সোমবার, ১৮ এপ্রিল, ২০১৬ ০০:০০ টা

বোমা মেশিনে ক্ষতবিক্ষত পঞ্চগড়

সরকারের কোটি কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি, নষ্ট হচ্ছে হাজার হাজার একর ফসলি জমি, হুমকির মুখে পরিবেশ, ভূমিকম্পের আশঙ্কা

মাহমুদ আজহার ও সরকার হায়দার, পঞ্চগড় থেকে

বোমা মেশিনে ক্ষতবিক্ষত পঞ্চগড়

তেঁতুলিয়ার ডাহুক নদীতে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে তোলা হচ্ছে পাথর —বাংলাদেশ প্রতিদিন

পঞ্চগড়ে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে অবৈধ বোমা মেশিনের (ড্রিল ড্রেজার) মাধ্যমে পাথর উত্তোলন করছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। নষ্ট হচ্ছে হাজার হাজার একর ফসলি জমি। হুমকির মুখে পড়েছে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য। সম্ভাবনাময় জেলা পঞ্চগড় ক্ষত-বিক্ষত হয়ে পড়ছে। বোমা মেশিনের সাহায্যে পাথর উত্তোলনের ফলে মাটির নিচে সৃষ্টি হচ্ছে শূন্যতা। সরকার হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব। ভূমিকম্পে যে কোনো সময় বিশাল গর্তের সৃষ্টি হয়ে তলিয়ে যেতে পারে এলাকার আবাদি জমি ও বসতবাড়ি। অবৈধ এ কাজে পুলিশ প্রশাসনেরও যোগসাজশ রয়েছে। দৈনিক লাখ লাখ টাকায় স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ প্রশাসনের পকেট ভারী হলেও হুমকির মুখে পড়েছে পঞ্চগড়ের পরিবেশ। অথচ বোমা মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলন করা যাবে না—উচ্চ আদালতের এ বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। স্থানীয় পরিবেশবিদ, এলাকাবাসীসহ সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য। জানা যায়, বোমা মেশিন ঘিরে গড়ে উঠেছে একশ্রেণির দালাল চক্র। তারা বিভিন্ন মেশিন থেকে চাঁদা তুলে লোকজনকে ম্যানেজ করছে। নিয়ন্ত্রণ করছে কল বাহিনী নামক আরেকটি চক্রকে। এই কল বাহিনী বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রশাসনের অভিযানের আলামত দেখলেই তারা মেশিন-মালিকদের খবর দেয়। খবর পেয়েই মালিকরা মেশিন লুকিয়ে ফেলে। কল বাহিনীর সদস্যদের জনপ্রতি প্রতিদিন ১ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়। অনেক সময় পুলিশ নিজেরাই তাদের অভিযানের আগাম বার্তা জানিয়ে দেয় কল বাহিনীকে। আর এ চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছে ভজনপুর এলাকার আবু বক্কর ও আলমগীর হোসেন। এ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক অমল কৃষ্ণ মণ্ডল বলেন, ‘বোমা মেশিন বন্ধের ব্যাপারে আমরা কঠোর অবস্থান নিয়েছি। অচিরেই যারা এর সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ পঞ্চগড় পরিবেশ পরিষদের সভাপতি তৌহিদুল বারী বলেন, ‘বোমা মেশিন দিয়ে পাথর তোলায় গভীরে বিশাল শূন্যতার সৃষ্টি হচ্ছে। এতে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প হলেই ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সম্প্রতি পঞ্চগড়ে কয়েকবার বিভিন্ন মাত্রায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে।’ সূত্র জানায়, একশ্রেণির প্রভাবশালী অসাধু ব্যবসায়ী দিনে ও রাতের আঁধারে বোমা মেশিন দিয়ে পাথর তুলছে। জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় তিন শতাধিক বোমা মেশিন চলছে। পুলিশ প্রশাসন বিষয়টি জানলেও কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার ঘুষ-বাণিজ্য হচ্ছে। অবৈধ এই লেনদেনে ভারী হচ্ছে প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের পকেট। মাটির গভীর থেকে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকলেও এক বছর ধরে এ বোমা মেশিন তেঁতুলিয়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় চালিয়ে আসছে অসাধু মহল। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাঝেমধ্যে বোমা মেশিনের বিরুদ্ধে অভিযান চললেও খুব একটা তোয়াক্কা করছেন না ব্যবসায়ীরা। মাঝেমধ্যে জড়িতদের নামে মামলা দেওয়া হলেও আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে এসে আবার একই কাজ করছেন তারা। সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, সদর উপজেলার জগদল, কাঁকনপাড়া, শালমারা ও ময়নাগুঁড়িতে ড্রেজার মেশিন দিয়ে গোপনে রাতে পাথর উত্তোলন করা হয়। স্থানীয় প্রশাসন দেখেও না দেখার ভান করে থাকে। সবচেয়ে বেশি পাথর উত্তোলন করা হয় তেঁতুলিয়া উপজেলায়। তেঁতুলিয়ার দেবনগর ইউনিয়নের শিবচণ্ডী, জয়গোনজোত, কালিয়ামণি গ্রামের করতোয়া নদী ও আশপাশ এলাকায় গভীর রাত পর্যন্ত পাথর উত্তোলন করা হয়। ঝালেঙ্গিগছ ও ধানশুকা গ্রামের করতোয়া নদী-সংলগ্ন এলাকা, পাথরঘাটা, আঠারখারী, সুরিগছ, শেকগছ, ময়নাগুঁড়ি গ্রামের বিভিন্ন সমতলভূমি গর্ত করে তোলা হচ্ছে পাথর। ভজনপুর ইউনিয়নের বোগলাহাগী, চোয়ামতি, ফকিরহাট, ভাঙ্গিপাড়া, বাসবারী, ভদ্রেশ্বর, কুকুরমুহা, গনাগছ গ্রামের করতোয়া নদী-সংলগ্ন খাসজমি ও পার্শ্ববর্তী সমতল এলাকায়ও একই কায়দায় পাথর তোলা হচ্ছে। একই ইউনিয়নের খনিয়াগছ, গিতালগছ, ডাক্তারপাড়া, ডিমাগছ, বৈরাগীগছ, ঘগারখাল, কাউরগছ, ডাঙ্গি গ্রামের বিভিন্ন সমতলভূমি, বুড়াবুড়ি ইউনিয়নের হারাদীঘি, বালাবাড়ী, শিলাইগুঁড়ি, কালদাসপাড়া বালাবাড়ী, কাটাপাড়া গ্রামের ডাহুক নদী-সংলগ্ন এলাকায়, শালবাহান হাট ইউনিয়নের মাঝিপাড়া গুচ্ছগ্রাম থেকে চার কিলোমিটার উত্তরে লোহাকাচি গ্রাম পর্যন্ত ডাহুক নদীর বিস্তীর্ণ এলাকায় রাত-দিন বোমা মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে। তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার শেখ মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘আমরা বোমা মেশিন মালিকদের তালিকা তৈরি করছি। শিগগিরই ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে যৌথভাবে অভিযান পরিচালনা করা হবে। তেঁতুলিয়ায় কোনো মেশিন দিয়ে পাথর তুলতে দেওয়া হবে না।’ তেঁতুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুরেশ চন্দ্র বলেন, ‘পুলিশের নাম করে অনেকে চাঁদাবাজি করছে এটা কানে এসেছে। বোমা মেশিন নিয়ে আমরা অত্যন্ত তত্পর রয়েছি। ইতিমধ্যে অনেক বোমা মেশিন আটক করেছি। তবে প্রভাবশালীরা জড়িত থাকায় পুলিশের একার পক্ষে এ মেশিন বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না।’ স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, একটি মেশিন ১২ ঘণ্টা চালাতে পারলে তিন হাজার সিএফটি পাথর উত্তোলন করা যায়, যার বাজারমূল্য প্রায় দেড় লাখ টাকার টাকা। আর এতে খরচ হয় মাত্র ২০ হাজার টাকা। বর্তমানে সময় ভালো না। তাই ১২ ঘণ্টা চালাতে হচ্ছে। এর জন্য প্রতি মেশিন থেকে পুলিশ, কল বাহিনী ও নেতাদের জন্য প্রতি রাতে ১০ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। ভজনপুর এলাকার কয়েকজন নেতা এ চাঁদা তুলে স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করেন। জানা যায়, ২০১৫ সালে পরপর কয়েকবার ভূমিকম্প হয়, যার উত্পত্তিস্থল ছিল পঞ্চগড় থেকে ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে নেপাল ও ভারতে। পরিবেশবিদরা আশঙ্কা করছেন, নেপালের মতো ৭.৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলেই তেঁতুলিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকায় ভূমিধসের সৃষ্টি হবে। জানমালের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতির আশঙ্কাও করছেন তারা। এদিকে তেঁতুলিয়া উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বোমা মেশিনের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা সৃষ্টির জন্য রবিবার বিকালে ভজনপুর এলাকায় এক সচেতনতা সভার আয়োজন করা হয়। জেলা প্রশাসক অমল কৃষ্ণ মণ্ডল ও পুলিশ সুপার গিয়াসউদ্দিন আহমেদ সভায় উপস্থিত ছিলেন। পাথরশ্রমিকরা জানান, অল্প খরচে কয়েক গুণ লাভ হচ্ছে বলে বোমা মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলন করছেন প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা। ফলে হাজার হাজার পাথরশ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। এ অঞ্চলের ৬০ ভাগ মানুষ পাথরকেন্দ্রিক নানা কাজে জড়িত। অধিকাংশ শ্রমিক নদী ও সমতল ভূমি কেটে পাথর উত্তোলনের কাজে জড়িত থেকে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। হিমালয় থেকে ভেসে আসা নুড়িপাথর সংগ্রহ করে চলে অনেকের জীবন। ভজনপুর এলাকার পাথরশ্রমিক আবদুস ছালাম বলেন, ‘বোমা মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলনের ফলে অধিকাংশ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। কারণ বোমা মেশিনে খুব বেশি শ্রমিক লাগে না। আমরা এখন জীবন-জীবিকা নিয়ে মহাসংকটে পড়েছি।’

সর্বশেষ খবর