রবিবার, ৬ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

নারীর বিস্ময়কর উত্থান ঘটছে

বাংলাদেশ প্রতিদিনের গোলটেবিল বৈঠক

নিজস্ব প্রতিবেদক

নারীর বিস্ময়কর উত্থান ঘটছে

‘অধিকার, মর‌্যাদায় নারী-পুরুষ সমানে সমান’ শীর্ষক বাংলাদেশ প্রতিদিনের গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা

শিক্ষায় গত ১০ বছরে মেয়েদের ঝরে পড়ার হার ৭০ থেকে কমে ৪০ ভাগে নেমেছে। বাংলাদেশে আগের চেয়ে ঘরের বাইরে কাজ করতে গিয়ে নারীর প্রতিবন্ধকতাও কমেছে। গত ছয়-সাত বছরে দেশে নারীর বিস্ময়কর উত্থান ঘটেছে। তবে কিছু অন্ধকার জায়গাও রয়েছে। ছেলেরা সহযোগিতা করলেই যে মেয়েরা এগিয়ে যাবে এমন নয়, নারীকে তার নিজ যোগ্যতায় উঠে আসতে হবে। কারণ, সমাজ শুধু নারী হওয়ার কারণে একজন তার দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করতে পারবেন কিনা তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করে। এ জন্য নারীনীতির সঙ্গে সংগতি রেখে শিক্ষানীতি তৈরির ওপর জোর দিতে হবে। ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে গতকাল সকালে বাংলাদেশ প্রতিদিন এক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপ কার‌্যালয়ের কনফারেন্স রুমে আয়োজিত এ বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন। গোলটেবিল বৈঠকের বিষয় ছিল ‘অধিকার, মর‌্যাদায় নারী-পুরুষ সমানে সমান’। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি।

অনুষ্ঠানে বক্তারা আরও বলেন, সরকারি তথ্যানুসারে নির‌্যাতিত নারীর ৮৭ ভাগই তাদের নিজ ঘরে নির্যাতিত হচ্ছেন। সে কারণে আমাদের ঘরকেই আগে শুদ্ধ করতে হবে। তারা নারী নির্যাতন বন্ধে পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ছেড়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার আহ্বান জানান। একই সঙ্গে নারীকে দুর্বল ভাবার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে বলেন।

বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী বক্তব্য দেন। বসুন্ধরা গ্রুপের টেলিভিশন চ্যানেল নিউজ টোয়েন্টিফোরের প্রধান বার্তা সম্পাদক শাহনাজ মুন্নীর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে আরও বক্তব্য দেন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম অহিদুজ্জামান, কালের কণ্ঠ সম্পাদক সাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন, সংসদ সদস্য ফজিলাতুন্নেসা বাপ্পী, বাংলাদেশ মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক কামরুন্নাহার ডানা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা, ঢাবি গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং নিউজ টোয়েন্টিফোরের হেড অব কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স সামিয়া রহমান, চলচ্চিত্র নির্মাতা নার্গিস আক্তার, নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব.), গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. নওশিন শারমিন পূরবী ও জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের খেলোয়াড় সাথিরা জাকির জেসি।

মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, ‘একজন মেয়েকে শৈশব থেকেই নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। সন্তান প্রসবের সময় একজন নারীর যে শারীরিক কষ্ট হয় তা তাদের চেপে যেতে বলা হয়। নারী যতক্ষণ নিজেকে প্রস্তুত না করবে ততক্ষণ সমতা অর্জন সম্ভব হবে না। আমি দেখেছি ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে বিয়ের জন্য পাত্রী পছন্দের ক্ষেত্রে মানুষ মেয়েটির বাহ্যিক সৌন্দর্যকে প্রাধান্য দেয় আর ৩০ শতাংশ তার গুণকে। যেদিন রূপে-গুণে একজন নারীকে সমান মূল্যায়ন করা হবে সেদিন নারীর সমঅধিকার অর্জিত হবে। আমি কোটাব্যবস্থার পক্ষে নই। পুরুষের অনেক পরে মেয়েরা ঘরের বাইরে কাজ শুরু করেছে। এ জন্য তাদের কিছুটা সময় দিতে হবে। দেখা যাচ্ছে যে, ইরানে উচ্চশিক্ষিত মেয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন চাকরির ক্ষেত্রে ছেলেদের প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। এমনও হয়তো দেখা যাবে যে, ২০৪০ সালে ছেলেদের জন্য কোটাব্যবস্থা চালু হবে। কারণ শিক্ষায় দেশের মেয়েরা অনেক এগিয়ে যাচ্ছে। নারীর সমতা অর্জনের জন্য দারিদ্র্য দূর করতে হবে, শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। আশার কথা যে, প্রাথমিকে মেয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমান সরকার নারী উন্নয়নে নানা পদক্ষেপও নিয়েছে। শিক্ষায় গত ১০ বছরে মেয়েদের ঝরে পড়ার হার ৭০ থেকে ৪০ ভাগে নেমেছে।’

নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অহিদুজ্জামান বলেন, ‘নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় দুটি ক্ষেত্রে নজর দেওয়া দরকার। একটি হলো নারীনীতির সঙ্গে সংগতি রেখে যে শিক্ষানীতি করা হয়েছে সে অনুসারে পাঠ্যসূচি তৈরি আর দ্বিতীয়টি মিডিয়ায় নারীর যথোপযুক্ত অংশগ্রহণ। পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত নারীর নিজের ভূমিকা অনুযায়ী কাজ করতে হবে। বুঝতে হবে, আমরা নারী কিংবা পুরুষ নই; বরং আমরা সবাই মানুষ।’ কালের কণ্ঠ সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন বলেন, ‘নারী ও পুরুষের মধ্যে ব্যবধান করা এক ধরেনর মূর্খতা। আমাদের নারীনীতি নয়, মানুষনীতি তৈরির ওপর জোর দিতে হবে। নারীকে ছোট বা অবমাননা করতে যারা চায় তারা হচ্ছে সমাজের একশ্রেণির তথাকথিত শিক্ষিত মানুষ।’ বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম বলেন, ‘নারীর ক্ষমতায়নে সরকারের পদক্ষেপ প্রশংসনীয়। আমাদেরও সবার দায়িত্ব রয়েছে নারীর ক্ষমতায়নে ভূমিকা রাখা। দুর্বল মানুষের ওপর নির‌্যাতন বেশি হয়, নারী দুর্বল বলে তাদের ওপর নির‌্যাতন বেশি হয়। নারীকে দুর্বল ভাবার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।’

সংসদ সদস্য ফজিলাতুন্নেসা বাপ্পী বলেন, ‘পরিসংখ্যান ব্যুরোর সরকারি তথ্যানুসারে নির্যাতিত নারীর ৮৭ ভাগই তাদের নিজ ঘরে নির‌্যাতিত হচ্ছে। সে কারণে আমাদের ঘরকেই আগে শুদ্ধ করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের সংবিধানের আর্টিকেল ২৮-এ স্পষ্টভাবে নারী অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। ২০১১ সালের নারীনীতিও নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় এক যুগান্তকারী নীতি। এগুলো বলবৎ করতে হবে।’ ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ গড়তে এই সংসদ সদস্য মানসিকতার পরিবর্তন করতে বলেন। সর্বোপরি, যতক্ষণ না লিঙ্গসমতা আসবে ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের যুদ্ধ করে যেতে হবে। কাঁটা সরিয়ে, কাঁটা বেছেই পথ চলতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

কামরুন্নাহার ডানা বলেন, ‘আমি নিজেকে আগে মানুষ ভাবী তারপর নারী। সত্তর দশকে আমাদের সময় সামাজিক প্রতিবন্ধকতা অনেক বেশি ছিল, যা বর্তমানে অনেক কমেছে। আমি খেলাধুলার জন্য পারিবারিক সমর্থন পেলেও আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে কটূক্তি শুনেছি। আমি নিজেও চেয়েছি খেলাধুলায় আরও বেশি নারীর অন্তর্ভুক্তি। তবে মেয়েদের এগিয়ে যাওয়ার পথ সুগম করতে পরিবার, সমাজ উভয় স্থান থেকে দায়িত্ব নিতে হবে।’

জিনাত হুদা বলেন, ‘শুধু নারী বা শুধু পুরুষ এগিয়ে গেলে সমাজ মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। কারণ এক পক্ষের উন্নয়নে সমাজ টিকবে না। উভয় পক্ষকে সমানতালে এগিয়ে যেতে হবে।’ তার মতে, এখনো সমাজে নারী নানা বৈষম্যের শিকার। নারীর উন্নয়নে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। পুত্র-কন্যার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই এ বোধ জাগ্রত করতে হবে।

সামিয়া রহমান বলেন, ‘আমি ফেমিনিস্ট শব্দের ঘোর বিরোধী। একজন নারীকে তার নিজ যোগ্যতায় উঠে আসতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘হাজার হাজার ছেলেমেয়ের মধ্যে প্রতিযোগিতা করে পরীক্ষা দিয়ে টিভিতে কাজ করার সুযোগ পাই। অথচ অনেকেই আমাকে কটাক্ষ করে বলেন, আমি চেহারা দেখিয়ে টিভিতে এসেছি। এমনকি অনেক পুরুষ সহকর্মী আমার যোগ্যতা ও বেতন নিয়েও নানা কটূক্তি করেন।’ তার মতে, এখনো মেয়েদের চ্যালেঞ্জিং পেশায় যাওয়ার ক্ষেত্রে পরিবার থেকে বাধা দেওয়া হচ্ছে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে মেয়েদের ভর্তি হওয়ার হারও বাড়ছে না।

চলচ্চিত্র নির্মাতা নার্গিস আক্তার তার বক্তব্যে বলেন, ‘আমার ছেলে যখন আমার কাজ নিয়ে গর্ববোধ করে তখন খুব আনন্দিত হই। কিন্তু দুঃখ লাগে তখনই যখন দেখি এখনো দেশে নারী নির্মাতার যথেষ্ট অভাব। শুধু নারী চলচ্চিত্র নির্মাতা হওয়ার কারণে অনেকেই আমি সেলিম আল দীনের “যৈবতী কন্যার মন” শিরোনামে যে চলচ্চিত্র নির্মাণ করছি তা ভালোভাবে নির্মাণ করতে পারব না বলে সন্দেহ প্রকাশ করছেন। কিন্তু আমার নির্মিত ছবি “মেঘলা আকাশ” জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার পর আমার মনের জোর বেড়ে গিয়েছে।’

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব.) বলেন, গত ছয়-সাত বছরে বাংলাদেশে নারীর বিস্ময়কর উত্থান ঘটেছে। তবে কিছু অন্ধকার জায়গাও রয়েছে। যেমন— নারী গৃহকর্মীরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। আবার প্রতি বছর কয়েক হাজার নারী পাচার হয়ে যাচ্ছে। নারীর নিরাপত্তায় তিনি পুলিশবাহিনীতে নারী সদস্য বৃদ্ধি, পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ছেড়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার আহ্বান জানান। গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. নওশিন শারমিন পূরবী বলেন, ‘কাজের সুবাদে আমার বিভিন্ন শ্রেণি-গোষ্ঠীর নারীর সঙ্গে দেখা হয়। কিন্তু এদের মধ্যে যারা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী নন তারা বিনামূল্যের চিকিৎসা নিতে পারেন না। নারীদের মধ্যে এখন ৯%ই আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকছে। কিশোরী মায়েরা নানা স্বাস্থ্যগত সমস্যায় ভুগছে।’

জাতীয় নারী দলের ক্রিকেটার সাথিরা জাকির জেসি বলেন, ‘ছোটবেলায়ই আমি পুতুলের চেয়ে বেশি পছন্দ করতাম ক্রিকেট। আমার মা আমাকে ছোটবেলায়ই খেলার জন্য উৎসাহ দিতেন।’ এই নারী ক্রিকেটার বলেন, ‘মা-বাবার সহযোগিতা পেয়েছি বলেই আজ সব প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে এ অবস্থানে পৌঁছাতে পেরেছি। তবে বিয়ের পর একজন নারী খেলোয়াড়ের অনেক বাধা আসে। এ জন্য স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন যদি সেই নারী খেলোয়াড়কে সহযোগিতা করেন তবে তিনি তার পেশাগত জীবনে এগিয়ে যাবেন।’ তার মতে, ছেলেরা সহযোগিতা করলেই মেয়েরা এগিয়ে যাবে।

সর্বশেষ খবর