্ষের কাছে এর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে। এতদিন বিটিআরসির গাইডলাইনে অবকাঠামো বা টাওয়ার ভাগাভাগি করে ব্যবহারের সুযোগ ছিল। ফলে অপারেটররা একই টাওয়ার ব্যবহার করলে এত টাওয়ারের প্রয়োজন হতো না। গত এপ্রিলে বিটিআরসির সভায় গাইডলাইন সংশোধন করে দুটি প্রতিষ্ঠানকে এসব টাওয়ার পরিচালনা এবং সব অপারেটরের জন্য বাধ্যতামূলকভাবে এ অবকাঠামো ভাগাভাগি করে ব্যবহারের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। নিরাপত্তার স্বার্থে নজরদারিতে আনা হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। কাল ১২ জানুয়ারি সিঙ্গাপুরে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করবেন প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম। ফেসবুক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নারীর প্রতি অবমাননাসহ সাইবার নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে। এরই মধ্যে অভিযোগ জানানোর জন্য বিটিআরসি থেকে ফোকাল পয়েন্ট নির্ধারণ করে পাঠানো হয়েছে। নিরাপত্তার স্বার্থে আগামী ২৬ এপ্রিলের মধ্যে হাতের আঙ্গুলের ছাপ ব্যবহার করে এবং এনআইডি বা জাতীয় পরিচয়পত্র সরবরাহের মাধ্যমে সারা দেশের ১৩ কোটি গ্রাহকের সিম নিবন্ধন প্রক্রিয়া চলছে। পাঁচটি মৌলিক বিষয় আমলে নিয়ে চূড়ান্ত করা হয়েছে জাতীয় টেলিযোগাযোগ নীতিমালা-২০১৫। শিগগিরই এটি মন্ত্রিসভায় পাস হবে। আর এরই মধ্য দিয়ে ১৭ বছর পর নতুন নীতিমালা পাবে সংশ্লিষ্টরা। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, নতুন নীতিমালায় পাঁচটি বিষয় সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এগুলো হলো উন্মুক্ত ও প্রতিযোগিতামূলক বাজার, বৈশ্বিক বাজারে প্রবেশাধিকার, কার্যকর সুশাসন, যথাযথ নিয়ন্ত্রণ এবং প্রযুক্তির সর্বাধুনিক ব্যবহার ও একত্রীকরণ। নীতিমালায় স্থানীয়ভাবে টেলিযোগাযোগ পণ্য উত্পাদনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি, গ্রাহক অধিকার সুরক্ষা, সাইবার স্পেস ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং ২০২১ সালের মধ্যে সব ইউনিয়নে উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ পৌঁছানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এদিকে ৯ সেপ্টেম্বর বেসরকারি মোবাইল কোম্পানি রবি ও এয়ারটেল একীভূত হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এক হওয়ার পর প্রায় চার কোটি গ্রাহক নিয়ে এটি হবে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মোবাইল অপারেটর। আগামী মার্চ-এপ্রিলেই এমএনপি (মোবাইল নম্বর পোর্টেবিলিটি) চালু করা যাবে। বর্তমানে এ সেবার লাইসেন্স নিলাম প্রক্রিয়া চলছে।