বৃহস্পতিবার, ১৪ জানুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

অনড় ট্যানারি ব্যবসায়ীরা

চাইলেন আরও সময়, প্লট বাতিল হলেও কিছু করার নেই

রুহুল আমিন রাসেল

অনড় ট্যানারি ব্যবসায়ীরা

সাভারে ঢিমেতালে চলছে ট্যানারিশিল্প নগরীর কাজ। ডানে আলটিমেটামের পরও হাজারীবাগে পুরোদমে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন ট্যানারি ব্যবসায়ীরা —বাংলাদেশ প্রতিদিন

সরকারের ৭২ ঘণ্টার আলটিমেটামে হাজারীবাগের একটি ট্যানারি কারখানাও সরাননি মালিকরা। প্রতিদিনের মতো এখানে গতকালও ছিল ব্যাপক কর্মচাঞ্চল্য। ট্যানারি মালিকরা বলছেন, স্থানান্তরে আরও পাঁচ-ছয় মাস সময় লাগবে। তবে এই মৃত্যুপুরি থেকে বাঁচতে চায় এখানকার মানুষ। চামড়া বা ট্যানারিশিল্পের অভিশাপের পচা-গলা বর্জ্য আর দুর্গন্ধে এখানকার মানুষ প্রতিনিয়ত স্বাস্থ্যহানির শিকার। দীর্ঘ ৬৫ বছরের অভিঘাত ট্যানারি সরাতে আদালত নির্দেশ দেওয়ার পর চলে গেছে ২১ বছর। হাজারীবাগের ছোট-বড় ২০০ ট্যানারি কারখানা সরিয়ে সাভারের চামড়াশিল্প পল্লীতে নিতে সরকার বারবার আলটিমেটাম দিলেও নির্বিকার ব্যবসায়ীরা। এবারও সরকারের ৭২ ঘণ্টার আলটিমেটাম শেষ হলেও নিজেদের সিদ্ধান্তে অনড় ট্যানারি মালিকরা। তারা বলছেন, কোনোভাবেই এ মুহূর্তে ট্যানারি স্থানান্তর সম্ভব নয়। অর্থবিত্তে প্রভাবশালী এই ট্যানারি মালিকদের ভয়ে এত দিন মুখ খোলেননি স্থানীয় বাসিন্দারা। তবে তারা এখন ফুঁসেউঠছেন। গতকাল রাজধানীর হাজারীবাগের ট্যানারি কারখানা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, মুখ চেপে হাঁটছে আর একটু পর পর থুথু ফেলছে জিগাতলা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী ইজমাতিয়াজ ইভা। তার অভিযোগ, ট্যানারির পচা গন্ধ সহ্য করে প্রতিদিন চলাফেরা করতে হয়। ট্যানারি এলাকায় বসবাস হওয়ায় ইভার বন্ধুরা তার বাসায় খুব একটা আসে না। তবে শুধু ইভা নয়, হাজারীবাগ এলাকায় যে-ই যাবেন তাকেই একটু পর পর থুথু ফেলে চলতে হবে। নাক চাপতে হবে হাতে। হাজারীবাগে জন্ম ৫১ বছর বয়সী ব্যবসায়ী এ টি এম শামসুজ্জামান আলাপকালে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘শরীরের নাম মহাশয়, যাহা সহায় তাহাই সয়’। এরপর একটু হেসে বললেন, ‘আমাদের আর মুক্ত বাতাস ভালো লাগে না।’ তার কথা শেষ না হতেই আরেক ক্ষুব্ধ প্রবীণ বললেন, ‘এই দুর্গন্ধময় মৃত্যুপুরিতে বসবাসই যেন আমাদের অধিকার। এ এলাকার মানুষের ভালোভাবে বাঁচার অধিকার নেই।’ জানা গেছে, হাজারীবাগ ট্যানারি এলাকার মাটি-পানি দূষিত। এমনকি এখানকার উদ্ভিদেও ঢুকে পড়েছে বিষাক্ত ধাতব পদার্থ, যা খাদ্যচক্রের মাধ্যমে মানুষ ও পশুর দেহে ঢুকলে ক্যান্সারসহ জটিল রোগ হতে পারে। চামড়া কারখানায় কাজ করা শ্রমিকরা নানা রাসায়নিকের কারণে জটিল ও প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত। নানা অসুখে এখানকার শ্রমিকরা দীর্ঘদিন ধরে ভুগছেন বলে জানিয়েছেন কয়েকজন শ্রমিক। মো. রফিকুল নামের একজন শ্রমিক গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমার শরীর খুব চুলকায়। মাঝেমধ্যে হাত-পায়ের চামড়া উঠে যায়।’ জানা গেছে, ১৯৪০ সালে নারায়ণগঞ্জে প্রথম ট্যানারিশিল্প স্থাপন করেন আর পি সাহা। সেখানে গড়ে ওঠা ট্যানারিশিল্প থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চামড়া রপ্তানি করা হতো। এই ট্যানারি পরবর্তী সময়ে হাজারীবাগে স্থানান্তর করা হয় ১৯৫০ সালে। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে পুরনো এ প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিতভাবেই। এখানে নেই বর্জ্য ও রাসায়নিক মিশ্রিত পানি শোধনাগার (ইটিপি)। ট্যানারির বিষাক্ত পানি সরাসরি গিয়ে পড়ছে আশপাশের নদীতে। দুই শতাধিক ট্যানারি কারখানার বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, বালু ও বুড়িগঙ্গা নদীর ১১০ কিলোমিটার এলাকা। সরকারি এক সমীক্ষার তথ্যমতে, সারা দেশে প্রতিদিন তরল বর্জ্য নির্গত হয় সাড়ে আট মিলিয়ন লিটারের কিছু বেশি। এর মধ্যে পৌনে আট মিলিয়ন লিটার উত্পন্ন হয় হাজারীবাগ ট্যানারিতে। কিন্তু এই বিপুল বর্জ্য সরাসরি যাচ্ছে বুড়িগঙ্গা নদীতে। রাসায়নিক বর্জ্যের কারণে গোটা নদীর পানিই হয়ে পড়েছে পুতিগন্ধময়। জানা গেছে, পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ব্যাপক ক্ষতিকর হওয়ায় হাজারীবাগের ট্যানারি ঢাকা শহরের বাইরে সরিয়ে নেওয়ার জন্য ১৯৯৪ সালে দেওয়া আদালতের নির্দেশের পর কেটে গেছে ২১ বছর। ২০০৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এ ট্যানারি পল্লী তৈরি হবে এমন কথা থাকলেও দফায় দফায় সরকার সময়সীমায় পরিবর্তন আনে। সরকারকে দেওয়া উচ্চ আদালতের সর্বশেষ সময়সীমা শেষ হয়েছে ২০১৫ সালের জুনে। এরপর চলে গেছে আরও ছয় মাস। আজও সেই ট্যানারি স্থানান্তর প্রক্রিয়া শেষ হয়নি। এ ক্ষেত্রে ট্যানারি মালিকদের অগ্রগতি খুবই কম। এমন প্রেক্ষাপটে রবিবার ব্যবসায়ীদের ৭২ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়ে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেন, হাজারীবাগের ট্যানারি সাভারে স্থানান্তর না করলে সেখানকার কারখানাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হবে। এমনকি সরকারের এই নির্দেশনা বাস্তবায়নে বিসিককে ট্যানারি মালিক বরাবর উকিল নোটিস পাঠানোর নির্দেশও দেন মন্ত্রী। এরপর মালিকরা বলেন, ৭২ ঘণ্টার আলটিমেটাম নয়, ট্যানারি সরাতে সময় লাগবে আরও ছয় মাস। তবে সরকারের সিদ্ধান্তে অটল শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানিয়েছেন, সাভারের চামড়াশিল্প নগরীতে ট্যানারি স্থানান্তরে যারা এখনো সেখানে কাজ শুরু করেনি, তাদের নামে বরাদ্দ করা প্লট সরকার বাতিল করবে। এ জন্য প্লট বরাদ্দপ্রাপ্ত ব্যবসায়ীদের নামে উকিল নোটিস পাঠানো হচ্ছে। এদিকে শিল্পমন্ত্রীর দেওয়া ৭২ ঘণ্টার আলটিমেটাম গতকাল শেষ হয়েছে। তবে অনড় ট্যানারি মালিকরা। সরকারের আলটিমেটাম প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ট্যানারি অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) মহাসচিব শওকত উল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘২৮টি ট্যানারি প্রতিষ্ঠান সাভারে স্থানান্তরের কাজে গতি নেই। সরকার তাদের বরাদ্দ দেওয়া প্লট বাতিল করলে আমাদের কিছু করার নেই। এর আগে সংগঠন থেকে তাদের কয়েক দফা চিঠি দিয়ে তাগিদ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারা সাড়া দেয়নি। তবে আলটিমেটাম দিয়ে ট্যানারি সরানো যাবে না। আরও পাঁচ থেকে ছয় মাস সময় লাগবে। আমরা ইতিমধ্যে মেশিনারিজ আমদানি শুরু করেছি। সরকার সিইটিপি বা কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধানাগার স্থাপনের কাজ শেষ করলেই ট্যানারি স্থানান্তরের কাজ শুরু হবে।’ বেসরকারি সংস্থা পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) তথ্যমতে, হাজারীবাগের ট্যানারিশিল্পে এযাবৎকাল পরিবেশগত ক্ষতি হয়েছে ২ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা। এখানকার ট্যানারি দৈনিক ২২ হাজার ঘনমিটার অপরিশোধিত বর্জ্য নদীতে ফেলছে, যা স্থানীয় বাসিন্দাদের স্বাস্থ্যগত বিপদ ডেকে আনছে। এ ছাড়া প্রতিদিন আনুমানিক ১০০ টন কঠিন বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। সর্বোচ্চ উৎপাদনকালে এর পরিমাণ প্রায় ২০০ টন। এসব বর্জ্যে রয়েছে ক্রোমিয়াম, লেড, সালফিউরিক এসিড, হাইড্রোজেন সালফাইড, ফরমিক এসিড, ব্লিচ, ডাই, তেল, চামড়া প্রক্রিয়াকরণে ব্যবহৃত ভারী ধাতু, চুন, পশুর মাংস, দ্রবীভূত চুল, চর্বি ইত্যাদি। এসব বিষাক্ত ও বিপজ্জনক রাসায়নিক দ্রব্যাদি পানি, বায়ু, মাটিদূষণসহ জনস্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি সাধন করছে। পবা বলেছে, পরিবেশ অধিদফতরের প্রতিবেশ ব্যবস্থার ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ অনুযায়ী প্রতি ঘনমিটার তরল বর্জ্যের পরিশোধন ব্যয় ৫০ টাকা হিসেবে ১৯৫০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ বাবদ ট্যানারি মালিকদের কাছ থেকে ২ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা আদায়যোগ্য। ট্যানারি মালিকরা তাদের কারখানায় অপরিশোধিত তরল বর্জ্য নিক্ষেপের মাধ্যমে প্রতিবছর ৪০ কোটি ১৫ লাখ টাকার সমপরিমাণ পরিবেশগত ক্ষতি করছেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর