বুধবার, ২৩ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা
কৃষি সংবাদ

গোলাপ ফুলের ব্যবসায় লাখপতি অর্ধশত যুবক

মোস্তফা কাজল

গোলাপ ফুলের চাষ করে মাত্র কয় বছরে লাখপতি হয়েছেন অর্ধশত যুবক। ১০-১২ হাজার টাকা নিয়ে শুরু করা এ ব্যবসার মাধ্যমে আজ তারা স্বাবলম্বী। এসব যুবক এখন ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকার মালিক বনে গেছেন।

এই যুবকদেরই গোলাপ বাগান রয়েছে রাজধানীর উপকণ্ঠ তুরাগ তীরের বিরুলিয়া গ্রামে। সরেজমিন দেখা যায়, নির্জন এ গ্রামের দুই পাশে তৈরি করা হয়েছে গোলাপের বাগান। সেখানে সারি সারি ফুটে আছে গোলাপ। গ্রামজুড়ে একই নান্দনিক দৃশ্য। সংশ্লিষ্টরা জানান, ঢাকার উপকণ্ঠ সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নে তুরাগ নদের কোলঘেঁষে অন্তত ছয়টি গ্রামের কৃষি অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে মিরান্ডি জাতের গোলাপ। এর পাশাপাশি লিংকন ও সাদা জাতের গোলাপের আবাদও হচ্ছে। তবে অধিক লাভজনক বলে মিরান্ডি জাতের গোলাপ চাষ করায় গ্রামগুলোর এখন নতুন পরিচিতি হয়েছে ‘লাল গোলাপের গ্রাম’ বলে। জানা যায়, বছরজুড়েই এ ছয় গ্রামে ফুল থাকে। এখানকার যুবকদের ৯০ ভাগই গোলাপ চাষ করছেন বাণিজ্যিক ভিত্তিতে। অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ায় প্রান্তিক চাষিরাও ঝুঁকছেন গোলাপ চাষে। ফার্মগেট ও শাহবাগসহ রাজধানীর বিভিন্ন ফুলের বাজারে গোলাপের প্রধান জোগান দেন বিরুলিয়ার এই চাষিরা। সাভার উপজেলা কৃষি অফিসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বিরুলিয়ার আড়াইশ হেক্টর জমিতে ফুলের চাষ হয়। এর মধ্যে বেশির ভাগ জমিতেই হয় গোলাপ চাষ। বিরুলিয়ার কমলাপুর গ্রামে সাত হেক্টর জমিতে গোলাপ, পাঁচ হেক্টরে গ্লাডিওলাস, বাগ্নিবাড়ি গ্রামে ১৫৫ হেক্টরে গোলাপ ও ৩০ হেক্টরে গ্লাডিওলাস, কাকাবর গ্রামে ২ হেক্টরে গোলাপ, বিরুলিয়া গ্রামের ৪৬ হেক্টরে গোলাপ ও ৫ হেক্টরে গ্লাডিওলাস আবাদ হয়। এ ছাড়া বিরুলিয়ার মোস্তাপাড়া, শ্যামপুরসহ অন্যান্য গ্রামে কম-বেশি গোলাপের আবাদ হয়। স্থানীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, মোস্তাপাড়া, শ্যামপুর, সাদুল্লাপুর, কমলাপুর, বাগ্নিবাড়ি, কুমার খোদায় বসতবাড়িসহ মোট এলাকা ৬১৪ হেক্টর। এর মধ্যে শুধু ফুলের আবাদ হয় প্রায় ২০০ হেক্টরে। স্থানীয় ফুল চাষি হানিফ উদ্দিন জাহাঙ্গীর জানান, উপযুক্ত মাটি থাকার কারণে এখানের গোলাপ চাষে সাফল্য আসে। ফলন বেশি হচ্ছে পাকা মিলন, মিরান্ডি, লিংকন ও সাদা জাতের গোলাপে। তবে অধিক লাভজনক হওয়ায় মিরান্ডি জাতের গোলাপ চাষ হচ্ছে বেশি। বিরুলিয়ায় ফুল দেখতে বেড়াতে আসা জেসমিন সুলতানা বলেন, এমনিতেই গ্রামগুলো শান্ত ছবির মতো। তার ওপর বিস্তৃত জমিতে গোলাপের সমাহার যে কোনো সৌন্দর্যপিপাসু মানুষকে মুগ্ধ করবে। স্থানীয় ফুল ব্যবসায়ীরা নিজেদের প্রয়োজনে এ গ্রামেই গড়ে তুলেছেন হাট। এ ছাড়া শ্যামপুর গ্রামে প্রতি সন্ধ্যায় বসে গোলাপের হাট। সেখানকার আবুল কাশেম মার্কেটের সামনে সন্ধ্যা থেকেই শুরু হয় ফুল ব্যবসায়ীদের আনাগোনা। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অসংখ্য ব্যবসায়ী এসে ভিড় জমান সেখানে। জমতে থাকে  বেচাকেনা। চলে গভীর রাত পর্যন্ত। এ ছাড়া মোস্তাপাড়ায় রয়েছে সাবু মার্কেট। এ মার্কেটেও গোলাপ বেচাবিক্রির কারবার হয়। স্থানীয় ফুল ব্যবসায়ী ও নার্সারি মালিক হাজী দুলাল মিয়া জানান, প্রতিটি মার্কেটে প্রতিদিন গড়ে ৮০ জন ফুল ব্যবসায়ী ফুল কিনতে আসেন। প্রত্যেককে ৪টি করে ফুলের বান্ডিল কিনে নিয়ে যান। প্রতি বান্ডিলে থাকে ৩০০টি ফুল। বর্তমানে প্রতি বান্ডিল বিক্রি হচ্ছে ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকায়। প্রতিদিন এই দুই মার্কেট থেকে এক লাখের বেশি ফুল বিক্রি হয়। এই মার্কেট থেকেই রাজধানীর শাহবাগ, আগারগাঁও এবং খামারবাড়িতে ফুল চলে যায়। স্থানীয় কৃষক আমিরুল মিয়া জানান, গোলাপের চাহিদা থাকে সব সময়। তাই চাষিরাও সারা বছর ব্যস্ত থাকেন। বিশেষ উৎসবের দিনগুলোতে চাহিদা বেড়ে যায় বহুগুণ।

লাভ ও খরচ : গোলাপ চাষিরা জানিয়েছেন, জৈব ও রাসায়নিক সার, বীজ, কীটনাশকসহ বছরে প্রতি হেক্টর জমিতে ফুল চাষে খরচ হয় সাত লাখ টাকা। শীতে পোকামাকড়ের প্রকোপ কম থাকলেও গরমে খুব বেশি থাকে। এ কারণে কীটনাশক দিতে হয়। নিয়মিত পানি সেচ, সার ও পরিচর্যা ছাড়া ভালো গোলাপ উৎপাদন করা সম্ভব নয়। প্রতি হেক্টরে বছরে ১৫ লাখ ফুল উৎপাদন হয়। গড়ে একটি ফুল এক টাকা করে বিক্রি করলে পাওয়া যায় ১৫ লাখ টাকা। বর্তমানে ফুলের পাইকারি দাম তিন থেকে সাড়ে তিন টাকা।

যেভাবে গোলাপের যাত্রা : প্রায় ২৫ বছর আগে সাভারের অজোপাড়া খ্যাত মোস্তাপাড়া গ্রামে পরীক্ষামূলকভাবে গোলাপ ফুলের চাষ শুরু হয়। এলাকার মাটি ফুল চাষের জন্য বেশ উপযোগী হওয়ায় গোলাপ চাষে সাফল্য আসে। ক্রমশ এ অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষ বাড়তে থাকে। এলাকাবাসীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮১ সালের দিকে হল্যান্ড থেকে মিরান্ডি জাতের বীজ এনে রাজধানীর মিরপুরে বোটানিক্যাল গার্ডেনে বপন করা হয়। ১৯৮৬ সালে  বোটানিক্যাল গার্ডেনের একজন গবেষক সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নের মোস্তাপাড়া গ্রামে মিরান্ডি ফুলের বীজ বপন করেন। এরপর থেকে এ অঞ্চলে শুরু হয় গোলাপ ফুলের চাষ ও ব্যবসা। পরবর্তী সময়ে তা সাভার, সিঙ্গাইরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।

সর্বশেষ খবর