বুধবার, ১৬ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

হানাদার বাহিনীকে রুখতে রাস্তায় গাছের গুঁড়ি ফেলেছিলাম

নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু

হানাদার বাহিনীকে রুখতে রাস্তায় গাছের গুঁড়ি ফেলেছিলাম

একাত্তরের ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পল্টন ময়দানে ভাষণ দেন। সেই ভাষণে তিনি আমাদের গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দেন। বঙ্গবন্ধুর  নির্দেশে আমরা পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে কাজ শুরু করি। আমরা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে থাকি। আমাদের বিভিন্ন দায়িত্বের মধ্যে ছিল বিক্ষোভ মিছিল। সমাবেশের পাশাপাশি জনগণের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করা। ৬ মার্চ রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশ ছিল উত্তাল। সেদিন রাতে ছিল কারফিউ। পাকিস্তানি বাহিনীর নিষ্ঠুরতা ও নির্মমতায় ঢাকা তখন লাশের নগরীতে পরিণত হয়। এর আগে ১ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে খুন হন ছাত্রনেতা তসলিম। তসলিমের মৃত্যুর পর আমাদের আন্দোলন অনেক বেগবান হয়। পরবর্তী সময়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আরেক নেতা ফারুক ইকবালকেও মৌচাকের সামনে গুলি করে হত্যা করা হয়। তসলিম ও ফারুক মালিবাগ, গুলবাগ, মৌচাক এলাকার দায়িত্বে ছিল। ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ এবং ‘জয় বাংলা’-এ স্লোগান নিয়েই আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ভাষণ দেবেন এবং তার ঘোষণায় আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচি ঠিক করা হবে। বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে আসার আগেই সারা দেশের কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-জনতা মিলে ১০ লক্ষাধিক মানুষ রেসকোর্স ময়দানে এসে হাজির হয়। কৃষকরা হাজির হয় লাঙ্গল ও কাস্তে নিয়ে। শ্রমিকরা আসে কোদাল ও শাবল নিয়ে। বিকাল ৪টার একটু পর বঙ্গবন্ধু এলেন। তিনি ভাষণ দিলেন। তোফায়েল আহমেদসহ অন্য নেতারা তখন মঞ্চে ছিলেন। আমরা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সবাই মঞ্চের খুব কাছেই ছিলাম। বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো; এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’ আমাদের উজ্জীবিত করল। রেডিও পাকিস্তান ঐতিহাসিক সে ভাষণটি প্রচার করেনি। আমরা তখন শাহবাগে রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্র ও আজিমপুরের সেনা রিক্রুটমেন্ট অফিসে আক্রমণ করলাম। রেডিওর বাঙালি কর্মকর্তারা তখন আমাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে রাস্তায় বেরিয়ে এলেন। পাকিস্তান সরকার বাধ্য হয়ে ৮ মার্চ বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণটি ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার করে। হুকুম দিতে না পারলেও আমাদের কী করণীয় এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু তার বক্তব্যে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। ২৩ মার্চ ছিল পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবস। ওই দিন এ দেশের কোনো অফিস-আদালতে আমরা পাকিস্তানি পতাকা উড়তে দেইনি। তারা আমাদের আক্রমণ করতে পারে আমরা এ আশঙ্কায় ছিলাম। কিন্তু তাদের সে আক্রমণ এতটা ভয়ঙ্কর হবে, তা ছিল কল্পনাতীত। তারা ট্যাংক, কামান ও ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নিরীহ বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমরা হানাদার বাহিনীর সেনাদের রুখতে রাস্তায় গাছের গুঁড়ি ফেলে রেখেছিলাম। কিন্তু ওরা ব্যবহার করেছিল ভারী অস্ত্র, ট্যাংক আর কামান। তাই ওদের আমরা প্রতিহত করতে পারিনি। ২৫ ও ২৬ মার্চ গণহত্যা চলল। এক রাতেই ঢাকা লাশের শহরে পরিণত হয়।

আমি, আমার বন্ধু রাইসুল ইসলাম আসাদ, কাজী শাহজাহান ববী, তুহিন পুলিশের কাছ থেকে রাইফেল ছিনিয়ে নিয়ে কেরানীগঞ্জে চলে গেলাম। বেশ কিছু দিন ট্রেনিং শেষে ঢাকা আক্রমণ করার পরিকল্পনা করলাম। কিন্তু ২ এপ্রিল পাকিস্তানের নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী ও সেনাবাহিনী কেরানীগঞ্জ আক্রমণ করে। বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে সেই ঘোষণা প্রচারের পর আমরা সংঘবদ্ধ হই। হেঁটে হেঁটে ৩০০ কিলোমিটার দূরত্বের পথ চট্টগ্রাম যাই। কুমিল্লা হয়ে যাই ত্রিপুরা রাজ্যের হরিনায়। বিএসএফের একজন মেজর আমাকে ২ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার খালেদ মোশাররফের কাছে নিয়ে যান। সেখানে তারা আমাকে বলেন, বাংলাদেশ থেকে মুক্তিকামী যুবকদের নিয়ে আসার জন্য। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে আমি ঢাকায় আসি। ঢাকা থেকে অর্ধশত যুবককে নিয়ে ১৫ মে আবার ভারতে যাই। সেখানে ঢাকা, কুমিল্লা, ফরিদপুরের হাজার হাজার যুবক ট্রেনিংয়ে অংশগ্রহণ করে। ট্রেনিং শেষে আমি ও আমার বন্ধু শহীদ মানিক ঢাকা উত্তর মুক্তিবাহিনীর দায়িত্ব নিই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা কলেজ, কল্যাণপুরসহ বিভিন্ন জায়গায় অপারেশন চালাই। এর পর ঢাকার বাইরে সাভার ও ধামরাইয়ে অপারেশন চালাই।

সর্বশেষ খবর