শনিবার, ১২ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

জয়পুরহাটে ওরা শ্যালক-দুলাভাই

ক্ষমতার দাপট

নিজস্ব প্রতিবেদক

শ্যালক-দুলাভাইয়ের শাসন চলছে জয়পুরহাটে। আইন-কানুনের কোনো তোয়াক্কা করেন না তারা। তাদের মুখের কথাই সেখানে আইন। জেলার

উন্নয়নকাজের টেন্ডার, সরকারি-বেসরকারি নিয়োগ, তদবির ও লিজ বাণিজ্য থেকে শুরু করে চাঁদাবাজি, দখলবাজি, চোরাচালান— সব কিছুর নিয়ন্ত্রক এখন সেখানে তারাই। দিনদুপুরে কখনো উচ্ছেদ করে দখল করে নিচ্ছেন সাধারণ মানুষের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। রাতের আঁধারে সাবাড় করছেন রাস্তার দুই পাশের হাজার হাজার গাছ। অল্প সময়ের মধ্যেই তারা হয়ে উঠেছেন অগাধ সম্পদের মালিক। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, কেউ প্রতিবাদ করলেই প্রশাসনযন্ত্র ব্যবহার করে নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। তাদের হুমকি-ধমকি আর অত্যাচার-নির্যাতনে জেলার সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। মানুষ এখন ভীতসন্ত্রস্ত।

জয়পুরহাটের এই প্রভাবশালী ব্যক্তিটি হলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক এবং জেলা পরিষদের প্রশাসক এস এম সোলায়মান আলী। ১/১১ সময়ের জয়পুরহাট জেলার সংস্কারপন্থি হিসেবে পরিচিত এই নেতা জেলা পরিষদের প্রশাসক পদে মনোনীত হওয়ার পরই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। তার সব কাজ দেখভালের জন্য সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করেন তারই শ্যালক এনায়েত উল্লাহ। কাগজপত্র ও দলিল-দস্তাবেজে শ্যালক এনায়েত উল্লাহর নাম রেখে সব অনৈতিক কাজ করে যাচ্ছেন সোলায়মান আলী। শ্যালকের নামে মদিনা এন্টারপ্রাইজ, এএম এন্টারপ্রাইজসহ বেশ কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান খুলেছেন তিনি। অন্যদিকে দুলাভাই জেলার প্রভাবশালী নেতা ও পরিষদের প্রশাসক হওয়ায় শ্যালক এনায়েত উল্লাহ ক্ষমতাধর হয়ে ওঠেন। কখনো কখনো দুলাভাইয়ের চেয়েও দাপুটে হয়ে ওঠেন এই শ্যালক। ভুক্তভোগীরা বলছেন, সরকারি-বেসরকারি জমি দখল থেকে শুরু করে জেলার সব ব্যবসা-বাণিজ্য ও নিয়োগের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছেন তারা। টানা দ্বিতীয়বার দল ক্ষমতায় আসার পর এসব ক্ষেত্রে এসেছে বেপরোয়া ভাব। ক্ষমতাসীন দলের হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেও কোনো ফল হয় না। জেলায় ক্ষমতাসীন দলের আরও নেতা ও এমপি থাকলেও সব ক্ষমতাই যেন শ্যালক-দুলাভাইয়ের কুক্ষিগত। প্রশাসনিক সব কর্মকাণ্ড তাদের নির্দেশ ছাড়া চলে না। দলীয় নেতা-কর্মীরাও তাদের কাছে পাত্তা পান না। জানা গেছে, এস এম সোলায়মান আলী ও তার শ্যালকের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর দফতরসহ সংশ্লিষ্ট দফতরে অভিযোগ আসার পর একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা তদন্ত শুরু করেছে। এসব বিষয় জানতে চাইলে জয়পুরহাট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম সোলায়মান আলী বলেন, ‘অভিযোগ সব মিথ্যা। আমি আওয়ামী লীগ করি। এই মাত্র ৭ মার্চের অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিয়ে এলাম। প্রধানমন্ত্রী জানেন আমার ব্যাপারে। ওনাকে জিজ্ঞাসা করলেও জানতে পারবেন।’ জয়পুরহাট জেলার বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, জেলা পরিষদের প্রশাসক হওয়ার পর যেসব উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ হয়েছে, তার সিংহভাগই করেছে মদিনা এন্টারপ্রাইজ ও এএম এন্টারপ্রাইজ নামে দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এ দুটি প্রতিষ্ঠানেরই কাগজপত্রে মালিক তার শ্যালক এনায়েত উল্লাহ। তবে প্রকৃত মালিক যে সোলায়মান তা ‘ওপেন সিক্রেট’। এ বিষয়ে সোলায়মান বলেন, ‘প্রশাসক হিসেবে আমি ৩০ হাজার টাকা সম্মানী পাই যা দলীয় লোকদের মধ্যে বিতরণ করে দিই। চলার জন্য ব্যবসা করি। কিন্তু যেভাবে প্রচার করা হচ্ছে, সেভাবে নয়। আমার কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নেই।’ তার শ্যালকের প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে বলেন, ‘আমি যেহেতু প্রশাসক, তাই পরিচিত বন্ধুবান্ধব কাজ চাইলে না করা যায় না। আর তা ছাড়া প্রকৌশল বিভাগ এ টেন্ডার বিষয়ে কাজ করে। হয়তো আমার স্বাক্ষর লাগে। আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা খুব একটা নেই।’ সূত্র জানায়, প্রশাসকের নির্দেশে তার আপন লোকেরা রাস্তার দুই ধারের পাঁচ হাজার গাছ কেটে সাবাড় করে নেন। ঝড়ের সময় ভেঙে পড়া গাছ বিক্রির অল্প কিছু টাকা পরিষদের ফান্ডে জমা রেখে মোটা অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করে নেওয়া হয়। পাঁচবিবিতে ভ্রাম্যমাণ আদালত গাছ কাটার সময় দুই ব্যক্তিকে আটক করেন। তারা এ সময় আদালতের কাছে কর্তনের নির্দেশদাতা হিসেবে সোলায়মানের নাম বলেছেন। সূত্র জানান, প্রশাসক হওয়ার পরই ডাকবাংলোর নিচতলার তিনটি কক্ষ অবৈধভাবে দখল করে নিয়েছেন সোলায়মান। জেলার খাসপুকুর লিজ পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে বেশ কয়েক ব্যক্তির কাছ থেকে ৭০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। টাকাপয়সা খুইয়ে লোকজন এখন পথে নেমেছে। সূত্র জানান, জেলা পরিষদের একটি দোকানের লিজগ্রহীতার মৃত্যুর পর তা দেখাশোনা করতেন ওই ব্যক্তির বিধবা স্ত্রী। প্রশাসক সোলায়মান নানা কৌশলে সেই লিজ বাতিল করে মদিনা এন্টারপ্রাইজের নামে লিজ করিয়ে নেন। উপার্জনের রাস্তা হারিয়ে সেই বিধবা মহিলা এখন পথে বসেছেন। সূত্র জানিয়েছেন, প্রশাসক সোলায়মান জয়পুরহাটে থাকলেও আক্কেলপুর উপজেলার একটি স্কুলের সভাপতি হন ছয় মাসের জন্য। ওই ছয় মাসে তিনি বেশ কয়েকজনকে নিয়োগ দেন মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে। নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করেই তিনি ওই পদ থেকে সরে দাঁড়ান।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর