মঙ্গলবার, ২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

নাব্যতা নেই আছে নদী

শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ্ ও রাহাত খান, বরিশাল থেকে

নাব্যতা নেই আছে নদী

বরিশাল শহরতলির এককালের প্রমত্তা তালতলী নদীটি এখন দখল, দুষণ ও পলি পড়ে খালে রূপ নিয়েছে। এককালে এই নদীটির ভয়াল গর্জন শোনা যেত বহুদূর থেকে —বাংলাদেশ প্রতিদিন

কাগজে-কলমে বা বয়োবৃদ্ধদের মুখে বড় বড় নদীর নাম শোনা গেলেও দক্ষিণাঞ্চলের অনেক নদীই এখন খুঁজে পাওয়া যায় না। নাব্যতা হারিয়ে এখন অর্ধেকের বেশি নদী হারিয়ে গেছে মানচিত্র থেকে। যেসব নদী এখনো টিকে আছে তাও নাব্যতা সংকটে। আর এতে ব্যাহত হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের নদীকেন্দ্রিক আয়। নদীমাতৃক দেশের বেশির ভাগ নদীর অবস্থান দক্ষিণাঞ্চলে। নদী মানেই দক্ষিণের এই জনপদকে বোঝায়। এখানকার সাধারণ মানুষ নদীকে অভিশাপ হিসেবে দেখেন না কখনোই। নদীকেন্দ্রিক নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগেই থাকে। তবুও তারা নদীকে ঘিরে গড়ে তুলেছেন নানা কর্মযজ্ঞ। নদীই এখানকার মানুষের প্রাণ। নদীর ওপর নির্ভর করে বিশাল জনগোষ্ঠীর আয় ও জীবিকা নির্বাহ হচ্ছে। আর সেই দক্ষিণাঞ্চলেই এখন নাব্যতার কারণে হারিয়ে যাচ্ছে নদী। চোখ মেলে তাকালে দেখা যায় বড় বড় নদী, কিন্তু এসব নদীর পানীর নিচেই রয়েছে ডুবো চর। আর এতে স্বাভাবিক গতি-প্রকৃতি হারিয়েছে নদী। ফলে নৌযানগুলো ঠেকে যাচ্ছে ডুবো চরে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বরিশালের শহরতলি এলাকায় তালতলী নামে একটি নদী ছিল। এক সময় এই তালতলী নদী দিয়ে স্টিমার, বড় মালবাহী নৌযান রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় যাতায়াত করত। বর্ষা মৌসুম ছাড়াও নদীতে থৈ থৈ করত পানি। ঢেউয়ে ছিল বাঘের গর্জন। কিন্তু আজ নাব্যতা হারিয়ে মরা নদীতে পরিণত হয়েছে এই তালতলী। এখন সেই নদী শুধু কল্পকাহিনী। শুধু তালতলী নদীই নয়, কালসুরী, জয়শ্রী, চন্দ্রমোহন, কালিজিরা, তুষখালী, খয়রাবাদ, সন্ধ্যা, সুগন্ধা, আড়িয়ালখাঁ, পটুয়াখালী এলাকার পাঙ্গাশিয়া, আলগী, আলকি নদীর মতো এমন নাম না জানা নদী এখন বয়োবৃদ্ধদের মুখে গল্পকথায় পরিণত হয়েছে। তালতলী নদী তীরবর্তী চরবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জিয়াউল ইসলাম সাবু বলেন, ঢাকায় যাওয়ার একমাত্র নৌরুট ছিল এই তালতলী। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানিরা যেন আসতে না পারে সে জন্য প্রবেশদ্বারে দুটি জাহাজ ডুবিয়ে রাখা হয়। তিনি আরও বলেন, তালতলী নদী এতটাই উত্তাল ছিল যে, এপার থেকে ওপার যেতে মসজিদে সিরনি মানত করা হতো। আজ সেই নদী দিয়ে পায়ে হেঁটেই এপার-ওপার পার হওয়া যায়। নদী কমিশনের হিসাবে দক্ষিণাঞ্চলের ৬৪ নদী। এর মধ্যে ৩৭টিই এখন অস্তিত্বহীন। বরিশাল বিআইডব্লিউটিএ নৌ-সংরক্ষণ বিভাগের উপপরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম কিছু নদীর নাব্যতা সংকটের কথা স্বীকার করে বলেন, সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা গেছে, কালাবদর, লতা, কীর্তনখোলা, বিষখালী, বরগুনা, রাঙ্গামাটিয়া, নয়াভাংগনী, আমতলী, উজিরপুর, সন্ধ্যা, কালীগঙ্গা, কচা, বলেশ্বর, সাতলা, আগরপুর, আড়িয়াল খাঁ, গণেশপুরা, তেঁতুলিয়া, আগুনমুখ, রাবনাবাদ, কারখানা, লোহালিয়া, বিঘা, বুড়িশ্বর, আন্ধারমানিক, খয়রাবাদ, ইলিশা ও গাবখান নদীর নাম লিপিবদ্ধ থাকলেও ৩৭টির কোনো হদিস নেই। এরমধ্যে বরগুনা, নয়াভাংনী, সাতলা, গণেশপুরা, তেঁতুলিয়া, লোহালিয়া ও ইলিশা নদীর নাব্যতা হারিয়ে গেছে। বরিশাল-ঢাকা নৌরুটের এমভি পারাবত-১০ লঞ্চের মাস্টার মো. শামীম বলেন, প্রমত্তা মেঘনায়ও এখন নাব্যতা সংকট দেখা দিয়েছে। নদীতে নাব্যতার কারণে প্রায় সময় ডুবো চরে লঞ্চ আটকে যায়। অভ্যন্তরীন রুটের লঞ্চের প্রবীণ মাস্টার মো. একিন আলী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দক্ষিণ বাংলার ঐতিহ্য বহনকারী ধানসিঁড়ি নদীর যৌবন হারিয়ে এখন শুধু একটি চিহ্ন হিসেবে কালের সাক্ষী। কবি জীবনানন্দ দাশ এই ধানসিঁড়ির যৌবন দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে তার কবিতায় লিখেন ‘আবার আসিব ফিরে এই ধানসিঁড়ি নদীটির তীরে।’ আজ এই পঙিক্ত বই-খাতায় সীমাবদ্ধ। অপরদিকে পদ্মা ও মেঘনা নদীর মোহনা থেকে উত্পত্তি তেঁতুলিয়া নদী এখন শুধুই একটি খাল। সাহেবের নদী ও চন্দ্রমোহন নদীরও একই অবস্থা। সন্ধ্যা ও সুগন্ধা নদীও এখন মরার পথে। কালসুরী নদী দিয়ে ছিল খুলনাগামী নদীপথ। আজ আর কালসুরীর দেখা মেলে না। ঢাকা-বরিশাল নৌরুটের নন্দিবাজার এলাকার জয়শ্রী নদী এখন মরা খাল। মেঘনা নদীর শাখা এমন ৭-৮টি নদী মরে যাওয়ায় অভ্যন্তরীণ নৌযান ২ ঘণ্টা পথ ঘুরে যেতে হয়। এতে যেমন সময় নষ্ট হচ্ছে, তেমনি ব্যয় হচ্ছে টাকা। পটুয়াখালী এলাকার ঐতিহ্যের ধারক বাকেরগঞ্জ নদীও নাব্যতা হারিয়েছে। বরিশাল ও ঝালকাঠির সীমানা বেষ্টিত কালিজিরা নদী এখন খাল। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ লঞ্চ মালিক সমিতির সহসভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা তো নদী অঞ্চলের মানুষ। তাই নদীকে ঘিরে আমাদের ব্যবসা। আর এই নদী যখন তার নাব্যতা হারিয়ে শুকিয়ে যায়, তখন আমাদের ব্যবসায় মন্দা দেখা দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা পানি ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর (ভিসি) অধ্যাপক ড. এস এম ইমামুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নদী হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের প্রাণ। এই নদীর ওপর বিশাল জনগোষ্ঠীর আয় ও জীবিকা নির্বাহ করে। কিন্তু উজান থেকে পলি আসায় দিন দিন নদীগুলো নাব্যতা হারিয়ে ফেলছে। নাব্যতা কমলে শুধু যে নৌ চলাচল ব্যাহত হবে তা নয়। এতে একটা বিশাল অংশের জীবিকা নির্বাহের পথও নষ্ট হবে। এ ছাড়া নদী তার ধারণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেললে বন্যার পানি উপচে জনবসতিতে গিয়ে পড়বে। এতে কৃষিসম্পদ ও জানমালের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। তবে তিনি বলেন, সবগুলো সম্ভব না হলেও গুরুত্বপূর্ণ নদীগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতেই হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর