রবিবার, ১০ এপ্রিল, ২০১৬ ০০:০০ টা

বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ত্রিপক্ষীয় সমন্বয়ের প্রত্যাশী স্থানীয়রা

আন্দোলন স্থগিত

সাইদুল ইসলাম ও রেজা মুজাম্মেল, চট্টগ্রাম

চট্টগ্রামের বাঁশখালীর গণ্ডামারায় এস আলম গ্রুপের প্রস্তাবিত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে সরকার, প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান এস আলম ও স্থানীয় জনগণের মধ্যে একটি সমন্বিত উদ্যোগ চান স্থানীয় জনগণ। স্থানীদের দাবি, সৃষ্ট ঘটনা ও সমস্যায় তিন পক্ষের মধ্যে সমন্বয় ঘটলে উত্তেজনার নিরসন হবে। অন্যথায় পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে বলে বাসিন্দারা মনে করেন। তারা জানান, প্রকল্পের কাজ শুরুর আগে ভিডিও প্রজেক্টরের মাধ্যমে একাধিকবার বিদ্যুৎকেন্দ্র সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো উপস্থাপন করা হয়েছে। ওই সময় স্থানীয়রা স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করেছিলেন। গণ্ডামারা ইউনিয়নের পশ্চিম বড়ঘোনার বাসিন্দা রুবেল চৌধুরী বলেন, প্রকল্প কর্তৃপক্ষ শুরুর দিকে ভূমি ক্রয়ের জন্য এলাকায় সাইনবোর্ড দিয়েছিল। এর পর স্থানীয় ভূমি মালিকরা নিজ উদ্যোগেই প্রকল্প কর্তৃপক্ষের কাছে জমি বিক্রি করেন। আমাদের একটি বংশই এককভাবে ৫০০ কানি যথাযথ মূল্যে বিক্রি করেছি। তাছাড়া কর্তৃপক্ষ আমাদের নানা সুবিধাও দিয়েছেন। আরেক জমি বিক্রেতা গণ্ডামারা ইউনিয়নের শাহরিয়ার চৌধুরী আরমান বলেন, প্রকল্প এলাকার ৮০ শতাংশ জমির মালিক জমিদার বাড়ির মানুষ। আমরা প্রকল্পের পক্ষে। কারণ এর মাধ্যমে স্থানীয় মানুষদের ভাগ্য পরিবর্তন ও কর্মসংস্থান হবে। কিন্তু একটি চক্র প্রকল্প কর্তৃপক্ষ থেকে টাকা ও নানা সুবিধা নিয়েছে। আরও বেশি সুবিধা আদায় করতে গেলে এ নৃশংস ঘটনার সূত্র হয়। চক্রটি নিজের সুবিধা আদায় করার পর এখন এলাকার সাধারণ মানুষদের ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত সৃষ্টি করছে। কিন্তু প্রকৃত জমি মালিকরা তাদের ন্যায্য পাওনা পেয়েছেন। পশ্চিম বড়ঘোনার জমি বিক্রেতা বয়োবৃদ্ধ হাজী নওশা মিয়ার ছেলে জহিরুল ইসলাম বলেন, প্রকৃত জমি মালিকরা ইতিমধ্যে প্রকল্প কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মতবিনিময় করেছি। কর্তৃপক্ষ যেহেতু ন্যায্য মূল্যে জমি কিনেছে, তাই এখন আমাদের কোনো অভিযোগ বা আপত্তি নেই। যারা আন্দোলন করছেন তারা জমির মালিক নন।

প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উত্পাদনে এস আলম গ্রুপ বাঁশখালীর পশ্চিম গণ্ডামারা ও অলোকদিয়া এলাকায় মোট ৮৫৫ একর ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি কেনে। প্রকল্প স্থানে পূর্ব থেকে থাকা উপকূলীয় এলাকার ৩৭টি পরিবারের ১৫০ জনকে (প্রতিঘরের পুরুষ সন্তান হিসাবে) প্রয়োজনীয় টাকা ও বিকল্প জমি দিয়ে পুনর্বাসন করা হয়েছে। ইতিমধ্যে প্রকল্পের জন্য ক্রয়কৃত জমি ভরাটসহ নানা কাজ শুরু হয়েছে। এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, যা ঘটেছে তা কখনো কাম্য নয়, এটি অমানবিক। আমি খুবই মর্মাহত। এরপরও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে নিহতদের প্রত্যেকের জন্য ১০ লাখ টাকা এবং তাদের পোষ্যদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে। একই সঙ্গে আহতদের চিকিৎসার খরচ ও তাদের কর্মসংস্থানেরও উদ্যোগ নেওয়া হবে। প্রশাসনের মাধ্যমে এ টাকা নিহতদের পরিবারকে দেওয়া হবে। আহতদের দেওয়া হচ্ছে চিকিৎসা খরচ। তাছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নে আমরা সব নিয়ম অনুসরণ ও স্থানীয়দের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়েছি। তিনি আরও বলেন, ওই প্রকল্প নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি নির্দেশনা দিয়েছেন। নির্দেশনায় আছে, এ বিদ্যুৎ প্রকল্পের আয়ের একটি অংশ প্রকল্প এলাকার স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার উন্নয়নসহ এলাকার জনগণের জীবন-মান উন্নয়নে ব্যয় করা হবে। এলাকায় জনসাধারণ সুলভ মূল্যে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সংযোগ পাবে।

নেওয়া হয় পরিবেশ ছাড়পত্র : কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে নিয়ম অনুযায়ী পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র নেওয়া হয়েছে বলে দাবি প্রকল্প কর্তৃপক্ষের। পরিবেশ, মত্স্য ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় নেওয়া হয়েছে চীনা বিশেষজ্ঞ দলের সমীক্ষা। ওই দলের প্রতিনিধি মি. ওয়ান প্রজেক্টের মাধ্যমে স্থানীয়দের কাছে কয়লা বিদ্যুৎ নিয়ে নানা ধারণা ও সুফল উপস্থাপন করেছিলেন। পরিবেশ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, গত ২২ মার্চ এক প্রতিবেদনে এস আলম গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠানের নামে পরিবেশ ছাড়পত্র প্রদান করে পরিবেশ অধিদফতর। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘দাখিলকৃত দলিল দস্তাবেজ এবং পরিদর্শন প্রতিবেদনে উল্লিখিত তথ্যাবলি বিশ্লেষণ পূর্বক প্রস্তাবিত পাওয়ার প্লান্টের অবস্থানগত ছাড়পত্র প্রদান করা যেতে পারে’। তাছাড়া ১২ মার্চ পরিবেশ অধিদফতরের দুজন ও প্রকল্প কর্তৃপক্ষের দুজন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

স্বার্থ রক্ষা হবে স্থানীয়দের : প্রকল্প কর্তৃপক্ষ বলছে, স্থানীয়দের স্বার্থ রক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। তাছাড়া বাজার মূল্যের চেয়ে দ্বিগুণ বা তিনগুণ পর্যন্ত বেশি মূল্য দিয়ে জমি কেনা হয়েছে বলে জানান তারা। প্রকল্প সমন্বয়ক নাছির উদ্দিন বলেন, প্রকল্পের জন্য অনেক জায়গা বাজার মূল্যের চেয়ে তিনগুণ বেশি টাকা দিয়ে কেনা হয়েছে। স্থানীয়দের ঘর তৈরি করে পুনর্বাসনও করা হয়েছে। তৈরি করা হবে মসজিদ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ নানা স্থাপনা। তাছাড়া ইতিমধ্যে ৩৮০ জন জমি মালিকসহ স্থানীয়দের সঙ্গে আমাদের বৈঠক হয়েছে। ন্যায্য পাওনা দেওয়ায় তাদের কোনো অভিযোগও নেই। তার পরও সুবিধাভোগী একটি চক্র স্থানীয়দের বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছেন।

মালিকদের সঙ্গে মতবিনিময় : গত শুক্রবার প্রকল্প এলাকার প্রায় ৩৮০ জন ভূমি মালিক, স্থানীয় মুরব্বি, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদ। মতবিনিময়কালে তিনি বলেন, পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সারা বিশ্বে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উত্পাদন হয় তার প্রায় ৭০ শতাংশ বিদ্যুৎ উত্পাদন হয় কয়লা থেকে। এ ক্ষেত্রে চীনে ৯০ শতাংশ, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ৭০ শতাংশ বিদ্যুৎ উত্পাদন হয় কয়লা থেকে। তাছাড়া বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি ইট ভাটা থেকে যে পরিমাণ ধোঁয়া নির্গত হয় তা দুটি কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকেও বেশি। ফলে কয়ল ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পরিবেশ নষ্ট হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তিনি বলেন, তারপরও এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে পরিবেশের যে কোনো ক্ষতি হবে না তা বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে ভিডিওচিত্র তৈরি করে বাঁশখালীর হাট-বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে দেখানো হবে। একই সঙ্গে পরিবেশের ওপর আসলেই কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কিনা তা সরেজমিনে যাচাই করতে ভারত ও চীনের প্রতিষ্ঠিত কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিদর্শনের জন্য এলাকাবাসীদের একটি দলকে শিগগির পাঠানো হবে। বিদেশ সফরের এই টিমের তালিকা তৈরি করবেন স্থানীয়রা। সভায় গণ্ডামারা ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য রিদোয়ানুল হক বলেন, ‘এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে যদি বাঁশখালীর ৮০ ভাগ উপকার হয় এবং ২০ ভাগ ক্ষতি হয় তা-ও বাঁশখালীবাসী প্রকল্প বাস্তবায়নে সর্বাত্মক সহায়তা করবে। সভায় উপস্থিত ছিলেন এস আলম গ্রুপের পরিচালক প্রকৌশলী শহিদুল ইসলাম, নির্বাহী পরিচালক সুব্রত কুমার ভৌমিক, স্থানীয় মুরব্বি হাজী নওশা মিয়া, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও গণ্ডামারা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সিরাজুদ্দৌলা চৌধুরী, জমির মালিক ও ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সভাপতি নুরুল আবছার চৌধুরী, গণ্ডামারা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মাস্টার শামসুল আলমসহ গণ্ডামারা ইউনিয়নের নয়জন ইউপি সদস্য ও জমি মালিকরা। পরিশেষে নিহতদের মাগফিরাত কামনায় দোয়া করা হয়।

এদিকে গতকাল বাঁশখালীতে আন্দোলন কর্মসূচি ১৫ দিনের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর