শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ১৪ জানুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

কসাই ডেকে দেওয়া হলো দুই লাশ

মির্জা মেহেদী তমাল

কসাই ডেকে দেওয়া হলো দুই লাশ

ঘরের মেঝের ওপর পড়ে আছে দুটি রক্তাক্ত লাশ। ঘিরে আছে ৭-৮ ব্যক্তি। শলাপরামর্শ করছেন। যে করেই হোক—রাতের

আঁধার কেটে যাওয়ার আগেই লাশ দুটি সরিয়ে ফেলতে হবে। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে লাশ দুটি একটি বস্তায় ভরল। বস্তার মুখ বেঁধে ধরাধরি করে নিয়ে যাওয়া হলো একটি ম্যানহোলের কাছে। ঢাকনা খুলেই ভিতরে ফেলার চেষ্টা। কিন্তু ছোট ম্যানহোল। ঢুকল না বস্তাটি। তারা বস্তাটি ফিরিয়ে নিয়ে গেল নিজেদের আস্তানায়। আস্তানা থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন দুজন। কিছু সময় পর তারা ফিরে এলেন। সঙ্গে আরও এক ব্যক্তি। হাতে তার মাংস কোপানোর চাপাতি। পেশায় কসাই। মাংস কোপানোর কথা বলে ডেকে নিয়ে এসে তার সামনে দেওয়া হলো আস্ত দুই যুবকের লাশ। এরপর কাঠের গুঁড়ির ওপর লাশ দুটি রেখে কুপিয়ে ১২ টুকরা করা হলো। লাশের বারো খণ্ড আবারও বস্তায় ভরে সোজা ম্যানহোলে।

এটি হরর মুভির কোনো গল্প নয়। একদম সত্যি ঘটনা। রাজধানীর পুরান ঢাকা গেণ্ডারিয়ায় এই রোমহর্ষক ঘটনাটি ঘটেছিল ২০০০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর। তৎকালীন সরকারি দল আওয়ামী লীগের এক নেত্রীর দুই ছেলে রাহিদ হাসান সুমন ও সাজিদ হাসান সুজনের বিরুদ্ধে এই জোড়া খুনের অভিযোগ ওঠে। তদন্ত সংস্থার তৎকালীন কর্মকর্তা ও অন্যান্য সূত্রে জানা গেছে, সায়েম ও মহসীন নামের দুই যুবককে নির্দয়ভাবে পিটিয়ে হত্যার পর লাশ টুকরা করে ম্যানহোলে ফেলে রাখে খুনির দল। মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী নসিবুন্নেসা ও তার দুই পুত্রের দাপটের কাছে তখন পুলিশ প্রশাসনও ছিল অসহায়। কিন্তু সারা দেশে তোলপাড় করা এই ঘটনায় সরকারও বেশ বেকায়দায় পড়ে। পুলিশও বাধ্য হয় দুই পুত্রসহ তাদের সহযোগীদের গ্রেফতার করতে। এমনকি গ্রেফতার হন সুমন-সুজনের বাবাও। চাঞ্চল্যকর এই মামলাটি গেণ্ডারিয়ার বারো টুকরা মামলা নামে পরিচিতি লাভ করে। বলা হয়ে থাকে, পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবির পেছনে এই জোড়া খুনও অন্যতম কারণ ছিল। গেণ্ডারিয়ায় সায়েম ও মহসীন হত্যা মামলায় দুই সহোদর সুমন-সুজনসহ ১৬ জনকে ফাঁসির আদেশ দেন ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু পরবর্তীতে ১৬ জনের মধ্যে ১৫ জনই খালাস পান হাইকোর্টে আপিল করে। সুমনের ফাঁসির দণ্ড কমিয়ে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন দণ্ড। পুলিশি তদন্তের বিভিন্ন পর্যায়ে অনুসন্ধান ও তদন্ত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হত্যাকাণ্ডের নানা কাহিনী। সূত্র জানায়, গেণ্ডারিয়ার রাইফেলস ক্লাবের সভাপতি ছিলেন আওয়ামী লীগ নেত্রী নসিবুন্নেসার পুত্র রাহিদ হাসান সুমন। ওই ক্লাবটি তখন টর্চার সেল হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ১৫ সেপ্টম্বর সুমনের দলবল অপহরণ করে নিয়ে আসে সায়েম ও মহসীনকে। বেলা ১১টা থেকে তাদের দুজনকে ক্লাবের ভিতর নির্যাতন করা হয়। সুমনের নির্দেশে এই নির্যাতন চলে বলে পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে। নির্যাতনের একপর্যায়ে মহসীন জ্ঞান হারায়। অন্যদিকে সায়েম ও মহসীনের পরিবারের সদস্যরা সংবাদ পেয়ে ছুটে যান নসিবুন্নেসার কাছে। মাফ চান, পায়ে ধরেন। কিন্তু কোনো অনুনয় বিনয় কাজে আসেনি। বাধ্য হয়ে তারা পুলিশকে জানান। পুলিশের একজন অফিসার রাইফেলস ক্লাবে যান। কিন্তু সেখানে গিয়ে আটক দুজনকে উদ্ধার করে আনতে পারেননি। নির্যাতনের একপর্যায়ে জ্ঞান হারান মহসীন। ওই অবস্থায় সুমনের বন্ধু শরীফ লোহার রড দিয়ে মাথায় সজোরে আঘাত করেন। এতে ঘটনাস্থলেই মহসীনের মৃত্যু ঘটে। এরপরই ঘাবড়ে যায় সুমন ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা। তারা এবার প্রত্যক্ষদর্শী সায়েমকে হত্যার পরিকল্পনা আঁটে। পরিকল্পনা অনুযায়ী সায়েমকে অমানবিকভাবে নির্যাতন করা হয়। একপর্যায়ে সায়েমও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। লাশ দুটি গুম করতে তারা নানা পরিকল্পনা আঁটে। কিন্তু বস্তায় ভরে ম্যানহোলে ঢোকানো যাচ্ছিল না। ডেকে নিয়ে আসা হয় কসাই মুন্নাকে। মুন্না প্রথমে লাশ কোপাতে অস্বীকার করেন। কিন্তু তারা মুন্নার মাথায় পিস্তল ধরে ভয় দেখায়। এরপরই মুন্নার হাত সচল হয়ে ওঠে। কোপাতে থাকে সায়েম ও মহসীনের লাশ। শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে হাত ও পা। এরপর বস্তায় ভরে তারা লাশ দুটি ফেলে দিয়ে আসে ম্যানহোলে। পরদিন ম্যানহোল থেকে পুলিশ ওই লাশ দুটি উদ্ধার করে। এ ঘটনাটি সারা দেশে ব্যাপক আলোচিত হয়েছিল।  গেণ্ডারিয়ায় সায়েম ও মহসীন হত্যা মামলায় দুই সহোদর সুমন-সুজনসহ ১৬ জনকে ফাঁসির আদেশ দেন ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল। একজন মহিলা প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে সুমন ও সুজনকে মূল হত্যাকারী এবং হত্যার নির্দেশদাতা হিসেবে চিহ্নিত করে সাজা দেওয়া হয়। হাইকোর্টে আসামিদের আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানিকালে দেখা যায়, প্রত্যক্ষদর্শী মহিলা বেশ কয়েক বছর আগেই গেণ্ডারিয়া এলাকা ছেড়ে চলে যান। তিনি সন্তানসহ যাত্রাবাড়ী এলাকায় বসবাস করছেন। ঘটনার দিন হঠাৎ করে তিনি গেণ্ডারিয়া রাইফেলস ক্লাবের কাছে উপস্থিত হয়ে হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেন এবং লাশ গুম করার পরিকল্পনার কথা শোনেন। কিন্তু মামলার বিচার চলাকালে আসামি পক্ষের জেরার জবাবে ঘটনাস্থলে উপস্থিতির ক্ষেত্রে কোনো সুনির্দিষ্ট উত্তর দিতে পারেননি এই সাক্ষী। হাইকোর্টে বিচার চলাকালে এই সাক্ষীর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন আসামির আইনজীবীরা। এ ছাড়া ঘটনাস্থলের মানচিত্র আঁকেননি তদন্ত কর্মকর্তা। হাইকোর্টে এ প্রসঙ্গটিও তোলেন আসামি পক্ষের আইনজীবীরা। এ দুটি ত্রুটির কারণেই উচ্চ আদালত থেকে খালাস পেয়েছেন ১৫ আসামি। একমাত্র সুমনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বাতিল করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

সর্বশেষ খবর