শনিবার, ১৬ জানুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

বেসরকারি এয়ারলাইন্সে বিপর্যয়ের যত কারণ

লাকমিনা জেসমিন সোমা

বেসরকারি এয়ারলাইন্সে বিপর্যয়ের যত কারণ

আলাদা নীতিমালা না থাকায় বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না দেশীয় মালিকানার বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলো। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী ‘বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স’ কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারলেও বিপর্যয়কর অবস্থায় বেসরকারিগুলো। দেশের বিমানবন্দর ব্যবহারে বড় আন্তর্জাতিক এয়ালাইন্সগুলোর মতোই একই হারে চার্জ পরিশোধ করতে হয়। ফলে লাভের বদলে উল্টো সিভিল এভিয়েশন অথরিটি বা বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) কাছে কোটি কোটি টাকা দেনা হচ্ছে কোম্পানিগুলো। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একের পর এক এয়ারলাইন্স। ১৯৯৫ সালে দেশে প্রাইভেট এয়ারলাইন্স যাত্রা শুরু করে। এরপর গত ২০ বছরে মোট ১০টি কোম্পানির মধ্যে ছয়টিই বন্ধ হয়ে গেছে। ঝুঁকিতে রয়েছে আরও দুটি। ব্যবসায়ী ও এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেবিচক চার্জ পরিশোধে আলাদা নীতিমালা না করলে বেসরকারি কোম্পানিগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। এই নীতিমালা করা হলে একদিকে যেমন এসব প্রতিষ্ঠান মুনাফার মাধ্যমে অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারবে, তেমনি বিদেশি কোম্পানিগুলোও দেশ থেকে কোটি কোটি টাকা মুনাফা নিয়ে যেতে পারবে না। বেসরকারি এয়ারলাইন্সের দৈন্যদশার পেছনে পরিকল্পনার অভাব, বেবিচকের অসহযোগিতা এবং লোকবলের জন্য বিদেশিদের ওপর নির্ভরতাকেও দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বেবিচক সূত্র জানায়, বাংলাদেশে প্রথম ১৯৯৫ সালে বেসরকারি এয়ারলাইন্স অ্যারো বেঙ্গলকে অনুমতি দেওয়া হয়। কোম্পানিটি ১৯৯৭ সালে যাত্রী পরিবহন শুরু করলেও ১৯৯৮ সালেই কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। এরপর একে একে চালু হয় এয়ার পারাবত, এয়ার বাংলাদেশ, জিএমজি এয়ারলাইন্স, রয়েল বেঙ্গল ও বেস্ট এয়ার— যেগুলোর কোনোটিই এখন আর কার্যক্রমে নেই। মূলত অর্থ সংকটের কারণে এই ছয় এয়ারলাইন্স বন্ধ হয়। বর্তমানে অভ্যন্তরীণ রুটে চলছে রিজেন্ট এয়ার, ইউএস বাংলা, নভোএয়ার ও ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেবিচকের সাবেক এক কর্মকর্তা বলেন, ‘সরকারের উচিত, বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলোর পার্কিং চার্জ, অ্যারোনটিক্যাল ও নন অ্যারোনটিক্যাল চার্জসহ বিমানবন্দর ব্যবহারের অন্যান্য ফি কমিয়ে আনা। কেননা যখনই কোনো এয়ারলাইন্স খরচ বহন করতে পারে না, তখনই বন্ধ হয়ে যায়।’ পাশাপাশি তিনি উদ্যোক্তাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও প্রয়োজনীয় মানবসম্পদের উন্নয়নে জোর দেওয়ার পরামর্শ দেন। যদিও সম্প্রতি বেবিচকের অর্থ বিভাগের সদস্য মিজানুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে আলাপকালে উল্টো বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলোকেই ‘ছোট বিমান নিয়ে আন্তর্জাতিক রুটে চলাচল করে এত টাকা চার্জ দেওয়ার বিষয়টি ভেবে দেখার’ পরামর্শ দেন। সেই সঙ্গে তিনি কোম্পানিগুলোর মধ্যে ইতিবাচক ব্যবসায়িক মনোভাব তৈরির প্রতি তাগিদ দেন। বেবিচকের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। ২০০৭ সালে যাত্রা শুরু করা ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের কর্মকর্তারা জানান, ‘সি চেকের’ নামে তাদের কোম্পানির ১১টি উড়োজাহাজের মধ্যে ৯টিই গ্রাউন্ডেড (ব্যবহার অনুপযোগী) করে রাখা হয়েছে। নির্দিষ্ট সময় অন্তর উড়োজাহাজের ইঞ্জিন ও ল্যান্ডিং গিয়ারসহ গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ পরীক্ষা ও রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন পড়ে। ১৫ মাস পরপর এটি করা বাধ্যতামূলক। আর এ কাজটিই হলো ‘সি চেক’। ইউনাইটেডের পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) এম শাহাবুদ্দিন আহমেদ সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী বেবিচকের দুজন কর্মকর্তাকে নিয়ে বিদেশে সি চেক করতে যাওয়ার জন্য যাবতীয় অর্থসহ বারবার তাগাদা দিলেও সাড়া দিচ্ছে না সংস্থাটি। তাদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিদেশ ভ্রমণে সরকারি অনুমোদন (জিও) না পাওয়ায় তারা যেতে পারছেন না। ফলে সি চেকের অভাবে আমাদের উড়োজাহাজগুলো কাজে লাগানো যাচ্ছে না।’ সবমিলিয়ে ২০১৩ সাল থেকে বেবিচকের সঙ্গে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ ও দ্বন্দ্বের জের ধরে প্রায় অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে এই কোম্পানিটির। রিজেন্টের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও নীতি-নির্ধারকরাও একই ধরনের অভিযোগ করেছেন। বেবিচক সূত্রে জানা যায়, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ দেশের বিমানবন্দরগুলোতে বর্তমানে দেশি-বিদেশি মোট ৩৪টি প্রতিষ্ঠানের উড়োজাহাজ ওঠানামা করছে। এর মধ্যে ২২টি বিদেশি ও পাঁচটি দেশি এয়ারলাইন্স যাত্রী বহন করে। এ ছাড়া সাতটি কার্গোবাহী এয়ারলাইন্সও ব্যবসা করছে। এসব বিমানের ওঠানামা, পার্কিং, বোর্ডিং, নিরাপত্তা, আকাশপথ ব্যবহারসহ বিভিন্ন সার্ভিস বাবদ চার্জ আদায় করে বেবিচক। দেশি-বিদেশি কিংবা অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটের এয়ারলাইন্স— সব ক্ষেত্রেই একইরকম চার্জ আদায় করা হয়। বেবিচক বলছে, বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো টাকা পরিশোধ করলেও বেসরকারি কয়েকটি কোম্পানি নিয়মিত চার্জ দেয় না। সূত্র জানায়, ইউনাইটেডের কাছে অন্তত ১২৫ কোটি টাকা এবং রিজেন্টের ৩০ কোটি টাকা বকেয়া। কোম্পানি দুটির বিরুদ্ধে শিগগিরই বড় ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে বেবিচক। এর আগে ২০১৪ সালে ইউনাইটেডকে সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। কর্মকর্তারা বলছেন, নির্ধারিত সময়ে চার্জ পরিশোধ না করায় নিয়ম অনুযায়ী ছয় শতাংশ হারে সারচার্জ আরোপে এই এয়ারলাইন্স দুটির বকেয়া বিশাল আকার ধারণ করেছে। আর এভাবেই সর্বশেষ প্রায় ১৫০ কোটি টাকা দেনা নিয়ে বন্ধ হয়ে গেছে জিএমজি এয়ারলাইন্স।

সর্বশেষ খবর