শনিবার, ২৩ জানুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

দূতাবাসে টাকা নয়ছয়

জুলকার নাইন

দূতাবাসে টাকা নয়ছয়

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষার কাজের জন্য বিদেশে মিশনগুলোতে কর্মরত বেশ কিছু কূটনীতিক ও কর্মকর্তার আর্থিক অনিয়ম অডিটে ধরা পড়েছে। মাত্র ১০টি দূতাবাসের দুই বছরের আর্থিক হিসাবের ওপর করা অডিটেই সাড়ে ৭ কোটি টাকা নয়ছয়ের তথ্য জানিয়েছে মহা হিসাবনিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়। সুনির্দিষ্টভাবে কয়েকজন রাষ্ট্রদূত, কূটনীতিক ও অন্য বিভিন্ন পদে কাজ করা কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। তারা অগ্রিম হিসেবে নেওয়া টাকা নিয়মের বাইরে গিয়ে ব্যয় করেছেন। অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি অর্থ তুলে নিয়েছেন। কেউ কেউ অযাচিত ব্যয় দেখিয়েছেন। আবার কেউ কেউ কোনো হিসাবই দেননি। বৈদেশিক, আপ্যায়ন ও শিক্ষাভাতার ক্ষেত্রে করেছেন নয়ছয়। বাড়িভাড়ার ক্ষেত্রেও করা হয়েছে অনিয়ম। অনিয়মের অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ফেরত দিতে বলা হয়েছে সরকারের এসব কর্তাকে। মহা হিসাবনিরীক্ষকের কার্যালয়ের অডিট প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। অবশ্য কূটনীতিকরা বলছেন, বিদেশের পরিস্থিতি অনুধাবন না করেই দেওয়া অডিট আপত্তিকে অনিয়ম বলা যায় না। টাকা ফেরত দিয়ে দিলে তাকে দোষীও বলা যাবে না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মিশনে কর্মরতদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ নতুন কিছু নয়। এর আগেও বিভিন্ন সময় কূটনীতিকদের বিরুদ্ধে অগ্রিম নেওয়া টাকার হিসাব দিতে গড়িমসির অভিযোগ আছে। কেউ কেউ এক যুগেও টাকার হিসাব দাখিল করেননি। তাই চাকরি শেষে অবসরসুবিধা নেওয়ার বিষয়ে কোনো আগ্রহ না থাকায় কাউকে কাউকে হিসাব দিতে বাধ্যও করা যায়নি। এ কারণেই বছরখানেক আগে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নোটিস জারি করে অগ্রিম টাকার হিসাবের বিষয়ে সতর্ক হতে বলা হয়েছিল। পরে আর্থিক অনিয়মের কারণে একজন রাষ্ট্রদূত ও একজন কনসাল জেনারেলসহ কয়েকজনকে দায়িত্ব থেকে ফিরিয়ে এনে ওএসডি করার উদাহরণও আছে। জানা যায়, ১৭ জানুয়ারি সংসদীয় কমিটিতে মহা হিসাবনিরীক্ষকের কার্যালয় থেকে বিভিন্ন দূতাবাসের ওপর করা অডিটের একটি প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। এতে অর্ধশতাধিক কূটনীতিক ও দুই ডজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর অনিয়মের কথা বলা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, মাদ্রিদ ও ব্রাসেলস মিশনের ২৯ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী তাদের বৈদেশিক ও আপ্যায়ন ভাতা মার্কিন ডলারের পরিবর্তে ইউরোতে নিয়ে রাষ্ট্রের ২ কোটি ৬ লাখ ৮৮ হাজার টাকার বেশি ক্ষতি করেছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন অঙ্কের অর্থ মওকুফও করা হয়েছে। এর বাইরে তত্কালীন রাষ্ট্রদূত মো. সাইফুল আমিন খান, রাষ্ট্রদূত এ এইচ এম মনিরুজ্জামান, রাষ্ট্রদূত ইসমত জাহান, কাউন্সিলর আসুদ আহমেদ, মাহফুজুর রহমান, আবিদা ইসলাম ও সফিউল আলম, মিনিস্টার খন্দকার মোহাম্মদ আমিনুর রহমান, প্রথম সচিব মোহাম্মদ মাসুদ রানা চৌধুরী, ফাহিমুল ইসলাম ও তারেক আহমেদ, দ্বিতীয় সচিব ডি এম সালাহউদ্দিন মাহমুদ, ব্যক্তিগত কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম, মনির হোসেন, পুষ্পিতা দত্ত ও লোকমান হোসেন, ইকোনমিক কাউন্সিলর মওদুদ রশীদ সরকার, কমার্শিয়াল মিনিস্টার ফয়জুল লতিফ চৌধুরী, প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. ইদ্রিস, ইউসুফ আলী, আবুল হোসেন ও পারুল বেগম, হিসাবরক্ষক মো. ইউছুপ নিজামী, সহকারী কনসুলার কর্মকর্তা হামিদুল হক খন্দকার ও শফিকুর রহমান, সাঁটলিপিকার জসিম উদ্দিন ও রাজ্জাক বকাউল এবং নিরাপত্তাপ্রহরী জিল্লুর রহমানকে বিভিন্ন অঙ্কের অর্থ ফেরত দিতে বলা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, তাশখন্দ দূতাবাসে চেকের পরিবর্তে ক্যাশে বাড়িভাড়া অনিয়মিতভাবে পরিশোধ করায় ১ কোটি ১৪ লাখ ৫৪ হাজার ২৩১ টাকা ক্ষতি হয়েছে। তবে এর পরিপ্রেক্ষিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জবাবে বলেছে, উজবেকিস্তানে ক্যাশ পরিশোধ ছাড়া আবাসিক ও অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া পাওয়া যায় না। তাশখন্দে ভারত, পাকিস্তান, চীন, মালয়েশিয়া, ফিলিস্তিন একই পদ্ধতিতে বাড়ি ভাড়া করেছে বলেও জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বিমানভাড়া অতিরিক্ত পরিশোধ করা ৮৩ লাখ ৮৫ হাজার টাকার বেশি ক্ষতির অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে মালে, ইয়াঙ্গুন, মানামা, দোহা, থিম্পু, ব্রাসেলস ও লন্ডন দূতাবাসে কাজ করা ১৩ জনের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও রাষ্ট্রদূত মিজারুল কায়েস, রাষ্ট্রদূত এম মারুফ জামান, রাষ্ট্রদূত সাইদা মুনা তাসনিম, সাবেক রাষ্ট্রদূত আবু রুশদ রোকন উদ দৌলা, সাবেক রাষ্ট্রদূত এ এইচ এম মনিরুজ্জামান, সাবেক রাষ্ট্রদূত আতিকুর রহমান, কাউন্সিলর এম ফরহাদুল ইসলাম, প্রথম সচিব শামীম আল মামুন, সার্জেন্ট কামাল হোসাইন, অ্যাটাশে কনসুলার নজরুল ইসলাম, ব্যক্তিগত কর্মকর্তা আবুল কালাম কাজী, প্রশাসনিক কর্মকর্তা এ কে এম রেজাউল করিম ও চন্দন কুমার সাহার বিষয়ে বিভিন্ন অঙ্কের আপত্তি তোলা হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকজন ইতিমধ্যে বাড়তি উত্তোলিত টাকা জমা দিয়ে নিজেদের বিষয়ে অডিট আপত্তির সমন্বয় করেছেন বলেও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। চারটি দূতাবাসে ভ্রমণভাতার বিল অসমন্বিত রয়েছে ৪০ লাখ ১৭ হাজার টাকার। এ জন্য অভিযুক্ত হলেন রাষ্ট্রদূত অধ্যাপক সেলিনা মহসীন, কনসাল জেনারেল শামছুল হক, কনসাল জেনারেল আবু জাফর ও মিনিস্টার মনিরুল ইসলাম। তাদের সবাইকে আপত্তি নিষ্পত্তি করতে তাগিদ দেওয়া হয়েছে। প্রাপ্যতাবিহীন শিক্ষাভাতা গ্রহণ করে পাঁচ কূটনীতিক রাষ্ট্রের ৩২ লাখ ৫৮ হাজারের বেশি টাকার ক্ষতি করেছেন। এরা হলেন সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ হাসিব আজিজ, সাবেক রাষ্ট্রদূত এইচ এম মনিরুজ্জামান, রাষ্ট্রদূত আশরাফ উদ দৌলা, কনসাল ডা. মো. আমির হোসেন ও হজ্জ এও জয়নাল আবেদিন সরকার। লস অ্যাঞ্জেলেস ও নিউইয়র্ক মিশনের ওপর নিরীক্ষা করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাসস্থানে আসবাবপত্র ভাড়ায় ৫৮ লাখ ৭৩ হাজার টাকা ক্ষতির অভিযোগ তুলেছেন নিরীক্ষকরা। তবে ভাড়া না করে ক্রয়ে ক্ষতি বেশি বলে নিজেদের জবাব দিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। জেদ্দা, মাদ্রিদ ও বেইজিং দূতাবাসে মানি রিসিট ছাড়া শিক্ষাভাতা পরিশোধে ২১ লাখ ৪০ হাজার টাকা ক্ষতির কথা বলা হয়েছে। এ জন্য তত্কালীন রাষ্ট্রদূত ড. মো. সাইফুল আমিন খান, সহকারী প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা উইং কমান্ডার আহসান-আল-মামুনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। কলম্বো, লস অ্যাঞ্জেলেস ও প্যারিস দূতাবাসে নিরাপত্তা জামানতের অর্থ আদায়ে ব্যর্থতায় ১৬ লাখ ১০ হাজার টাকা ক্ষতির কথা বলে তত্কালীন হাইকমিশনার মাহবুবুজ্জামান, কনসাল জেনারেল শাহ আহমেদ শফিকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এর জবাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিভিন্ন বাস্তব পরিস্থিতি বর্ণনা করে বলেছে, এখন বাড়িওয়ালাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিলে ক্ষতির অঙ্কের চেয়েও বেশি অর্থ ব্যয় হবে। ১০ দূতাবাসের নিরীক্ষা থেকে প্রাপ্যতাবিহীন বদলিজনিত সুবিধা গ্রহণ করায় রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদ, চৌধুরী ইখতিয়া মমিন, কমডোর এ এস এ আওয়াল, কমডোর এম ইমাম হোসেন, কনসাল জেনারেল আবু জাফর, কমার্শিয়াল কাউন্সিলর এম আজাহারুল হক ও সফি উল আলম, মনিরুল ইসলাম ও সাখাওয়াত হোসেনের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অঙ্ক উল্লেখ করে আপত্তি জানানো হয়েছে। অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ করে বেতন-ভাতা পরিশোধ করে তাশখন্দ দূতাবাসের তত্কালীন রাষ্ট্রদূতের বিরুদ্ধে ১১ লাখ ১৩ হাজার টাকা ক্ষতির কথা বলা হয়েছে। একইভাবে অনিয়মিতভাবে ব্যক্তিগত গাড়ি পরিবহন খরচ গ্রহণ করায় ১০ লাখ ৩০ হাজার টাকা ক্ষতির অভিযোগ তোলা হয়েছে কূটনীতিক মনিরুল ইসলাম ও হারুন আল রশিদের বিরুদ্ধে। প্রাপ্যতার অর্জনের আগেই স্বদেশভিত্তিক ছুটির জন্য ৮ লাখ ৫৪ হাজার টাকা নেওয়ায় অভিযুক্ত হয়েছেন লস অ্যাঞ্জেলেসের তত্কালীন কনসাল জেনারেল আবু জাফর। তবে এ অভিযোগের বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জবাবে বলেছে, প্রাপ্যতার অর্জনের আগেই ছুটির বিশেষ বিধি আছে। সার্বিকভাবে মহা হিসাবনিরীক্ষকের পক্ষ থেকে প্রতিবেদনে কয়েকটি সুপারিশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে— কর্মকর্তাদের বিমানভাড়া গ্রহণ, বাসস্থান ভাড়া ও আসবাবপত্র ক্রয়-ভাড়ার ক্ষেত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করে প্রথা ও বাস্তবতার ভিত্তিতে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। এ ছাড়া সরকারি অনুশাসন যথাসময়ে ও কার্যকরভাবে পালনের জন্য মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়মিত মনিটরিং কার্যালয়ের কথাও বলেছে মহা হিসাবনিরীক্ষকের দফতর।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর