শনিবার, ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

পায়রায় ভিড়বে মাদার ভ্যাসেল

পাল্টে যাবে দক্ষিণ বাংলার চিত্র

শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ্, পায়রা বন্দর থেকে

পায়রায় ভিড়বে মাদার ভ্যাসেল

এগিয়ে চলেছে পায়রা বন্দর নির্মাণ কাজ —বাংলাদেশ প্রতিদিন

দেশের একমাত্র গভীর সমুদ্রবন্দর হচ্ছে দক্ষিণের জেলা পটুয়াখালীর কলাপাড়ার উপকূলীয় আন্ধারমানিক নদীর তীরে। এই পায়রা বন্দর ঘিরে দক্ষিণাঞ্চলের চিত্র পাল্টে যাওয়া এখন সময়ের ব্যাপার। বরিশাল, পটুয়াখালী, ফরিদপুর, কলাপাড়া এলাকার গুরুত্বপূর্ণ স্থানে জমি কিনে পায়রা বন্দরকেন্দ্রিক শিল্প-কারখানা গড়ে তুলতে এখন মহাব্যস্ত উদ্যোক্তারা। আর এখন শুধু সেই সোনালি স্বপ্নের দ্বার খোলার অপেক্ষায়। চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়তে পারে না এমন বড় জাহাজ (মাদার ভেসেল) সারা বছরই ভিড়তে পারবে এই পায়রা বন্দরে। করতে হবে না কোনো জোয়ার-ভাটার অপেক্ষা। আর এই পায়রা বন্দর থেকে পণ্য খালাস হয়ে সরাসরি দেশের রাজধানী ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, রংপুরসহ সারা দেশে সহজেই পৌঁছানো এখন সময়ের ব্যাপার। শুধু তাই নয়, বিদেশে রপ্তানি করা পণ্যও খুব সহজেই পাঠানো যাবে এই বন্দর দিয়ে। ৭ হাজার একর সমুদ্র উপকূলের ভূমিতে কর্মসংস্থান হবে লাখো মানুষের। এই বন্দরকেন্দ্রিক গড়ে উঠবে একটি অত্যাধুনিক মেগাসিটি। বন্দর থেকে সরাসরি আকাশপথে যোগাযোগ করতে গড়ে তোলা হবে আন্তর্জাতিক মানের একটি বিমানবন্দর। থাকবে স্টেডিয়াম এবং গড়ে উঠবে বৃহত্তর শিল্প এলাকা। এসবের পাশাপাশি পায়রা বন্দরে থাকবে সরকারের ১৭ দফতরের কার্যালয়। দেশের একমাত্র এই গভীর সমুদ্র বন্দরে হবে বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমারের অর্থনৈতিক করিডর বিসিআইএমের প্রাণকেন্দ্র। নেপাল ও ভুটানসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশই ব্যবহার করতে পারবে এই বন্দর। আর এসব বাস্তবায়নে চলছে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ। পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী নাসির উদ্দিন জানান, বন্দরের পুরো কাজ শেষ হতে কিছুটা সময় লাগলেও এ মাসের শেষের দিকে বহির্নোঙরে মাদার ভেসেলের পণ্য খালাসের উদ্বোধন করতে পারেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দরের গভীরতা কম। এতে বড় জাহাজ ভিড়তে পারে না। কিন্তু পায়রার রামনাবাদ চ্যানেলে ভাটার সময়ও অনেক পানি থাকে। আর এ জন্য সেখানে অনেক বড় জাহাজ ভেড়তে পারবে। চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ ভিড়াতে জোয়ারের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। আর চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় লাইটার জাহাজ চলাচলের ক্ষেত্রেও সন্দ্বীপ চ্যানেলে জোয়ারের জন্য কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। এতে খরচ বেশি পড়ে। আর পায়রা থেকে ঢাকার পানগাঁও নদীবন্দরে পণ্যবাহী জাহাজ চলাচলে জোয়ারের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে পায়রার সঙ্গে ঢাকার সড়ক ও রেল সংযুক্ত হলে ঢাকা-চট্টগ্রামের চেয়ে ঢাকা-পায়রার দূরত্ব কম হবে। পায়রা বন্দরে মোট ১৬টি জেটি নির্মাণ করা হচ্ছে। বড় বড় জাহাজ ভেড়াতে ড্রেজিং চলছে। দেশের একমাত্র গভীর বন্দরে মাল খালাসের সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। থাকবে বিশ্বমানের সেবা। বন্দর ব্যবহারে প্রতি টন মালামালে ৩৪ টাকা হারে চার্জ নেওয়া হবে। তবে শুরুতে ব্যবসায়ীদের আকৃষ্ট করতে এই বন্দর ব্যবহারে ৮০ শতাংশই ছাড় দেওয়া হবে বলে জানা গেছে। আর এতে চার্জ হবে টন প্রতি ৩৪ টাকার পরিবর্তে মাত্র ৬ টাকা ৮০ পয়সা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ইতিমধ্যে শুল্ক স্টেশন স্থাপন করেছে। শিপিং এজেন্ট, সিঅ্যান্ডএফ, ফ্রেইট ফরোয়ার্ডও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আগামী সাড়ে তিন বছরে চার লেনের মহাসড়ক ও ডাবল গেজ রেললাইনের সঙ্গে যুক্ত হবে পায়রা বন্দর। ভারত, চীনসহ বিভিন্ন দেশ পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। গভীর সমুদ্র বন্দরের পাশাপাশি এলএনজি টার্মিনাল, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, নৌবাহিনী ও পর্যটনশিল্পের জন্যও সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে। এই বন্দর থেকে নৌপথেই দেশের যে কোনো জেলায় পণ্য আনা-নেওয়া করা যাবে। যা চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে কখনো সম্ভব হয়নি। বন্দরের পাশেই আন্ধারমানিক ও রামনাবাদ নদীর মোহনায় দেবপুর মৌজায় কয়লাভিত্তিক এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুেকন্দ্রের নির্মাণ করা হচ্ছে। সূত্র জানায়, আমদানি-রপ্তানিকারকরা যাতে স্বল্প খরচে পায়রা বন্দর ব্যবহারে শুল্ক করে ছাড় পেতে পারে এ জন্য এনবিআরকে চিঠি দিয়েছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. সাইফুল ইসলাম স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে পায়রা বন্দরের মাধ্যমে আমদানি করা পণ্যের ইনভয়েস মূল্যের ওপর আরোপিত শুল্ক, ভ্যাট ও অগ্রিম আয়করসহ অন্যান্য চার্জে আগামী ২৪ মাস (দুই বছর) পর্যন্ত ৫০ শতাংশ ছাড় দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে। পায়রায় সাড়ে সাত হাজার কনটেইনারের সংকুলান হবে। ফলে কার্গো হ্যান্ডেলিংয়ের খরচ অর্ধেকেরও নিচে নামবে। এতে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের ওপর থেকে চাপ কমার পাশাপাশি ট্রানজিট বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।

সরেজমিন দেখা গেছে, পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার আন্ধারমানিক নদীর তীরে পায়রা সমুদ্র বন্দরের কাজ দ্রুতগতিতে চলছে। প্রাথমিকভাবে টিয়াখালী গ্রামের ১৬ একর জমিতে অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে। বন্দরের এই অংশে প্রবেশ করতেই বামপাশে রয়েছে নিরাপত্তা ভবন। পাকা সড়ক থেকে ৫.৬ কিলোমিটার সরু সড়কের সিংহভাগ পাকা এবং পায়রা বন্দরের কাছাকাছি কিছু অংশ এখনো কাঁচা (ইটের সলিং) রয়েছে। এই রাস্তা থেকে বন্দরের ভিতরে সরাসরি পন্টুন পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। বন্দরের চারপাশে এবং রাস্তার দুই পাশে লাইটিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। নদীতে বসানো হয়েছে একটি অত্যাধুনিক পন্টুন ও কনটেইনার ক্রেন। অফিস ভবন ও ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টের কাজ চলছে পুরোদমে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে এক হাজার ১৪২ কোটি টাকা ব্যয়ে করা হচ্ছে পায়রা বন্দরের টিয়াখালী অংশের কাজ। এর মধ্যে প্রশাসনিক ভবন, সীমানা প্রাচীর, মহাসড়কের সঙ্গে সংযোগ সড়ক, নদীতে ড্রেজিং, জেটি বসানো, টাগ বোট, পাইলট বোট, সার্ভে ভেসেল, বয়ালেয়িং ভেসেলসহ আরও অনেক স্থাপনা। অপরদিকে নদীর ওপারে লালুয়া গ্রামে ৭ হাজার একর ভূমিতে মূল বন্দরটি নির্মাণ করা হবে। যার প্রস্তাবিত ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। শুরুতে মাদার ভেসেল থেকে লাইটার জাহাজে নৌপথে পণ্য পরিবহন হবে বলে সড়ক ও রেলপথ ছাড়াই বন্দরটি চালু করা যাবে। এ জন্য লালুয়ার চারিপাড়া পয়েন্টে পন্টুন স্থাপন করা হচ্ছে। বড় জাহাজ ভেড়ানোর জন্য কমপক্ষে ৯ মিটার গভীরতা দরকার হয়, সেখানে রামনাবাদ চ্যানেলে ভাটার সময়ও ১৪ মিটার পানি থাকে বলে জানায় সংশ্লিষ্টরা। পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ক্যাপ্টেন মো. সাইদুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশের এই একমাত্র গভীর সমুদ্র বন্দরের মাদার ভেসেল থেকে পণ্য উঠা-নামার সব ব্যবস্থা হাতে নেওয়া হয়েছে। যে কোনো সময় এই কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হবে। তিনি বলেন, মূল বন্দর করা হবে আন্ধারমানিক নদীর ওপারে লালুয়াতে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আরও বলেন, বন্দরটি পাশের দেশ ভারত ও মিয়ানমারের অত্যাধুনিক বন্দরের মতোই গড়ে তোলা হচ্ছে। এখানে থাকবে ট্রানশিপমেন্ট টার্মিনাল, কনটেনার টার্মিনাল, বাল্ক টার্মিনাল, জেনারেল সার্ভিস টার্মিনাল, এলএনজি টার্মিনাল, ওয়েল রিফাইনিং, পেট্রোলিয়াম টার্মিনালসহ আরও অনেক স্থাপনা।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর