বৃহস্পতিবার, ৭ এপ্রিল, ২০১৬ ০০:০০ টা

রাজধানী ছেড়ে আশপাশের এলাকায় আশ্রয়ে অপরাধীরা

ভাড়াটিয়ার তথ্য আতঙ্ক

সাখাওয়াত কাওসার

ভাড়াটিয়া তথ্য আতঙ্কে ভুগছে অপরাধীরা। পর্যায়ক্রমে রাজধানী ছেড়ে তারা আশ্রয় নিচ্ছে রাজধানীর উপকণ্ঠ আমিনবাজার, বড়দেশী গ্রাম ও কাউন্দিয়া ইউনিয়ন, পার্শ্ববর্তী জেলা নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার রসুলপুর, নাসিরাবাদ, মিরাজনগরসহ আশপাশ এলাকায়। এসব অপরাধীকে মদদ জোগাচ্ছেন সরকারি দলে যোগ দেওয়া বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা। সম্প্রতি রাজধানীতে গ্রেফতার অপরাধী ও জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদে এবং গোয়েন্দা অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এমন তথ্য। ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের নির্দেশে ফেব্রুয়ারিতে ডিএমপির প্রতিটি থানা এলাকার প্রতিটি বাড়ির মালিককে সরবরাহ করতে হয়েছে ভাড়াটিয়া নিবন্ধন ফরম। এ ফরমে বিভিন্ন তথ্যের মধ্যে রয়েছে জাতীয় পরিচয়পত্রের, পাসপোর্ট ও মুঠোফোন নম্বর।

পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘এখন কেবল ঢাকা মহানগর এলাকায় ভাড়াটিয়াদের তথ্য নেওয়া হচ্ছে। যতদূর জেনেছি রাজধানীর আশপাশ এলাকার ভাড়াটিয়াদের তথ্যও সংগ্রহের ব্যাপারে ভাবছে পুলিশ সদর দফতর।’ সম্প্রতি গ্রেফতার জঙ্গিদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, নাশকতা চালিয়েই তাদের আশপাশ এলাকায় আত্মগোপনে চলে যাওয়ার কথা ছিল। পরিকল্পনা ছিল ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে নাশকতা চালানোর। গ্রেফতার ব্যক্তিরা এক প্রবাসীর অর্থায়নে ঢাকার আশপাশে অবস্থান নিয়ে সংগঠিত হচ্ছিল। একাধিক গোয়েন্দা সূত্র বলছে, গত কয়েক বছরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে নাশকতার ঘটনা ঘটিয়েই অপরাধীরা আশ্রয় নিচ্ছিল সাভারের আমিনবাজার, বড়দেশী গ্রাম ও কাউন্দিয়া ইউনিয়নের বিচ্ছিন্ন গ্রামে। রাজধানীর সন্নিকটে হওয়ার পরও এসব গ্রামে নৌকা ছাড়া যোগাযোগের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় তাদের গ্রেফতার করাও সম্ভব হতো না। গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য রয়েছে, যুদ্ধাপরাধ মামলায় ফাঁসির দণ্ডাদেশ পাওয়া জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর রায় কার্যকরকে কেন্দ্র করে ঢাকায় বড় ধরনের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড হতে পারে। তারই আগাম প্রস্তুতি হিসেবে একটি গোষ্ঠী ঢাকার চারদিকে অবস্থান নিতে পারে। এবার তারা ঢাকা থেকে বের হওয়ার এবং প্রবেশের মুখগুলোতে ব্যাপক নাশকতা চালাতে পারে। সূত্র জানায়, অপরাধীদের পরোক্ষভাবে মদদ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে কাউন্দিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সাইফুল আলম খানের বিরুদ্ধে। তিনি একসময় বিএনপির ডাকসাইটে নেতা ছিলেন। বর্তমানে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তবে বিএনপির রাজনীতি করার সময় আওয়ামী লীগের সব কাজ জোরপূর্বক বন্ধ করে রেখেছিলেন চেয়ারম্যান সাইফুল। ১৯৯৭ সালের ৬ জুলাই কাউন্দিয়া কৃষক লীগের সমাবেশে ২০-২৫ জনকে গুলি করে সমাবেশও পণ্ড করেন তিনি। র‍্যাবের দুই গোয়েন্দা সদস্যকে হত্যার অভিযোগে ২০১০ সালের মে মাসে স্ত্রীসহ গ্রেফতার হয়েছিলেন সাইফুল। এদিকে অপরাধীদের মদদ দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে মুঠোফোনে সাইফুল আলম এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমি ২১ বছর আগে বিএনপি করতাম এটা সত্য। তবে এখন আমি আওয়ামী লীগ করি। আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।’ জানা গেছে, গত বছর ২২ অক্টোবর রাত ৯টার দিকে গাবতলীর আমিনবাজার ব্রিজের ঢালে চেকপোস্টে দায়িত্ব পালনকালে দারুস সালাম থানার এএসআই ইব্রাহিম মোল্লাকে (৪০) এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাতে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। হত্যাকাণ্ডের পর পালানোর সময় পুলিশ ও জনতা বগুড়া জেলার আদমদীঘি উপজেলা শিবিরের সাথী মাসুদ রানাকে গ্রেফতার করে। তার তথ্যমতে, ওই রাতেই রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর থেকে পাঁচটি হ্যান্ডগ্রেনেডসহ জামায়াত নেতা আবদুল আজিজ মিয়া এবং তার দুই ছেলে শিবির কর্মী ফজলে রাব্বী ও রাকিব হাসানকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাদের কাছ থেকে পাঁচটি হ্যান্ডগ্রেনেড উদ্ধার করা হয়। গত বছর ২৩ অক্টোবর হোসনি দালানে গ্রেনেড হামলায় দুজনের মৃত্যু ও দেড় শতাধিক মানুষকে আহত করার ঘটনায় ব্যবহৃত হ্যান্ডগ্রেনেডের সঙ্গে হুবহু মিল রয়েছে উদ্ধার হ্যান্ডগ্রেনেডগুলোর। এগুলোও তাজিয়া মিছিলের মতো বড় ধরনের নাশকতায় ব্যবহারের কথা ছিল। মাসুদ রানা আরও জানান, পুলিশ কর্মকর্তা হত্যাকারী কামাল বগুড়া জেলার আদমদীঘি উপজেলা ছাত্রশিবিরের সভাপতি। এসব ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ২১ মার্চ কল্যাণপুর থেকে আবদুর রাজ্জাক উমায়ের, ফয়সাল আহম্মেদ, আহমেদ ফজল আকবর ও আবু নাঈম মোহাম্মদ জাকারিয়া নামে চার জঙ্গি গ্রেফতার হয়। তাদের দেওয়া তথ্যে রীতিমতো চমকে ওঠেন তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা। ঊর্ধ্বতন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, অনেক অপরাধী আত্মগোপনে থাকার সময় বিএনপি, জামায়াত-শিবির ও এসব দল থেকে সরকারি দলে যোগ দেওয়া অনেক প্রভাবশালীদের আশ্রয় পাচ্ছে। বিশেষ করে সাভারের আমিনবাজার, বড়দেশী, কাউন্দিয়া, আশুলিয়া, চক্রবর্তী, বাইপাইল, কামরাঙ্গীরচর, পোস্তগোলা, শ্যামপুর, শনির আখড়া, ডেমরা, সানারপাড়, ভাঙ্গা প্রেস ও গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকা তাদের বিশেষ পছন্দ। এসব এলাকার গার্মেন্টস থেকে শুরু করে বিভিন্ন মিল-কারখানার শ্রমিক হিসেবে চাকরি করছে তারা। অনেক সময় টাকার জোরে এরা আওয়ামী লীগ নেতার বাড়ি ভাড়া নিয়ে বসবাস করছে। এটিও তাদের গ্রেফতার এড়ানোর কৌশল। জানা গেছে, রাজধানীর চারদিকের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় অপরাধীরা আত্মগোপন করার বিষয়টি পুলিশের উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে আগেই আলোচিত হয়েছে। এ জন্য রাজধানীবাসীর ডাটাবেজের পাশাপাশি ঢাকা ও গাজীপুর জেলার নাগরিকদের ডাটাবেজ তৈরির প্রস্তাব করা হয়েছে। পুলিশ সদর দফতর বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে তাতে সম্মতি দিয়েছে। রাজধানীর পর সবার আগে ঢাকা জেলার সাভারের জনগণের ডাটাবেজ তৈরির কথা রয়েছে। কম্পিউটার প্রোগ্রামটি সেভাবেই তৈরি করা হয়েছে বলে ওই কর্মকর্তা জানিয়েছেন। পুলিশ সদর দফতরের তরফ থেকে সারা দেশে চলমান অভিযান নিজামীর ফাঁসি কার্যকরের আগে ও পরে জোরদার করার কথা বলা হয়েছে। ডিবির দক্ষিণ বিভাগের উপকমিশনার মাশরুকুর রহমান খালেদ জানিয়েছেন, কল্যাণপুর থেকে গ্রেফতারদের চার সহযোগী জঙ্গি বিভিন্ন সময় আমিনবাজার, বড়দেশী, কাউন্দিয়া, সাভারসহ রাজধানীর আশপাশের সুবিধাজনক জায়গায় থাকত। সম্প্রতি গ্রেফতারদের চার সহযোগীর অমর একুশে বইমেলায় নাশকতা চালানোর পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু সে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগেই চলতি বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর হাতিরঝিল থেকে তারা গ্রেফতার হয়। র‍্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জানান, ঢাকাসহ আশপাশ ছাড়াও সারা দেশে র‍্যাবের গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। নিজামীর রায় কার্যকর উপলক্ষে যে কোনো ধরনের অরাজক পরিস্থিতি এড়াতে র‍্যাবের সব প্রস্তুতি রয়েছে।

সর্বশেষ খবর