শিরোনাম
শুক্রবার, ৮ এপ্রিল, ২০১৬ ০০:০০ টা

রুপালি বিপ্লব মৎস্য খাতে

উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশ চতুর্থ

জিন্নাতুন নূর

রুপালি বিপ্লব মৎস্য খাতে

জনপ্রিয় সেই বাংলা প্রবাদ ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ শুধু পাঠ্যপুস্তকেই এখন আর সীমাবদ্ধ নয়, এটি এখন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এক বাস্তবতা। মুক্ত জলাশয় থেকে শুরু করে ব্যক্তি উদ্যোগে বাড়ির আশপাশের পুকুরে মাছ চাষ করে বাংলাদেশি চাষিরা ঘটিয়ে যাচ্ছেন রুপালি বিপ্লব। বাংলাদেশের প্রাণিজ আমিষের ৫৭ শতাংশই পূরণ হচ্ছে মাছ থেকে। মাছ রপ্তানি করেই বাংলাদেশে বছরে আয় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। মিঠা পানির মাছ উত্পাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান এখন চতুর্থ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) প্রতিবেদনে এমনটাই জানানো হয়েছে। এফএও পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০২২ সাল নাগাদ বিশ্বে যে চারটি দেশ মাছ চাষে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করতে পারে, এর শীর্ষে আছে বাংলাদেশের নাম। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের আড়াই লাখ হেক্টর উন্মুক্ত জলাশয় আর গ্রামীণ উদ্যোগে গড়ে ওঠা লাখ লাখ পুকুর মাছ চাষের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান। এফএও বিশ্বের মাছ চাষ পরিস্থিতি নিয়ে ‘দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার’ নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদন অনুযায়ী চীন প্রথম এবং এর পরই মাছ চাষে অবস্থান করছে ভারত ও মিয়ানমার। মত্স্য খাতে বাংলাদেশকে বিশ্বের অন্যতম দেশ হিসেবে বিবেচনা করছে এফএও। সংস্থাটির হিসাবে, সামুদ্রিক মাছ আহরণের দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ২৫তম। তবে ভারত ও মিয়ানমারের সমুদ্র জয়ের পর বাংলাদেশের সামুদ্রিক মত্স্য আহরণ আরও বৃদ্ধি পাবে বলে সংস্থাটি ধারণা করছে। মত্স্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ এমপি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রতি বছর দেশে মাছের উত্পাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমুদ্র জয়ের পর আমাদের সামুদ্রিক মাছ আহরণের সুযোগও তৈরি হয়েছে। এ জন্য আমরা মালয়েশিয়া থেকে একটি আধুনিক জাহাজ তৈরি করে আনছি, যা সমুদ্র জরিপ করে কোথায় কী পরিমাণ মাছ আছে তা পর্যবেক্ষণ করবে।’ তিনি বলেন, ‘এরই মধ্যে মাছ উত্পাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমরা জলাশয় নিবিড়ভাবে চাষ করছি। চাষিদের মাছ চাষে প্রযুক্তিগতভাবে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। যেসব

জলাভূমি অব্যবহূত তা ব্যবহারের উদ্যোগ নিয়েছি। আমাদের মত্স্যবিজ্ঞানীরাও পোনা উত্পাদনে গবেষণা করছেন।’ সংশ্লিষ্টদের মতে, সরকার যদি মাছ চাষে আরও কার্যকর ভূমিকা রাখে তবে বাংলাদেশের শীর্ষ মাছ উত্পাদনকারী দেশে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এফএওর হিসাব অনুযায়ী, ধারাবাহিকভাবে এক যুগ ধরে বাংলাদেশ মাছ চাষে বিশ্বের শীর্ষ পাঁচটি দেশের মধ্যে আছে। ২০০৬ সালে ভারতকে টপকে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছিল বাংলাদেশ। আর ২০০৪ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশের মাছের উত্পাদন ৫৩ শতাংশ বেড়েছে। বিশেষ করে ময়মনসিংহ, গাজীপুর, বগুড়া ও কুমিল্লা জেলার পুকুরে এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে ঘেরে মাছ চাষে রীতিমতো বিপ্লব ঘটেছে। মত্স্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে মিঠা পানির মাছের রপ্তানি ক্রমেই বাড়ছে। মত্স্য অধিদফতরের তথ্যে, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ৩৫ লাখ টনের কিছুটা বেশি মাছ উত্পাদিত হয়েছে।  তবে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এসে তা ৩৫ লাখ টন ছাড়িয়ে যায়। মত্স্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, বর্তমানে দেশে বছরে মাছ উত্পাদন হচ্ছে ৩৭ লাখ টন। আর প্রতিবছরই এক থেকে এক লাখ ২৫ হাজার টন উত্পাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে মাছ উত্পাদনের অপার সম্ভাবনা আছে। মিঠাপানির মাছ চাষে পৃথিবীর সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান বাংলাদেশ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পোশাক খাতের মতো রপ্তানিযোগ্য পণ্যের তালিকায় বাংলাদেশের মাছকে এখন স্থানীয় পর্যায় থেকে শুরু করে বহির্বিশ্বে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় পরিসংখ্যান থেকে পাওয়া তথ্যে, গত দুই দশকে মাছ চাষের ক্ষেত্রে স্থানীয় কৃষকরা বিপ্লব ঘটিয়েছেন। আর এক যুগের বেশি সময়ে মাছ উত্পাদন বেড়েছে পাঁচ গুণেরও বেশি। বাংলাদেশের মাছ রপ্তানি বেড়েছে ১৩৫ গুণ। আশা করা হচ্ছে, ২০২১ সালের মধ্যে শুধু চিংড়ি রপ্তানি করেই কয়েকশ’ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করা সম্ভব। ইউরোপ ও রাশিয়ায় বাংলাদেশি চিংড়ির বড় বাজার আছে।

এ ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের ফুড অ্যান্ড ভেটেরিনারি অফিস বাংলাদেশের মাছ উত্পাদন, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, প্রশিক্ষণ ও সার্টিফিকেশনের ওপর সন্তুষ্টি প্রকাশ করে প্রতিবেদন দিয়েছে। এতে ইউরোপে মাছ রপ্তানির পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর অর্থনৈতিক শুমারিমতে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশে ৩৪ লাখ ৫৫ হাাজার টন মাছ উত্পাদিত হয়েছে। এর মধ্যে চাষ করা মাছের পরিমাণ প্রায় ২০ লাখ টন, যার বাজারমূল্য প্রায় ৫৩ হাজার কোটি টাকা। জাটকা সংরক্ষণে নানা উদ্যোগের ফলে ইলিশের উত্পাদন বেড়ে হয়েছে চার লাখ টন। মূলত বাংলাদেশি মত্স্যবিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত উন্নত জাত এবং দ্রুত সম্প্রসারণের ফলে উত্পাদন এতটা বেড়েছে। তবে মাছচাষিদের এখনো ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা আছে। মাছ রাখার জন্য নেই কোনো হিমাগার। বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে হিমায়িত খাদ্য ও মত্স্যজাতীয় পণ্য রপ্তানি করে আয় হয়েছিল ৫৬ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলার। চলতি অর্থবছরে এ খাতে রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৫৭ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি মাছ রপ্তানি করা হয়, যা ৩২ কোটি ৫৯ লাখ ৯০ হাজার মার্কিন ডলার।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর